বিদেহ নন্দিনী~ ৩৫
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(৩৫)
দুদিন পরের কথা। সেদিন সকাল থেকে রাজপ্রাসাদের কোনো একটি দিক থেকে হুলুস্থুল ভেসে আসছিল। প্রথমে শুনেছিলাম উচ্চস্বরে করা সঙ্গীত। তারপরে চিৎকার-চেঁচামেচি। তারপরে একসঙ্গে বাজানো বহু শঙ্খের ভয়ঙ্কর শব্দ। এবার শুনলাম তাল, খোল, মৃদঙ্গ আদির শব্দ। মাঝখানে হাতির চিৎকার এবং বাঘের মত জন্তুর গর্জন। কী হয়েছে জানার জন্য ব্যগ্র হয়েছিলাম যদিও আমার মনের উদ্বিগ্নতা প্রহরীদের দেখাতে চাইছিলাম না। পরে দুপুরের দিকে ওদের কথাবার্তা থেকে জানতে পারলাম যে রাবণ ভাই কুম্ভকর্ণকে যেভাবেই হোক জাগানোর নির্দেশ দিয়েছে।
কুম্ভকর্ণ নামটা আমি শূপর্ণখার মুখে শুনেছিলাম যদিও গত এগারো মাস তার বিষয়ে কোনো কথা কারও মুখে শুনিনি। কখনও কেউ তার বিষয়ে নামটা উচ্চারণ করে থাকলেও আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। পরে একদিন ত্রিজটা আমাকে কুম্ভকর্ণের বিষয়ে সমস্ত কিছু বলেছিল। তাই সেদিন কুম্ভকর্ণকে এভাবে জাগানোর ব্যাপারটা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল।
সেদিন বিকেল বেলা কলা এসে উপস্থিত হল। আমি তাকে বেশ কিছু দিন দেখিনি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম কলা আগের চেয়ে অনেক গম্ভীর হয়ে পড়েছে। আগে সে আমাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসীদের নানাভাবে বিরক্ত করত কিন্তু আজ তার মুখে কথাবার্তা একেবারে সীমিত। জীবনে দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে ঠকে শেখার মেয়েদের মতোই কলার ব্যবহার।
কলা আমার কাছে বসল। তারপর বলল-‘ আপনি হয়তো বর্তমানে মহাযুদ্ধে রামচন্দ্রের বাহিনীর অবস্থান বিষয়ে না জেনে চিন্তান্বিত হয়ে রয়েছেন। তাই মাতা সরমা আপনার চিন্তা দূর করার জন্য আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই ভালো খবরই হবে না হলে সরমা দেশের এই রকম পরিস্থিতিতে কলাকে এভাবে আমার কাছে পাঠাত না। তাই আমি কথাটা শোনার জন্য কলার মুখের দিকে আগ্রহসহকারে চেয়ে রইলাম।
কলা বলতে লাগল-‘ যুদ্ধে একজন একজন করে বীর, মহাবীর সকলের মৃত্যু হওয়ায় রাজা রাবণ তাঁর মহাবলী সেনাপতি প্রহস্তকে রাম বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য পাঠালেন।প্রহস্ত পরম বিক্রমের সঙ্গে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে রামচন্দ্রের অনেক সৈন্যবধ করে। পরে রামচন্দ্রের নীল নামের সেনাপতি পর্বত সমান একটি পাথর এত জোরে ছুঁড়ে মারল যে প্রহস্ত জায়গাতেই মাটির সঙ্গে মিশে গেল। ভয়ে রাক্ষস সেনা ছুটে পালালো। প্রহস্তের মৃত্যুতে রাজা রাবণ খুব দুঃখ পেলেন। কারণ প্রহস্ত তার অতি বিশ্বাসী মন্ত্রী ছিল। খবর শুনে তিনি কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ক্রোধে রণভূমিতে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এক দিক থেকে বাঁদর সেনা এবং বীরদের বধ করতে লাগলেন। রাজা রাবণকে বাঁদর সেনার উপরে ধ্বংসলীলা চালাতে দেখে রামচন্দ্রের মুখ্য সেনাপতি সুগ্রীব এগিয়ে এল। তবে রাবণের শরে সুগ্রীব চেতনা হারিয়ে এক জায়গায় লুটিয়ে পড়লেন। তারপরে রাজা রাবণের মুখোমুখি হল লঙ্কায় বিভীষিকা সৃষ্টি করে আসা মহাবীর বায়ুপুত্র হনুমান। হনুমান লাফ মেরে রাজা রাবণের রথের উপরে বসে নিয়ে নানা বাকবিতণ্ডা আরম্ভ করল।ক্রোধে রাজা রাবণ হনুমানের বুকে এক ধাক্কা দিয়ে দিলেন। এক ধাক্কায় নাকি হনুমান কয়েকপাক ঘুরে কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিল। তারপর নাকি হনুমান ডান হাতে প্রচন্ড জোরে রাজা রাবণের গালে এক চড় বসিয়ে দিল। রাজা নাকি থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ কিছু বলতেই পারলেন না। তারপরে রাবণ হনুমানের বক্ষস্থলে একটা কিল বসিয়ে দিল।হনুমান দূরে ছিটকে পড়ল। সেই সুযোগে রাবণ তাঁর সেনাপতি প্রহস্তকে বধ করা মহাবীর নীলকে আক্রমণ করলেন। নীল নাকি অনেক বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজা রাবণের অবস্থা কাহিল করে চলেছিল।শেষ পর্যন্ত রাবণ এক কোপে নীলকে অগ্নি বাণ মেরে পাঠালেন। সেই বাণে নীল ধরাশায়ী হল।’
কলার মুখে মহাবীর নীল অগ্নিবাণে অসার হয়ে পড়ার কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। মহাবীর হনুমানের মুখে শুনেছিলাম নীল নাকি অগ্নি দেবতার পুত্র। পাপিষ্ঠ রাবণ অগ্নিবান মারায় পিতৃদেব পুত্রকে রক্ষা করলেন না ।
আমার মনের অবস্থা দেখে কলা বলল,- 'মাতা আপনি ভয় পাবেন না ।কিছুক্ষণ পরে নীল পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নীলকে রাবণ ভূপতিত করতে দেখে আপনার দেবর লক্ষ্মণ এগিয়ে এল। লক্ষ্মণ এবং রাবণের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হল। রাজা রাবণের অনেক বাণ লক্ষ্মণ নাকি টুকরো টুকরো করে ফেলল।রাক্ষসরাজ রাবণ লক্ষ্মণক কোনো বাণেই পরাস্ত করতে না পেরে ব্রহ্মা প্রদত্ত শক্তিশেল বাণ নিক্ষেপ করলেন।সেই শেলে লক্ষ্মণ নিমেষের মধ্যে ঢলে পড়ল। রাবণ লক্ষ্মণকে সেই অবস্থায় বন্দি করার উদ্দেশ্যে দ্রুত রথ থেকে নেমে গিয়ে তুলে আনতে চাইলেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা তিনি নাকি লক্ষ্মণকে নাড়াতেই পারলেন না। যে রাজা রাবণ কৈলাস পর্বত, মন্দরাচল হেলাভরে তুলে ধরেছিল, সেই রাবণ মনুষ্য বলে উপহাস করা লক্ষ্মণকে তুলতে পারল না। ঠিক তখনই মহাবীর হনুমান তীব্র গতিতে এগিয়ে এসে রাবণের বুকে প্রচন্ড আঘাত করল। সেই আঘাতে রাবণের নাকি মাথা ঘুরতে লাগল, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেল। সেই সুযোগে হনুমান অবহেলায় লক্ষ্মণকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে রামচন্দ্রের কাছে পৌঁছাল।ভাইকে এরকম অবস্থায় দেখে রামচন্দ্রের রাবণের উপরে প্রচন্ড ক্রোধ হল। তিনি দুর্জয় ধনু নিয়ে এগিয়ে যেতেই হনুমান নাকি বলল-' হে প্রভু রাবণ রথের উপরে উঠে যুদ্ধ করবে। আপনার রথ নেই ,তাই আমার কাঁধে উঠুন।' রামচন্দ্র কথার গুরুত্ব বুঝে হনুমানের পিঠে উঠে রাবণের সামনে এলেন। দশরথ নন্দন নাকি প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে গর্জন করে রাবণকে তিরস্কার করলেন। তারপর তীক্ষ্ণ বাণে রাবণকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুললেন।রাবণ রামচন্দ্রের বাহন হয়ে আসা হনুমানকে এভাবে আঘাত করতে চাইলেন যাতে রামচন্দ্র মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু মহাবীর বায়ুপুত্র সমস্ত আঘাত সহ্য করে নিল। রামচন্দ্র রাজা রাবণের রথ,ধনু সমস্ত কিছু ভেঙ্গে ফেললেন। রাজার মুকুট খসে পড়ল।একবার একটা তীর এসে রাবণের বুকে বিঁধে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাবণের বুক থেকে ধারাসারে রক্ত বইতে লাগল। আর ও একটা বাণ মেরে রামচন্দ্র রাবণকে তখনই বধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না।কেবলমাত্র উপহাস করে বললেন-' রাবণ, তুই খুব বীরত্ব দেখিয়েছিলি না, এখন বুঝতে পারলি তোর বীরত্ব কতটা? আমি তোকে এই মুহূর্তে বধ করতে পারি। আমি যেহেতু তোর মতো নিচ নয় তাই তোকে এই অবস্থায় মারব না। কিছুটা সময় দিচ্ছি ।লঙ্কায় ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আয়।'
কলার কথা শুনে আমি স্বামীর উদারতা, মহানুভবতা এবং সততায় গর্বিত হয়ে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম দুরাত্মা রাবণ এবং সমস্ত লঙ্কাবাসী এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে আমার স্বামী কে? আমি কার পত্নী।
কলা পুনরায় বলতে শুরু করল-' হে দেবী, ত্রিভুবন কাঁপানো রাক্ষসরাজ রাবণকে থর থর পদক্ষেপে রণক্ষেত্র থেকে পায়ে হেঁটে প্রাসাদে আসতে দেখে সমস্ত লঙ্কা নগরী ভয়ে কম্পমান হয়ে পড়েছে। বড়মা মন্দোদরী রাজা রাবণকে আপনাকে রামচন্দ্রের হাতে অর্পণ করে মিত্রতা স্থাপন করার আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু জ্যাঠা রাবণ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে আপনাকে কখন ও ফিরিয়ে দেবেন না। পুনরায় নাকি যুদ্ধ করবেন। তাই আজ আমার অন্য একজন জ্যাঠা কুম্ভকর্ণকে যেভাবেই হোক ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে যুদ্ধে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। কথাটা বলে কলা উঠে দাঁড়াল।আমার হাত দুটো খামচে ধরে কলা বলল-'পিতা বিভীষণ গোপনে পাঠানো সংবাদটুকু মাতা সরমা আপনাকে যেভাবেই হোক দিতে বলেছিলেন বলে আমি এসেছি। একথা বলে কলা দ্রুত আমার কাছ থেকে চলে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন