ভলতেয়ার
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
ভলতেয়ারের বয়স এখন ৮৩ বছর। মরার আর বেশি দিন বাকি নেই। রোগ এবং বার্ধক্যের চাপে শরীর কঙ্কাল-সার। মৃত্যু কাছে চলে এসেছে বলে অনুভব করে একজন ধর্মযাজক তাঁর শেষ স্বীকারোক্তি শুনতে এলেন।
ভলতেয়ার তাকে জিজ্ঞেস করলেন–' মহাশয় ,আপনি কোথা থেকে এসেছেন?'
ধর্মযাজক উত্তর দিলেন–' স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে'
ভলতেয়ার পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন–' আপনার অভিজ্ঞান-পত্র?'
ধর্মযাজকের খুব রাগ হল এবং ভলতেয়ারের স্বীকারোক্তি না শুনেই ফিরে গেলেন।
এবার এলেন দ্বিতীয় একজন ধর্ম-যাজক। ইনি আবার জিদ করলেন যে ভলতেয়ার নিজেকে রোমান ক্যাথলিক বলে ঘোষণা করে একটি প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করলেই তিনি ভলতেয়ারের স্বীকারোক্তি শুনবেন।
ভলতেয়ার ধর্মযাজককে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেই একটি জবানবন্দি লিখে তার সচিব ওয়েগনারের হাতে দিলেন। জবানবন্দিতে তিনি ঘোষণা করলেন–' আমি ঈশ্বরকে বন্দনা করেছিলাম, বন্ধুদের ভালোবেসেছিলাম, কোনো শত্রুকে ঘৃণা করি নি; কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলাম। এভাবেই আমি মৃত্যুবরণ করেছি।'
কিন্তু মৃত্যুবরণ করতে তাঁর আরও কিছু সময় দেরি ছিল।রোগজীর্ণ অবস্থায় লক্ষ লক্ষ গুণগ্রাহী তাকে ঘোড়ার গাড়িতে তুলে ফরাসি আকাডেমির কার্যালয়ে নিয়ে গেল। সেখানে তাকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হল। প্যারিসের বিদ্বান-সমাজের উচ্ছ্বসিত সম্বর্ধনার উত্তরে ৮৩ বছরের মৃত্যু-পথ-যাত্রী ভলতেয়ার প্রস্তাব দিলেন যে ফরাসি অভিধানের সংশোধনের কাজে এখনই হাত দেওয়া উচিত, আর তিনি নিজে A অক্ষর দিয়ে আরম্ভ হওয়া সমস্ত শব্দের সংশোধনের কাজ করতে প্রস্তুত!
কে ছিলেন এই ভলতেয়ার?
উইল ডুরান্ট পৃথিবীর দশ জন সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবুকের যে তালিকাটি প্রস্তুত করেছেন সেই তালিকায় স্থান পেয়েছেন আঠারো শতকের ফরাসি দার্শনিক এবং চিন্তা-নায়ক ভলতেয়ার(১৬৯৪-১৭৭৮)। ভলতেয়ারের বিষয়ে তিনি লিখেছেনঃ
' ষোড়শ লুই যখন টেম্পল কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন, তিনি তাতে একদিন ভলতেয়ার এবং রুশোর বইগুলি দেখতে পেলেন। বইগুলি দেখে তিনি বললেন–' এই দুইজন মানুষই ফ্রান্সকে ধ্বংস করেছে।'
ফ্রান্স বলতে তিনি বুঝেছিলেন ফরাসি সম্রাটদের স্বৈর-তন্ত্র। বেচারা সম্রাট দর্শন কে যতখানি সম্মান দেখিয়েছিলেন ততটা সম্মান বোধ হয় দর্শনের প্রাপ্য ছিল না, কারণ ফ্রান্সে ভলতেয়ারকে কেন্দ্র করে চিন্তার যে বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান আরম্ভ হয়েছিল তার মূল কারণ গুলি ছিল অর্থনৈতিক। কিন্তু প্রাণীর চেতনা যন্ত্রণা অনুভব করলেই যেভাবে প্ৰাণীর দেহটা যন্ত্রণার কারণ গুলির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠে ঠিক সেভাবেই শত শত চিন্তাশীল লেখকের লেখনী বুর্বো শাসিত ফ্রান্সের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের বিবেক এবং চেতনাকে জাগ্রত করে তোলার ফলে এই ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণ বিদ্রোহ করে উঠল। ফ্রান্সের বিবেক জাগ্রত করে তোলা সেই বিরাট অভিযানের প্রধান সেনাপতি ছিলেন ভলতেয়ার। অন্য সবাই স্বেচ্ছায় তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন এবং তার নির্দেশ পালন করে গর্ব অনুভব করেছিলেন এমনকি প্রবল পরাক্রমী সম্রাট ফ্রেডেরিকও ভলতেয়ারের গুনকীর্তন করে বলেছিলেন যে–' তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা।'
ভলতেয়ারের মৃত্যুর পরে সমাধিক্ষেত্রে তার শব দেখো বহন করে নিয়ে যাওয়া গাড়ির ওপরে লেখা ছিল এই কথাটা– তিনি মানুষের মনকে প্রবলভাবে উদ্দীপিত করেছিলেন; তিনি আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।'
ভলতেয়ারের কয়েকটি বিখ্যাত উক্তিঃ
যদি ঈশ্বর না থাকতেন তাহলে তাকে আবিষ্কার করার প্রয়োজন হত।
জীবনের তিনটি অশুভ শক্তি আমাদের কর্মে বাধার সৃষ্টি করে। সেই তিনটি হল আলস্য-জনিত অবসাদ, দুষ্কর্মের প্রবৃত্তি এবং দরিদ্রতা।
তোমার কথার সঙ্গে আমি একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার সেই কথা বলার অধিকার আমি প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করব।
ধর্মোন্মাদনা এবং নাস্তিকতার মধ্যে কোনটি বেশি বিপজ্জনক। নাস্তিকতা মানুষের মনে হিংস্র আবেগের সৃষ্টি করে না; ধর্মোন্মাদনা করে। নাস্তিকতা হয়তো অপরাধের বিরোধিতা করে না: কিন্তু ধর্মোন্মাদনা মানুষকে অপরাধ করতে বাধ্য করে।
গত চার হাজার বছর ধরে চার হাজারটা বিভিন্ন প্রকারে আমরা আমাদের সন্দেহ বা সংশয়গুলি কথা আলোচনা করে এসেছি। এই অন্তহীন সংশয়ের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থাটি হল নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কাজ না করা।
এই গোপন রহস্যটি জানলেই আমরা জীবনটাকে ভালোভাবে উপভোগ করতে পারব এবং মৃত্যু-ভয় জয় করতে পারব।
মূর্খ দাসত্বের যে শিকলটাকে পুজো করে সেই শিকল থেকে তাকে মুক্ত করার কাজটা অত্যন্ত কঠিন ।
এটা অত্যন্ত পরিতাপের কথা যে একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য আমাদেরকে একমাত্র আমাদের বাইরে বাকি সমগ্র মানবজাতির শত্রু হতে হয় ।
দরিদ্র মানুষ কখনও স্বাধীন নয়। প্রত্যেক দেশেই সে অন্যের দাসত্ব করে।
আমি জীবনে বহু কষ্ট ভোগ করেছি। কিন্তু কষ্ট ভুগেছি ধৈর্যের সঙ্গে, ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণের মনোভাবে। আমি কষ্ট ভুগেছি মানুষের মতো; একজন খ্রিস্টানের মতো নয়।
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন