দুরারোগ্য রোগের জন্য একটি কাহিনি
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
নিচের কাহিনিটি আমি কোনো একটি বইয়ে পড়েছিলাম।কিছু কাহিনি একবার পড়ার পরে তা কখনও ভোলা যায়না। পুষ্টিকর আহার যেভাবে হজম হয়ে রক্তে পরিণত হয়, ঠিক তেমনই কিছু কাহিনিও আমাদের চেতনায় মিশ্রিত হয়ে আমাদের জীবনী শক্তির জোগান দিয়ে থাকে। কোনো একটি বইয়ে পড়া এই কাহিনিটি আমি এখন নিজের ভাষায় বলব।
শ্বারন মনস্কির উচ্চতা ছিল মাত্র পাঁচ ফুট।আমেরিকান মাপকাঠিতে সে একজন বেঁটে মেয়ে ছিল।তাঁর শরীরের ওজনও বেশি ছিল না। এক কথায় বলতে গেলে একজন ক্ষীণ, ছোট খাটো মেয়ে। কিন্তু তাঁর শরীরটা ছিল শক্তিশালী, মন তার চেয়েও শক্তিশালী। সে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যিক প্রশাসনের উচ্চতম ডিগ্রী লাভ করে মেককিনছি এন্ড কোম্পানি নামের একটি বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানির অফিসার হিসেবে যোগদান করে। কলেজে পড়ার সময়ই মার্ক্স নামের একজন সহপাঠী ছাত্রের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়েছি। পাঁচ বছর পর সে জানতে পারল যে সেই বন্ধুত্ব ছিল প্রেম । কর্মজীবনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দুজনে বিয়ে করল। মার্ক্স একজন প্রতিভাবান হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান মানুষ।দুজনেরই একটি সুখের সংসার হল।
তাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৭ সনে।১৯৮২ সনে শ্বারন হঠাৎ একদিন আবিস্কার করে যে শরীরটা ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে তার বিছানা থেকে উঠার শক্তি নেই । ঘটনাটা হঠাৎ ঘটল। একনাগাড়ে কয়েকদিন তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হল।তাঁর শরীরের গাঁটগুলি ফুলে উঠল। যন্ত্রণায় তাঁর নিঃশ্বাস নিতে না পারার অবস্থা হল। কলম ধরার মতো তাঁর শরীরে শক্তি রইল না। ডাক্তারের কাছে যাওয়ায় তিনি অসুখটা কী বুঝতেই পারলেন না। তারপর দুটো বছর ধরে তাকে বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হল। কিন্তু ডাক্তাররা তাকে আরোগ্য করা দূরের কথা, তাঁর অসুখটা যে কী সেটাই বুঝতে পারলেন না। কিছুদিন পরে তাঁর মুখের চামড়ায় এতটাই টান ধরতে লাগল যে সে মুখটা বন্ধ করতে গিয়ে অত্যন্ত যন্ত্রণা অনুভব করল। অসুখটা আরম্ভ হওয়ার দুই বছর পরে তাঁর যন্ত্রণা এত বেশি বেড়ে গেল যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। তখনই প্রথমবারের জন্য ধরা পড়ল যে তাঁর স্কেলরডার্মা নামে একটি দুরারোগ্য ত্বকের অসুখ হয়েছে। এই রোগের লক্ষণ হল যে মানুষের ত্বকে ক্রমশ টান ধরতে থাকে, এবং অবশেষে তা পাথরের মতো শক্ত হয়ে পড়ে। পাথরের মত শক্ত ত্বকের চাপে মাংসপেশীগুলিও পাথরের মত শক্ত হতে শুরু করে । একটা ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সর্বাঙ্গ গ্রাস করে ফেলে। অথচ এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই।
ডাক্তাররা তাকে বলল যে সে হয়তো খুব বেশি তিন বছর বেঁচে থাকতে পারে।
রোগ ধরা পড়ার এক বছরের মধ্যে শ্বারন কাজ করার শক্তি–সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। কেবল নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকাটাই একটা বিভীষিকায় পরিণত হল। তখনও শ্বারন মাতৃ হয়নি। কিন্তু দুরারোগ্য রোগ তাঁর শরীরটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার সময় সে ঠিক করল যে এবার সে মা হবে। একটা পরিবার আরম্ভ করার জন্য স্বামী এবং স্ত্রী দুজনেই সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ডাক্তাররা তাদের বলল যে তারা একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।শ্বারনের বর্তমান শারীরিক অবস্থায় গর্ভধারণ করাটা হবে তাঁর জন্য বিপদজনক। কিন্তু শ্বারন ডাক্তারি বইপত্র পড়ে জানতে পারল যে গর্ভাবস্থায় তাঁর যদি মৃত্যু না হয়, তাহলে তার শিশুটা কিন্তু সুস্থ এবং সবল হয়ে জন্মাবে। গর্ভস্থ সন্তানকে রক্ষা করার জন্য মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব সে ততটা যত্ন নিল। অবশেষে একটা পুত্রসন্তানের জন্ম হল। তার নাম রাখা হল ম্যাক্স।
ম্যাক্স শ্বারনকে রোগের যন্ত্রণা জয় করার জন্য এবং নতুন আশায় বেঁচে থাকার জন্য একটা প্রেরণা দিল। ম্যাক্স তার জন্য একটি সন্তান হয়েই রইল না, সে হয়ে পড়ল তাঁর জীবনের একটি নতুন লক্ষ্য।
শ্বারনের রোগ-যন্ত্রণা দিন দিন বাড়তে লাগল। কিন্তু সে নিজের যন্ত্রণার কথা চিন্তা না করে নতুন চিন্তা শুরু করল। আগেই বলা হয়েছে যে সে ছিল একটি বাণিজ্য- উপদেষ্টা কোম্পানির উচ্চ পদস্থ অফিসার। নিজের বাণিজ্য পরিচালনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সে স্থাপন করল স্কেলর'ডার্মা গবেষণা কেন্দ্র। তাঁর মনে বিশ্বাস ছিল যে এই রোগটা আজ দুরারোগ্য হতে পারে কিন্তু গবেষণা করতে থাকলে একদিন না একদিন তার নিরাময়কারী ঔষধ বেরোবে। সেই জন্য সে গবেষণা কেন্দ্রটির জন্য ধন সংগ্রহ করতে আরম্ভ করল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতে থাকা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের এই রোগটির বিষয়ে গবেষণা করার জন্য শ্বারন অনুপ্রাণিত করল। একদিকে নিজের রোগের যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ,অন্যদিকে গবেষণা কেন্দ্রটির জন্য ধন সংগ্রহ এবং বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ- তার মধ্যেই শ্বারন ঠিক করল যে সে তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মদান করবে । তাঁর মাতৃ হওয়ার সঙ্কল্পটা যেন ছিল অবর্ণনীয় যন্ত্রণাদায়ক এবং দুরারোগ্য রোগটির প্রতি একটা গর্বিত প্রত্যাহ্বান । এবার কিন্তু তাঁর মাতৃ হওয়ার ইচ্ছাকে ডাক্তাররা বাধা দিল না। যথাসময়ে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হল।
একই সঙ্গে তিনটি কাজ তাকে জড়িয়ে ধরল–তাঁর দুরারোগ্য রোগ, তাঁর দুটি শিশু সন্তান এবং তাঁর গবেষণা কেন্দ্র। এদিকে, তাঁর অসুখও আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাঁর ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পেতে পেতে এখন মাত্র ৩৮ শতাংশ আছে। ফলে দেহটা সামান্য নাড়াচাড়া করলেই সে ক্লান্তিতে আধমরা হয়ে পড়ে। হাতের আঙ্গুলগুলি এত দুর্বল যে নিজের ব্লাউজের বোতাম লাগানোটাও তার কাছে একটা বিভীষিকায় পরিণত হল। নিজের সাজ পোশাক পরা, চুলের খোপা বাঁধা, দরজা খোলা প্রতিটি ক্ষুদ্র কাজই হল ভয়ংকরভাবে যন্ত্রণাদায়ক ।
এমন সময় আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটল। অসুস্থতা তার মুখের ত্বক টেনে টেনে সংকুচিত করে ফেলার ফলে তাঁর মুখটা বিকৃত হয়ে পড়ল।তাঁর মুখে চোখ পড়ামাত্র মানুষেরা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু শ্বারন সেই অস্বস্তিও হেলায় জয় করতে সক্ষম হল। সে নিজেকে বলল–' আমার বিকৃত মুখের সঙ্গে আমার ভেতরের আসল মানুষটার কোনো সম্পর্ক নেই । আমার শরীরটা দেখতে কী রকম বা তা কীভাবে কাজ করে, এই কথাটা আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না। সেই সমস্ত কথার ওপরে আমার জীবন নির্ভর করে না।'
জীবনের চরম দুর্ভাগ্যকে প্রত্যাহ্বান জানানোর জন্য সে তৃতীয়বারের জন্য মা হওয়া ঠিক করল। এবার নির্দিষ্ট সময়ে এবং কোনো সমস্যার সৃষ্টি না করে শ্বারনের তৃতীয় সন্তানের জন্ম হল– একটি কন্যা।
শ্বারন এখন তিন সন্তানের মাতা। তারাই তাঁর বেঁচে থাকার প্রেরণা। কারণ সন্তান চায় মাতার অন্তহীন স্নেহ। ধীরে ধীরে ওরা বড় হতে লাগল । ম্যাক্সের ১০ বছর' ছামান্থার ছয় এবং মন্টানার চার বছর। শ্বারন ওদের কাছ থেকে তার রোগটি গোপন করার চেষ্টা করল না। বরং ধীরে ধীরে রোগটির বিষয়ে ব্যাখ্যা করে সে সন্তানদের পরিচিত করে তুলল। একদিন তাদের সঙ্গে শ্বারন স্কুলে যাওয়ার সময় কয়েকটি ছেলে মেয়ে শ্বারনের বিকৃত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। তখন ম্যাক্স তাদেরকে বলল–' আমার মাকে নিয়ে এভাবে হেসো না, আমার মায়ের স্কেলর'ডার্মা হয়েছে।'
শ্বারন একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।তাঁর সন্তানেরা অসুখটাকে মেনে নিতে শিখেছে।
এদিকে,শ্বারনের দুরারোগ্য ব্যাধি এক জায়গায় থমকে নেই। একটু একটু করে তা বেড়েই চলেছে। সমগ্র শরীরে সবসময় যন্ত্রণা, অবর্ণনীয় ভয়ংকর যন্ত্রণা। সে যদি বিছানায় শুয়ে থাকে, তখন শরীরের জোড়াগুলি বরফের মতো কঠিন হয়ে তাকে নাড়াচাড়া করতে না পারার মতো অবস্থা হয়ে পড়ে। শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাবার একটুখানি পথও তার কাছে এত দীর্ঘ বলে মনে হয় যে সে ভয়ে কেঁপে উঠেঃ এতটা রাস্তা আমি কীভাবে যাব? কিন্তু সে নিজেকে বলে–' পারবে, যেতে পারবে। একটা পায়ের থেকে অন্য পা সামনে এগিয়ে দাও। তারপরে অন্য পা এগিয়ে দাও। তুমি নিশ্চয় রান্না ঘরে পৌঁছে যাবে।' সে যেহেতু ছেলে মেয়েদের জুতোর ফিতা বেঁধে দিতে পারে না, সেই জন্য সে তাদের জন্য ফিতা বিহীন জুতো কিনে দিয়েছে। ওদের হাতের কাছেই ঘরের বিভিন্ন জায়গায় জলপান খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছে। রান্না করার কষ্ট কমানোর জন্য সমগ্র পরিবার সাধারণ আহার খাওয়ার অভ্যাস করেছে। নিজের জন্য কোন খাদ্য খারাপ,পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করে শ্বারন নিজের জন্য পুষ্টিকর আহারের তালিকাও প্রস্তুত করে নিয়েছে। এই সমস্ত কাজ করে থাকার মধ্যে মধ্যে শ্বারণ নিজেকে অবিরাম ভাবে বলেছে–' ডাক্তার আমাকে যত আয়ু দিয়েছিল তার চেয়ে আমি অনেক বেশি বছর ধরে বেঁচে রয়েছি। কেন বেঁচে আছি? কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি বেঁচে থাকব। আমি এই রোগটিকে পরাস্ত করব। আমি আমার রোগটিকে কখন ও আমার পরিবারের চিন্তা এবং চর্চার বিষয় হতে দেব না।'
ইতিমধ্যেই তাঁর গবেষণা কেন্দ্রটিও কৃতকার্যতার অভিমুখে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। আমেরিকার সরকার এবং বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের মানুষ তাঁর আহ্বানের প্রতি এত বিপুলভাবে সারা জানাল যে গবেষণা কেন্দ্রটির জন্য অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তিন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হল। গবেষণা কেন্দ্রটির অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বক্তৃতা দিলেন, টেলিভিশনে বক্তৃতা দিলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য অর্থ সাহায্য দান করা বিভিন্ন ফাউন্ডেশনে বক্তৃতা দিলেন। Positive Thinking Foundation নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাকে ৫০০০ ডলার দিয়ে সম্মানিত করল। এই সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক ভাবে তাকে গভীর আনন্দ এবং সন্তুষ্টি দান করল। কিছু যে কথা তাকে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্টি দান করল তা হল এই যে অবর্ণনীয় শারীরিক যন্ত্রণা অর্ধমৃত এবং আতঙ্কিত করে রাখা মানুষগুলিকে তিনি দিতে পারলেন তাদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটি– আশা।
শ্বারনের জীবন কালে হয়তো স্কেলর'ডার্মা আরোগ্য করতে পারা ঔষধ আবিষ্কার হবে না, কিন্তু তিনি এই সান্ত্বনা নিয়ে মরতে পারবেন যে তিনি কি ধরনের মানুষ ছিলেন এবং জীবনের প্রত্যাহ্বান তিনি কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন, সে কথা তাঁর সন্তানেরা জানবে। যন্ত্রণার কথা ভেবে থাকার মতো সময় তাঁর নেই।তাঁর প্রচুর সময়ের প্রয়োজন পরিপূর্ণ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য, অনাগত ভবিষ্যতের মানুষের জন্যই বেঁচে থাকার জন্য।
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন