সবাই মিলে সিনেমা হলে~ ২২
কান্তিরঞ্জন দে
মানুষের মিত্র ::সৌমিত্র
সিনেমার হিরো হয়ে জনপ্রিয় হওয়া কঠিন । কিন্তু আরও কঠিন সেই জনপ্রিয়তা দীর্ঘ দীর্ঘদিন ধরে বজায় রাখা । তার চেয়েও কঠিন----প্রিয়জন হয়ে ওঠা বা মানুষের মিত্র হয়ে ওঠা । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সারাজীবন ধরে খুব সফলতার সঙ্গে সেই কাজটিই করে যেতে পেরেছিলেন । কি করে পারলেন ?
১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার নামক প্রথম ছবিতেই তিনি সফল হলেন । কিন্তু সেই সাফল্য তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দেয় নি । বরং , ওই সফলতার কারণেই তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগের একটা পথ সারা জীবনের জন্য পেয়ে গেলেন।
ছোটবেলা থেকে নাটক করতেন । কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে সেই চর্চা শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মতো মহৎ শিল্পীর সান্নিধ্যে এসে আরও বেগবান হলো । রূপবান মানুষটি যৌবনের প্রথম দিনগুলো থেকেই শিল্প সংস্কৃতিমূলক কাজের মাধ্যমে জনজীবনে নিবিড় মেলামেশা করতেন । অপুর সংসার-এর পর সিনেমাই তাঁর কাছে হয়ে উঠল নিবিড় গণসংযোগের প্রধানতম উপায় ।
কবিতা লেখা , আবৃত্তি করা , নাটক লেখা কিংবা অনুবাদ করা , নাটক সব দিক থেকে পরিচালনা করা ------- এর সব ক'টাই তাঁর জনসংযোগ উদ্যমের ফসল । কিন্তু সবার মতো তিনিও জানতেন, একসঙ্গে অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য সিনেমার চেয়ে বড় হাতিয়ার আধুনিক যুগে আর কিছু নেই । সেই কারণেই বাংলায় টেলিভিশন সিরিয়াল যখন বিনোদনের জোরালো মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল , তিনি কিন্তু তাঁর খ্যাতি প্রতিষ্ঠা , সামাজিক উচ্চতাকে আঁকড়ে ধরে নাক উঁচু করে ঘরে বসে রইলেন না । সিরিয়ালের অভিনয়েও অংশ নিতে লাগলেন । নব্বই দশকের মাঝামাঝি এক-দুই সিজন পেশাদার যাত্রা মঞ্চেও অভিনয় করলেন ।
অনেকে এর পেছনে অর্থলোভের গন্ধ পেতে পারেন । কিন্তু এই অনুমান ঠিক নয় । সৌমিত্রবাবু মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন । সে কারণেই সিনেমার পর্দা , মঞ্চ , টিভি কিংবা যাত্রা---অভিনয়ের যতগুলো মাধ্যম আছে-----সব ক"টিতেই তাঁর পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও পরিশ্রম ঢেলে দিয়েছিলেন ।
সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে তাঁর সিনেমায় প্রবেশ । পরের দু-তিন বছরের মধ্যেই তপন সিংহ , অজয় কর , অসিত সেন , মৃণাল সেন-এর মতো দক্ষ ও মেধাবী পরিচালকদের ছবিতে কাজ করার সূত্রে চলচ্চিত্র জগতে সহজেই তাঁর প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল । খুব অল্পদিনের মধ্যেই উত্তমকুমারের পাশাপাশি রোম্যান্টিক হিরো হিসেবে বাংলা সিনেমায় তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছল ।
কিন্তু তিনি তো শুধু অর্থ কিংবা গ্ল্যামারের মোহে সিনেমা জগতে আসেন নি । এসেছেন সিনেমা নামক শিল্পমাধ্যম এবং অভিনয়কে ভালোবেসে । ততদিনে অবশ্য অভিনয় তাঁর পুরো সময়ের জীবিকা কিংবা পেশা হয়ে গেছে ।
আমাদের দেশে পেশাদার শব্দটি প্রায়শই বিকৃত অর্থে ব্যবহার হয় । পরিপূর্ণ পেশাদার মানে কিন্তু শুধুই অর্থপিশাচ বোঝায় না । পেশাদার মানে-----যিনি অর্থ কিংবা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তার সম্পূর্ণ নৈপুণ্য এবং গুণে মানে সেরা কাজটি দেবেন । সেই অর্থে একজন মুদি দোকানদার , ছুতোর মিস্ত্রি কিংবা সিনেমার অভিনেতা----সবাই পেশাদার ।
সিনেমায় সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অভিনয়ে সর্বোৎকৃষ্ট গুণমানে পৌঁছনোর জন্য সারাজীবন তাঁর মেধা , পরিশ্রম , নিষ্ঠা , অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা বিনিয়োগ করে গেছেন । অভিনয় করেছেন ভালোবেসে । শারীরিক ক্ষমতার তুঙ্গে থাকবার জন্য আজীবন ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করে গেছেন । শুধু রূপ যৌবন ধরে রাখার জন্যই নয় । একজন অভিনেতা ( পর্দার কিংবা মঞ্চের ) যদি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত একশো শতাংশ ফিট না থাকেন, তবে তার রিফ্লেক্স কমে যাবে । তিনি ভালো অভিনয় করতেই পারবেন না ।
দ্বিতীয় কথা , সারা পৃথিবীর মতো বাংলাতেও দর্শক নানা শ্রেণীর হয় । শুধুমাত্র পুরষ্কার প্রত্যাশী ছবিতেই অভিনয় করব , অন্য কোনও ধরণের ছবিতে অভিনয় করব না ------- এ রকম গোঁ ধরে বসে থাকলে , আর যাই হোক , তিনি জনতার শিল্পী হতে পারবেন না ।
সৌমিত্রবাবু জনতার শিল্পীই হতে চেয়েছিলেন । আগেই বলেছি , অভিনয় তাঁর কাছে ছিল জনসংযোগ তৈরির হাতিয়ার । সে কারণেই , অভিনয় জীবনের দু তিনবছরের মধ্যেই শুধু রোম্যান্টিক হিরোর চরিত্রে আটকে না থেকে , নানা ধরণের বিচিত্র চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন । বারবার নিজের ইমেজ ভেঙ্গেছেন। এই ইমেজ ভাঙ্গার প্রচেষ্টা তাঁর আমৃত্যু জারী ছিল ।
ঝিন্দের বন্দী ( তপন সিংহ /১৯৬১) ছিল সৌমিত্রবাবুর জীবনের সাত নম্বর ছবি । সেখানে তিনি ভিলেন চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন নি । অন্যদিকে, তেরো নম্বর ছবি " অভিযান"-এ ( সত্যজিৎ রায় / ১৯৬২) ছবিতেই তিনি ইমেজ ভাঙা কর্কশ রুক্ষ পাঞ্জাবী ড্রাইভার নর সিংয়ের চরিত্রে প্রাণঢালা অভিনয় করেছিলেন ।
এই ভাবে প্রৌঢ় বয়সে উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর শেষ ছবি " প্রতিশোধ " ( সুখেন দাস /২৯৮১) ছবিতেও ভিলেন কিংবা স্বপন সাহা পরিচালিত আপাদমস্তক বাণিজ্যিক ছবি " মিনিষ্টার ফাটাকেষ্ট " ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে পেছ-পা হন নি ।
এই কারণেই যতদিন বেঁচে ছিলেন , ততদিন তিনি ছিলেন দুই বাংলার নয়নের মণি । অবিভাজ্য বাঙালি সংস্কৃতির শেষ বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ।
তাই তাঁর অসুস্থতার দীর্ঘ চল্লিশ দিন ধরে সারা পৃথিবীর বাঙালিরা আন্তরিক ভাবে তাঁর আরোগ্য কামনা করে গেছেন । মৃত্যুর পরে করোণা ভয় উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ তাঁর শেষযাত্রায় সামিল হয়েছিলেন ।
সব দিক থেকে , সত্যি অর্থে খাঁটি এই জনতার শিল্পীকে আমার আভূমি প্রণাম ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন