বিদেহ নন্দিনী~ ৩০
(ত্রিশ)
কিস্কিন্ধা নগরের তোরণে দাঁড়িয়ে সুগ্রীব নাকি তর্জন -গর্জন করে বালীকে যুদ্ধে আহ্বান জানায়। ভাইয়ের দুঃসাহস দেখে নাকি বালী ভীষণ ক্রোধিত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে আসেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে লাথি চড়, ঘুসাঘুসি, থেকে শুরু করে হাতাহাতি, জাপটাজাপটি, মল্লযুদ্ধ হতে লাগল। বালীর মারের চোটে নাকি সুগ্রীবের প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। তাই সুগ্রীবের স্বামী রামচন্দ্রের উপরে ভীষণ রাগ হল। কারণ দুজনের যুদ্ধ করা অবস্থায় গাছের আড়াল থেকে বালীর দিকে রামচন্দ্রের শর নিক্ষেপ করার কথা ছিল।কথা দিয়ে রামচন্দ্র বাণ না চালানোয় সুগ্রীব প্রাণের ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে সোজা ঋষ্যমুক পর্বতে গিয়ে পৌঁছালো। যাতে বালী সেখানে এসে আক্রমণ করতে না পারে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে সুগ্রীব নাকি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে স্বামীও যখন ঋষ্যমুক পর্বতে ফিরে এলেন, সুগ্রীব নাকি খুব দুঃখের সঙ্গে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে, 'হে রাঘব, আমি তো আপনাকে আগেই জানিয়েছিলাম যে আমি বালীকে গায়ের জোরে পরাজিত করতে পারব না। আপনার সাহসে আমি সাহসী হয়েছিলাম। আপনার কথা বিশ্বাস করেই বালীকে যুদ্ধে আহ্বান করেছিলাম। যদি বালীকে বধ করার ইচ্ছা আপনার ছিল না আমাকে তাহলে মিছামিছি কেন মার খাওয়ালেন?
সুগ্রীবের ক্রোধ, রাগ, অভিমান দেখে স্বামী নাকি তার সমস্যার কথা বললেন-' তোমরা দুই ভাই দেখতে এতটাই একরকম যে আমি বাণ চালাতে ভয় পেলাম। কে জানে ভুলে বাণ হয়তো তোমার শরীরে লাগে। তাই মিত্র, আমাকে ভুল বোঝ না। পুনরায় যুদ্ধের জন্য মন প্রস্তুত কর।এবার তোমার গলায় একটা মালা পরিয়ে দেব। তাহলেই মালা দেখে তোমাকে চিনতে পারব।লক্ষ্মণ নাকি তখনই দ্রুত লতা, ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে সুগ্রীবের গলায় পরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সুগ্ৰীব সবাইকে নিয়ে পুনরায় কিস্কিন্ধা যাবার জন্য যাত্রা করে। কিস্কিন্ধা নগরের তোরণে দাঁড়িয়ে সুগ্ৰীব নাকি আস্ফালন করে পুনরায় বালীকে যুদ্ধে আহ্বান করে। ভাইকে পুনরায় যুদ্ধে আসতে দেখে বালীর নাকি ধৈর্যচ্যুতি হয়। কিন্তু বালির পত্নী তারা সুগ্রীবের আস্ফালনে বিপদের গন্ধ পেল।সকালে এত মার খাবার পরেও বিকেলে পুনরায় যুদ্ধে আসার কথাটা তারা সহজভাবে নিতে পারছিল না। তার মধ্যে সে দেবর সুগ্রীবকে রাম লক্ষ্ণণের সঙ্গে মিত্রতা করার কথা গুপ্তচরের মুখে শুনে ছিল। কিন্তু বালী নাকি তারাকে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে উপদেশ দিয়ে বলেছিল-'প্রিয়তমা, আমি রাম লক্ষ্ণণের কথা শুনেছি। তারা সুগ্রীবের সঙ্গে মিত্রতা করলেও অন্যায় যুদ্ধ করবে না। এভাবে বলে তিনি সুগ্ৰীবকে ভালোভাবে শিক্ষা দেবার জন্য বেরিয়ে এলেন।
দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল। সুগ্রীব সেই যুদ্ধে বেশি সময় টিকতে পারবে না বুঝতে পেরে স্বামী রামচন্দ্র গাছের আড়াল থেকে বালীর দিকে বাণ ছুঁড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে বালী মাটিতে ঢলে পড়লেন। মৃতপ্রায় বালী যখন জানতে পারলেন যে রামচন্দ্রের শরের দ্বারা সে বিদ্ধ, তখন নাকি স্বামীকে তিরস্কার করে বলেন-' হে রঘুনন্দন, আমি তো তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করিনি। এমনকি তুমি যে গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছ সে কথাও আমি জানতাম না। আমার পত্মী তারা তুমি সুগ্ৰীবের সঙ্গে মিত্রতা করার কথা জানতে পেরে তুমি কোনো ভাবে যুদ্ধে আসতে পার বলে ভয় পেয়েছিল। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম, মহারাজ দশরথের পরাক্রমী, জ্ঞানী, ধার্মিক পুত্র রামচন্দ্র অন্যায় যুদ্ধ করে না।আমি তো তোমার রাজ্যে কখনও উপদ্রব, তোমার কোনো অনিষ্ট করিনি। তাহলে তুমি কেন এভাবে গুপ্তহত্যায় লিপ্ত হলে? সুগ্রীব তোমার পত্নীকে খুঁজে এনে দেবে বলেই কি? কিছুক্ষণ পরে আমার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাবে। মৃত্যুর আগে আমি জানতে চাই, কেন আমাকে বধ করা হল। আমার দোষ কোথায়?
অনেকক্ষণ কথা বলে নীরব হয়ে পড়া বালীকে নাকি স্বামী ধর্ম, অর্থ,কাম এবং সদাচার বিষয়ে কিছু কথা বলেন। বালীকে বধ করে তিনি যে কোনো দোষ করেননি সেকথা প্রতিপন্ন করার জন্য রামচন্দ্র নাকি বলেছিলেন-' আমি বিখ্যাত ইক্ষাকু বংশের সন্তান। সমস্ত পৃথিবীর মালিক ইক্ষাকু বংশের রাজারা। তাই এই জগতের সমস্ত প্রাণীকে দন্ড দেবার অধিকার ইক্ষাকু বংশের রাজাদের রয়েছে। ইক্ষাকু বংশের রাজা ভরত। তিনি সর্বদা দুষ্টের দমন এবং শান্তকে পালন করতেন। সমস্ত সদগুণের দ্বারা বিভূষিত মহারাজ ভরতের দ্বারাই আমি পরিচালিত। তাই কোনো অধর্মের কাজ আমি সহ্য করি না। তারপর নাকি স্বামী বালীকে বধ করার তিনটি কারণ দেখান। প্রথম কারণ, ' তুমি সুগ্ৰীবের পত্নী রুমার সঙ্গে সহবাস করেছ। ভাতৃবধূ পুত্রবধূর সমান। আমি ইক্ষাকু বংশের সন্তান। এই ধরনের পাপ কাজকে কখনও প্রশ্রয় দিতে পারিনা ।দ্বিতীয় কারণটি হল আমি সুগ্রীবের সঙ্গে মিত্রতা পাশে আবদ্ধ।তাকে পত্নী এবং রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ায় সাহায্য করব বলে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তৃতীয় কারণটি হল আমি মাংসাহারী ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় এবং ধর্মজ্ঞ রাজর্ষিরাও প্রত্যেকে মৃগয়া করে। পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া জন্তু বা মৃগকে বধ করলে তাতে কোনো দোষ হয় না ।তুমি হলে বাঁদর। আমি তোমাকে ডালে ডালে ঘুরে বেড়ানো মৃগ বলেই গণ্য করেছি। তাই আমি যেহেতু ক্ষত্রিয়, আমার তোমাকে বধ করার অধিকার আছে।তাই তোমাকে আমার বাণের লক্ষ্য করে নিয়েছিলাম।'
স্বামীর কথা শুনে বালীর নাকি কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এসেছিল। সে একমাত্র পুত্র অঙ্গদের জন্য শোক করে বলেছিল-'অঙ্গদ আমার খুব আদরের। তার যাতে কোনো কষ্ট না হয় সেজন্য অঙ্গদকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। পত্নী তারার বিষয়ে নাকি বলেছিল,- 'তারাকে ভুল বুঝে সুগ্ৰীব যেন খারাপ ব্যবহার না করে। তার কাছে এটাই আমার শেষ মিনতি। সে আমাকে সুগ্রীবের সঙ্গে শত্রুতা না করার জন্য সবসময়ই বলত।' এভাবে বলে বালী মৌন হয়ে রইলেন।
স্বামী নাকি বালীকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন,' তুমি কোনো চিন্তা কর না। কারও কোনো অনিষ্ট হবে না। তাই মায়া,মোহ, দুঃখ সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে উত্তমলোকে যাত্রা কর।
হনুমানের মুখে স্বামীর দ্বারা বালীর বধের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। রাবণের অশোক বনের সন্ত্রাসের মধ্যে থেকেও আমি অনুভব করেছিলাম যে স্বামী বালীকে অন্যায় যুদ্ধে বধ করেছেন। বালীর প্রশ্নের উত্তরে স্বামী রামচন্দ্র তাকে বধ করার যে কয়েকটি কারণ দেখিয়েছেন সেগুলি খুবই তুচ্ছ বলে আমার মনে হয়েছিল। হনুমানের মুখে কথাগুলি শোনার সময় আমার মনে কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। বালী যদি ডালের মৃগ হয়, সুগ্রীব ও তাহলে ডালের মৃগ।তাহলে একজন ডালের মৃগের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব সম্ভব হল কীভাবে ?বন্য জন্তুর কাছ থেকে স্বামী সদাচার কেন আশা করেছিলেন? বন্যজন্তুর ভ্রাতৃ বধূর সঙ্গে সহবাস করা তো খুবই স্বাভাবিক। অন্য জীবের কথা কী বলব? স্বয়ং রামচন্দ্র আমাকে ভরতের সঙ্গে সংসার করার কথা বলেছিলেন। মৃত্যুমুখী বালী স্বামীর কথায় বিশ্বাস করেছিলেন কিনা আমি জানিনা, কিন্তু বালীর মৃত্যু সম্পর্কে স্বামীর দেওয়া কোনো যুক্তি আমি মেনে নিতে পারলাম না। অবশ্য আমি হনুমানকে আমার মনের ভাব প্রকাশ করি নি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন