টনি মরিসনের স্বর্গ
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
কয়েক বছর আগে টনি মরিসন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত একমাত্র তিনিই আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকা যিনি নোবেল পুরস্কারের দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৮ সনের ১৯ জানুয়ারির ' টাইম' ম্যাগাজিনে টনি মরিসনের বিষয়ে একটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল । সেই প্রবন্ধের মাধ্যমে তাকে সমসাময়িক আমেরিকান লেখকদের ভেতরে অতি উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে তাঁর Beloved নামের উপন্যাসটি। এখানে একটি কথা বলতে পেরে খুব ভালো লাগছে যে বিদূষী অসমিয়া মহিলা এবং আমার বন্ধু ডঃ লক্ষ্মী গোস্বামী তাঁর বাৎসরিক আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে ফিরে আসার সময় আমার জন্য উপহার হিসেবে এনেছিলেন টনি মরিসনের Beloved নামের উপন্যাসটি। টনি মরিসনের একমাত্র এই উপন্যাসটি ছাড়া তাঁর বিষয়ে আমার জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল ওপরে উল্লেখ করা ' টাইম' ম্যাগাজিনের প্রবন্ধটি।
সেই প্রবন্ধটি পড়েই আমি জানতে পারলাম যে ১৯৬৪ সনে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা তিনি মাঝে মাঝে চিন্তা করছিলেন। কিন্তু প্রধানত দুটি কারণে তিনি পুনর্বার বিবাহ করবেন না বলে ঠিক করলেন । প্রথম কারণটি ছিল তাঁর সন্তান দুটি । তাঁর জীবনে একজন নতুন মানুষ স্বামী হয়ে এলে সন্তান দুটির প্রতিক্রিয়া কী হবে তিনি সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তার চেয়ে বড় কারনটা এই ছিল যে তিনি নিজের নিঃসঙ্গতা এবং স্বাধীনতার প্রেমে পড়েছিলেন।I did not want to give up the delight of not having to answer to another person.
কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে টনি মরিসনের একটি সরল এবং অকপট স্বীকারোক্তি। একবার কোনো সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন–' আপনার মতে স্বর্গের সংজ্ঞা কী? জীবনের কী ধরনের অবস্থায় আপনি স্বর্গ সুখ পাওয়া যেন অনুভব করেন ?'... আমার জন্য স্বর্গ হবে একনাগাড়ে নয় দিন কারও মুখ না দেখে কারোর সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে একা থাকার সুযোগ পাওয়া। সম্পূর্ণ একা। কারও প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই, আমার ওপরে কারও কোনো দাবি নেই, আমার যখন যা ইচ্ছা করে তাই পাব... এর চেয়ে অধিক স্বর্গসুখ আর কি আছে? একনাগাড়ে এভাবে চারদিন আমি এর আগেই পেয়েছি, কিন্তু নয়টি দিন কখনও পাইনি। আজ পর্যন্ত পাইনি।
ওপরে যদিও আমি বললাম যে টনি মরিসনের সংজ্ঞা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে, কিন্তু তার সঙ্গে এই কথাটাও যোগ দেওয়া উচিৎ হবে মনে হয় যে এরকম একটি স্বর্গের জন্য আমাকে কিন্তু কখনও হা–হুতাশ করতে হয়নি। তার কারণ হল এই যে এইরকম একটি স্বর্গ আমি অনেক আগেই নিজের জন্য সৃষ্টি করে নিয়েছি। টনি মরিসন বলেছেন যে তিনি একনাগাড়ে চারদিন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছেন, কিন্তু সেই জীবনকে তিনি স্বর্গ বলে মানতে চাননি । একনাগাড়ে এই ধরনের নয়টি দিন পেলেই তিনি স্বর্গসুখ পাওয়া বলে অনুভব করবেন। আমি কিন্তু নিজের জীবন যাপনের এরকম একটি প্রণালী উদ্ভাবন করে নিয়েছি যে মাসের ত্রিশ দিনের মধ্যে পঁচিশ দিনই বা দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তেইশ ঘণ্টাই আমি কেবল নিজেকে নিয়ে বেঁচে থাকি বা অধিক শুদ্ধ করে বলতে গেলে নিজের কাজকে নিয়েই বেঁচে থাকি । আর যেহেতু আমার সমস্ত কর্ম এবং চিন্তার কেন্দ্রে বিরাজ করছে মানুষ – সেই জন্য আমি কখনও নিজেকে মানব বিদ্বেষী নিঃসঙ্গতা বিলাসী মানুষ বলে ভাবি না। আমি মানুষের সঙ্গও খুব ভালোবাসি। মানুষের সঙ্গ আমি কতটা প্রাণভরে উপভোগ করি সে কথা আমাকে খুব কাছ থেকে দেখা প্রতিটি মানুষই জানে। কিন্তু তা বলে কৃত্রিম ভদ্রতার দাবিতে আমি আমার কাজের সময়টুকু কোনো মানুষকে আড্ডার জন্য দিতে রাজি নই । চিন্তাশীল পন্ডিত জেকব ব্রনৌস্কি মানুষের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন যে মানুষ হল এক ধরনের সামাজিক নিঃসঙ্গ প্রাণী। মানুষের এই সংজ্ঞাটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি সামাজিক নিঃসঙ্গ প্রাণী হওয়ার জন্য সব সময় চেষ্টা করে থাকি। আমার সমাজ লাগবেই, কিন্তু সেই সমাজের মধ্যেও আমার যখন ইচ্ছে যায় তখনই আমি হতে পারব নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন । কেবল তখনই চিন্তা করা এবং কাজ করাটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে ।
কিন্তু সমস্ত মানুষই আমার মতো ' অভদ্র', কঠোর এবং ভাগ্যবান নয়; হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ আমি আমার ঘনিষ্ঠ এবং বিশেষ স্নেহ ভাজন একজোড়া স্বামী-স্ত্রীর কথা বলি। সম্প্রতি গুয়াহাটির অনেক জায়গায় গড়ে ওঠা অ্যাপার্টমেন্ট কলোনিগুলির কোনো একটিতে তারা থাকে। দুজনেই চাকরিজীবী, মহিলাটি আবার ভালো লেখিকা। চাকরির জন্য দিনের আট ঘণ্টা সময় দেওয়া ছাড়াও লেখার জন্য তাকে দিনে কম করে তিন ঘন্টা সময় দিতে হয়। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য এই যে যে কলোনিতে তারা থাকে সেই কলোনির বেশিরভাগ বাসিন্দা হল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার, কর্মচারী । চাকরি থেকে অবসর নেওয়া অসমিয়া মানুষ ঘরে ঘরে আড্ডা দেওয়া ছাড়া করার অন্য কোনো কাজ খুঁজে পায় না । তাদেরই আড্ডা প্রীতি এবং অন্যের সুবিধা অসুবিধার প্রতি চরম উদাসীনতার বলি হয়েছেন এই প্রতিভাবান স্বামী স্ত্রী। লেখাপড়া করার জন্য সময় পাওয়া দূরের কথা, অনাহুত এবং অবাঞ্ছিত অতিথির উৎপাতে তারা ক্ষণিকের জন্য অবসর গ্রহণেরও সময় পায়না। সময় নেই,অসময় নেই,সবসময়ই অতিথির উৎপাত। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ঘরে পা রেখেছেন মাত্র আড্ডা দেবার জন্য ওত পেতে থাকা অতিথি এসে হাজির। চাকরি করা সমস্ত দম্পতি অন্তত রবিবারের দিনটি নিজেদের জন্য আলাদা করে পেতে চায়। ফ্রী একটিমাত্র দিনে কিছু ভালোমন্দ খেয়ে বিশ্রাম নিতে পারলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলি কঠোর পরিশ্রম করার জন্য দেহ আর মনে শক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের অসমিয়া সমাজের নিয়ম-কানুন অদ্ভুত । চাকরিজীবী দম্পতিকে রবিবারেও ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম না দিতে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রবিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অতিথি– যেন অন্যের জীবনের কাজ করার সময় এবং সুখ-শান্তি হরণ করা ছাড়া অসমিয়া মানুষের অন্য কোনো কাজ নেই। বোধহয় অসমিয়া মানুষের এই নিষ্ঠুর স্বভাবের কথা কোনো ভাবে জানতে পেরে জাঁ পল সাত্রে তার একটি রচনায় লিখেছিলেন–The hell is other people!
আমার মনে এরকম একটি ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে প্রভাবশালী অসমিয়ারাও নিজের প্রতিভার অনুপাতে কাজ করতে না পারার একটি প্রধান কারণ হল অনাহূত এবং অবাঞ্ছিত অতিথির উৎপাত এবং অন্যের সুবিধা অসুবিধার প্রতি চরম উদাসীনতা।
---------
লেখক পরিচিতি- ১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন