বিদেহ নন্দিনী~ ২৯
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(২৯)
হনুমান স্বামী রামকে কতটা শ্রদ্ধা ভক্তি করত সেকথা আমি তার বক্তব্যের মধ্যে আভাস পেয়েছিলাম। রামের সঙ্গে প্রথম দর্শনের কথা বলার সময় হনুমানের চোখ জলে ভরে উঠেছিল ।দুই হাত বুকের উপরে রেখে চোখ দুটি বুজে স্বামীর নাম স্মরণ করে সে প্রথম সাক্ষাতের কথা বর্ণনা করেছিল।
হনুমান সুগ্রীব এবং অন্য বাঁদরেরা স্বামী রাম এবং লক্ষ্মণকে ঋষ্যমূক পর্বতের পাদদেশে প্রথম দেখেছিল। দুজনেরই হাতে তীর ধনুক এবং তরোয়াল দেখে বাঁদররাজ সুগ্রীব নাকি প্রথমে ভয় পেয়েছিল। কে জানে তারা হয়তো কিষ্কিন্ধার রাজা বালীর কোনো গুপ্তচর। যদিও সুগ্রীব নাকি ভালো করেই জানত যে দাদা বালী তাকে আক্রমণ করার জন্য ঋষ্যমূক পর্বতে কখনও আসবে না কারণ সেই পর্বতে মাতঙ্গ মুনির আশ্রম । সেই অঞ্চলে পা রাখলেই নাকি বালীর মৃত্যু হবে বলে মাতঙ্গ মুনির অভিশাপ রয়েছে। তথাপি রাম লক্ষ্মণকে দেখে সুগ্ৰীব দাদার গুপ্তচর বলে অনুমান করে ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল। হনুমান তাকে সাহস দিয়ে বলেছিল-'হে মহারাজ, আপনি বালীর এখানে প্রবেশ নিষেধ জেনেও কেন এত ভয় পাচ্ছেন? অল্পতেই ভয় পেয়ে মনের উদ্বিগ্নতা, চঞ্চলতা প্রকাশ করে বাঁদর জাতির অস্থির স্বভাবকে প্রকাশ করছেন। আপনাকে এই অঞ্চলের সবাই বাঁদর রাজা বলে মেনে নিয়েছে । সে রকম ক্ষেত্রে যদি আপনি নিজেই এত ভয় পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েন,তাহলে বাকি বাঁদরদের অবস্থা কী হবে ?
হনুমানের কথা শুনে সুগ্রীব নাকি কিছুটা সুস্থির হয়ে সেই দুজন কে তা জেনে আসার জন্য তাকে পাঠালেন।
হনুমান ভাবল যদি সে বাঁদরের রূপে গিয়ে সাক্ষাৎ করে হয়তো তাকে কোনো গুরুত্ব দেবে না ।তাই সে নাকি তখনই একজন তপস্বীর বেশ ধরে রাম লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা করে বলেছিল-' হে বীরদ্বয়,আপনারা বল্কল পরিধান করলেও দেখে বড় পরাক্রমী রাজকুমার যেন মনে হচ্ছে। কিছু ব্রত পালন করছেন বলে মনে হচ্ছে। রাম লক্ষ্মণের চেহারা দেখে নাকি বিস্মিত হনুমান দুজনেরই দেহের সৌন্দর্য স্পষ্ট কন্ঠে সুন্দর ভাষায় বর্ণনা করে পুনরায় বলেছিল -'আপনারা কে জানার জন্য আমি এখানে এসেছি। প্রকৃতপক্ষে আমি একজন বাঁদর।নাম হনুমান। আমার পিতা পবন দেবতা এবং মাতা অঞ্জনা। এই স্থান সুগ্রীব নামের একজন বাঁদরের অধিপতির বাসভূমি। আমি সেই ধর্মাত্মা সুগ্রীবের মন্ত্রী হনুমান। রাজা সুগ্ৰীবকে তার দাদা বালী নানাভাবে উৎপীড়ন করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি তাঁর পত্নী রুমা বালীর কবলে। সুগ্রীবের আদেশ অনুসরণ করে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। যদি ইচ্ছা করেন ধর্মাত্মা সুগ্রীবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে পারেন।'
স্বামী রামচন্দ্র নাকি হনুমানের স্পষ্ট কথাবার্তা এবং ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে মিত্রতায় সম্মতি জানাল। হনুমান পরমানন্দে দুজনকে কাঁধে উঠিয়ে রাজা সুগ্ৰীবের কাছে নিয়ে গেল।
রাজা সুগ্রীব নাকি রাম লক্ষ্মণের আগমনে আনন্দ লাভ করে সম্ভাষণ জানিয়ে বলল-' হে প্রভু রাম আমি হলাম বাঁদর আর আপনি জীবশ্রেষ্ঠ নর । তথাপি আপনি আমার সঙ্গে মিত্রতা করতে চাওয়াটা আমারই সৌভাগ্য। তাই আমি আমার দিক থেকে মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দিলাম। এভাবে বলার পরে নাকি দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করলেন।সুগ্ৰীব নাকি তার আসনের কাছে শাল গাছের ডাল ভেঙ্গে এনে আসন তৈরি করে স্বামী রামচন্দ্রকে বসিয়ে বললেন- 'হে মিত্র আজ থেকে আমরা দুজন দুজনের সুখ দুঃখের সমভাগী হব।'
হনুমান ও নাকি চন্দন গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে এনে আসন তৈরি করে লক্ষ্মণকে বসাল। স্বামী নিজের পরিচয় এবং বর্তমানে কী উদ্দেশ্যে এখানে এসে পৌঁছেছেন সেই সমস্ত দুঃখের কথা বিশদভাবে বলতেই সুগ্রীব নাকি ভেতর থেকে একটা পুঁটলি এনে স্বামীকে দেখিয়ে বললেন যে-' একদিন হঠাৎ আকাশ পথ থেকে একজন নারী এই পুঁটলিটা তাদের কাছে নিচে ফেলে দিয়েছিল। নারীটি হা রাম হা রাম বলে আতুর হয়ে চিৎকার করছিল। তারা নাকি নিচে থেকে দেখে অনুমান করেছিল যে নারীটিকে কোনো রাক্ষস গায়ের জোরে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। স্বামী নাকি আমার চাদরের আঁচলে বাঁধা অলংকার দেখে শোক করতে লাগলেন।হনুমান এবং লক্ষ্মণ তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রকৃতিস্থ করে তুলল।
তারপর স্বামী রামচন্দ্র সুগ্রীবের বিষয়ে জানতে চাওয়ায় সুগ্ৰীব বলল-' হে আমার মিত্র রাঘব,আমার দুঃখের সীমা নেই। আমি অতি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা বালী আমার শত্রু ।আমার পত্নী রুমাকে গায়ের জোরে কেড়ে নিয়েছে। আমাকে বধ করার জন্য সুযোগ খুঁজছে। তাই আমি প্রাণের ভয়ে এখানে পালিয়ে এসেছি। হে প্রভু, আমি আপনার একান্ত সেবক।আপনাকে আমাকে বালীর কাছ থেকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমার আপনার কাছে প্রার্থনা। স্বামী নাকি তখনই সুগ্ৰীবকে কথা দিলেন যে তার পত্নীকে গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়ার জন্যই বালিকে বধ করবে।
স্বামী দুই ভাইয়ের মধ্যে কীসের জন্য এতটা শত্রুতা তা জানতে চাইলে সুগ্রীব পুনরায় বললেন- 'এর আগে আমাদের দুজনের মধ্যে খুব মিল ছিল।এখন শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। একদিন একটি মায়াবী নামের দৈত্য কিস্কিন্ধা নগরের তোরণে দাঁড়িয়ে তর্জন গর্জন করে বালীকে যুদ্ধে আহ্বান করে। একজন স্ত্রীর জন্য বালী এবং মায়াবীর মধ্যে শত্রুতা ছিল। সেই সময়ে বালী ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ জেগে উঠে তার ক্রোধ হয় এবং মায়াবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে বের হয়ে আসে। আমরা সকলেই তাকে বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু বালীকে যুদ্ধে যেতে দেখে আমি ওর পেছন পেছন গেলাম। মায়াবী আমাদের দুই ভাইকে একসঙ্গে দেখে পালালো। বালী আর আমি তাকে অনুসরন করলাম। কিছুদূর যাবার পরে দৈত্যটা একটা প্রকাণ্ড গুহার ভেতরে ঢুকে গেল। বালী 'একে আজ বধ করে ছাড়ব' বলে দৈত্যটাকে অনুসরণ করলেন। যাবার সময় সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাকে গুহার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। এভাবে অনেকদিন পার হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ গুহার ভেতরে গর্জন শুনতে পেলাম। তার কিছুক্ষণ পরেই গুহার মুখ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে আসছে দেখে আমি বুঝতে পারলাম মায়াবীর হাতে বালীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমার মনটা দুঃখে ভরে উঠল।
কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকার পরে আমার ভয় হল হয়তো দৈত্যটা গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে মেরে ফেলবে। তাই আমি দৈত্যটা যাতে বেরিয়ে আসতে না পারে, সেভাবে গুহার মুখটা একটা বিশাল পাথর দিয়ে বন্ধ করে কিস্কিন্ধায় ফিরে এলাম। বালীর মৃত্যুর খবরটা আমি কিন্তু আর কাউকে জানাইনি। পরে মন্ত্রীরা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারল যে বালী আর নেই। এদিকে রাজাহীন রাজ্য বিপদজনক।তাই প্রত্যেকে আমাকে নিয়ম অনুসরণ করে রাজ সিংহাসনে বসাল। অনেকদিন পরে হঠাৎ একদিন বালী এসে উপস্থিত হল। আমি রাজ সিংহাসনে বসে ছিলাম দেখে প্রচন্ড ক্রোধে প্রথমেই আমার মন্ত্রীদের বন্দি করল। আমাকে কেন গুহার মুখটা বন্ধ করে চলে আসতে হল সে কথা বারবার বোঝানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম।-' আমি সেই কাজটা ইচ্ছা করে করেছিলাম বলে ভেব না।আমাদের কপাল ভালো যে তুমি ফিরে এলে। এখন তোমার রাজ্য তুমি নাও।আমি আগের মতোই তোমার সেবক হয়ে থাকব। কিন্তু দাদা বালী আমার কথা না শুনে গালিগালাজ এবং তিরস্কার করে আমার সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিল। কথাটা বলে সুগ্রীব চোখের জল ফেলতে লাগল।
স্বামী রামচন্দ্র নাকি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন -' হে মিত্র সুগ্রীব, তোমার শোক সম্বরণ কর। আমি নিশ্চয় তোমার উপকার করব। সুগ্রীব স্বামীকে বিশ্বাস করেছিল ঠিকই কিন্তু রামের পরাক্রমের ওপরে তার নাকি সন্দেহ জন্মেছিল। কারণ সুগ্রীব দাদা বালীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বীর যে এই সংসারে থাকতে পারে, তা ভাবতেই পারেনি। তাই নাকি দুজনকে বারবার বালীর পরাক্রমের কথা বর্ণনা করছিল। এমনকি স্বামীর বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ্য আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ভেবেছিল। মাত্র স্পষ্ট করে কথাটা বলতে পারছিল না। স্বামী আর লক্ষ্মণ নাকি সুগ্রীবের মনের ভাব বুঝতে পেরেছিল। তাই লক্ষ্ণণ হেসে জিজ্ঞেস করল-' বল তো মিত্র দাদা কী কাজ করে দেখালে বালীকে বধ করতে পারবে বলে তোমার বিশ্বাস হবে?'
সুগ্রীব নাকি তখন দাদা বালির পরাক্রমের কথা বর্ণনা করে কয়েকটি শাল গাছ দেখিয়ে বলেছিল যে বালী এই সাতটা শাল গাছ তীর মেরে ভেদ করতে পারে। এখন রামচন্দ্র যদি এভাবে বাণ মেরে শালগাছ কয়েকটি ভেদ করে দেখাতে পারে তাহলে সে নিশ্চিন্ত হবে আর যুদ্ধে বালীকে পরাজিত করতে পারবে বলে বিশ্বাস করবে।সুগ্রীবের কথা শুনে স্বামী নাকি তার মনের সন্তুষ্টির জন্য তার দুর্জয় ধনুটা তুলে নিয়ে টংকার দেয়। তারপর একটা বাণ জুড়ে শালগাছ গুলির দিকে নিক্ষেপ করে। চোখের নিমেষেই বাণ এক এক করে সাতটি শাল গাছ ভেদ করে পুনরায় সেই বাণ স্বামীর তূনে এসে প্রবেশ করে। এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে সুগ্রীব নাকি স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। তারপর নাকি সে স্বামীকে প্রণাম জানিয়ে বলেছিল,-'হে পরমপুরুষ আমার মনে আর তিলমাত্র সন্দেহ নেই। আপনি শুধু বালী কেন, সমস্ত জগৎ কে জয় করতে পারবেন। আমাকে উদ্ধার করা কার্যে সুগ্রীব যাতে সম্পূর্ণরূপে মনোবল, বাহুবল নিয়োগ করতে পারে তার জন্য স্বামী নাকি প্রথমেই সুগ্রীবের কাজটুকু করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। তাই তারা খুব দ্রুত কিস্কিন্ধা যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন