টমাস মান
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ -বাসুদেব দাস
মহৎ লেখকের মহৎ গ্রন্থ মানুষের জন্য অন্তহীন প্রেরণা আর সান্ত্বনার উৎস।হৃদয়ের অন্ধকার মুহূর্তগুলিতে শিক্ষিত মানুষ একমাত্র মহৎ লেখকের রচনার মধ্যেই আশ্রয় নিতে চায়,আশার আলো এবং জীবনের অর্থ পেতে চেষ্টা করে। শোপেনহাওয়ার বলে গেছেন যে একটা শতাব্দীতে মাত্র দশ বারোটা মহৎ গ্রন্থ রচিত হয়।সেই শোপেনহাওয়ারের স্বদেশবাসী টমাস মান বিংশ শতাব্দীর সেরকমই একজন মহৎ লেখক।টমাস মানের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৫ সনে।এই বছর সমগ্র সভ্য জগত তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী পালন করছে।আমরা অসমিয়ারা অসমিয়া লেখক ছাড়া অন্য কোনো লেখকের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করি না।কিন্তু মহৎ লেখকের মহৎ সাহিত্য কোনো একটি বিশেষ দেশ বা একটি বিশেষ জাতির একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।তা সমগ্র মানব জাতির সামগ্রিক উত্তরাধিকার।আমরা আজকাল কথায় কথায় বিশ্বসাহিত্যের কথা বলি।কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের ধারণাও প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন টমাস মানের অন্য একজন স্বজাতি মহাকবি গ্যেটে। গ্যেটের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত টমাস মানের রচনাবলীও প্রকৃতার্থে বিশ্ব-সাহিত্য রূপে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। কাল-চেতনা,ইতিহাস,মানবজাতির সাংস্কৃতিক উত্তর্রধিকার -এই সবই ছিল টমাস মানের সাহিত্য সৃষ্টির মূল বিষয়বস্তু। আধুনিক ইউরোপের আত্মাকে বোঝার জন্য টমাস মানের রচনাবলীর অধ্যয়ন অপরিহার্য। এই মহৎ লেখকের প্রথম জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে সমগ্র সভ্য জগতের আমরাও তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।
টমাস মান মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে ‘বাদেনব্রুক্স’নামের একটি উপন্যাস লিখে একজন শীর্ষস্থানীয় ইউরোপীয় লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল একটি অভিজাত জার্মান পরিবারের কয়েক পুরুষের উত্থান পতনের ইতিহাস।এই উপন্যাসে তিনি জার্মানির আত্মার সন্ধান করেছিলেন।কিন্তু ১৯২৪ সনে প্রকাশিত তাঁর ‘ডি ম্যাজিক মাউন্টেন’নামের উপন্যাসের লক্ষ্য হল ইউরোপের সমাজ এবং সভ্যতার বিশ্লেষণ।উপন্যাসের নায়ক হান্স কেষ্টরপ নামের একজন জার্মান যুবক।যক্ষ্না রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি সুইজারলেণ্ডের একটি স্যানেটোরিয়ামে আশ্রয় নিয়েছেন।স্যানেটোরিয়ামে মাত্র তিনমাসের জন্য থাকতে এসে তাকে থাকতে হল সুদীর্ঘ সাত বছর।কিন্তু আসলে সেই স্যানেটোরিয়াম ছিল একটি সময়হীন জগৎ।বাইরের ব্যস্ত জগতের সময়-চেতনার সঙ্গে স্যানেটোরিয়ামের মৃত্যুমুখী রোগীদের সময় চেতনার কোনো মিল নেই।মৃত্যু,হতাশা এবং অন্যান্য ধ্বংসকারী শক্তি সমূহ মানুষের জীবনের ওপরে কীভাবে ক্রিয়া করে,সেটা দেখানোটাই ছিল টমাস মানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।হান্স কেষ্টরপ স্যানেটোরিয়ামের রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে নিবিড়ভাবে অন্যান্য রোগীদের জীবন নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।সেখানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল একজন রাশিয়ান সুন্দরীর, একজন জার্মান ডাক্তার, একজন মনোবৈজ্ঞানিক, একজন ইটালিয়ান ঐতিহাসিকের– আর এদের প্রত্যেকেই হানস কেষ্টরপের মানস চোখের সামনে এক একটি নতুন অপরিচিত জগত উন্মোচিত করে দিল। এভাবে তার চেতনা নিজের ক্ষুদ্র ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে এক বিশাল বিস্তৃতি লাভ করল। জীবনের বিকাশের পথ রুদ্ধ করতে যাওয়া দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশা এবং মৃত্যু হয় জয় করে মানুষ কীভাবে নিজের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে এই শিক্ষা তিনি লাভ করলেন। অবশেষে তিনি সুস্থ হয়ে জীবনের কর্তব্যের সম্মুখীন হওয়ার জন্য ফিরে এলেন। অনেক সমালোচকের মতে কেষ্টরপ হলেন জীবনের প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে অবিরামভাবে যুদ্ধ করা চিরন্তন মানবাত্মার প্রতীক। মানুষের আত্মবিকাশের সাধনা চিত্রিত করাটাই টমাস মানের উদ্দেশ্য। অন্যদিকে, উপন্যাসটিতে বর্ণিত স্যানেটোরিয়াম সমসাময়িক ইউরোপের প্রতীক। কিন্তু এই উপন্যাসে টমাস মানের বাণী হল আশার বাণী। তাঁর জীবন দর্শনে নৈরাশ্যের কোনো স্থান নেই।
' ম্যাজিক মাউন্টেন লেখার সময় টমাস মান গ্যেটে এবং টলস্টয়ের রচনার সঙ্গে পরিচিত হন, আর ইউরোপের এই দুজন মহান লেখক তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। গ্যেটের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের জোসেফ এবং তার ভ্রাতৃদের কাহিনিকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরীক্ষা করে চারটি উপন্যাস লেখেন।১৯২৯ সনে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। জার্মানিতে হিটলার এবং নাজীবাদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বদেশ পরিত্যাগ করে প্রথমে সুইজারল্যান্ড এবং পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে শুরু করেন।
টমাসমান তাঁর প্রথম উপন্যাসে বর্ণনা করেছিলেন একটিমাত্র পরিবারের অবক্ষয় এবং ধ্বংসের কাহিনি। 'ম্যাজিক মাউন্টেন 'এ তিনি বর্ণনা করেছেন একটি সমগ্র সমাজ– ইউরোপের সমাজ এবং সভ্যতার অবক্ষয়ের কাহিনি। জোসেফ ভ্রাতৃবৃন্দের কাহিনী কে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাস চতুষ্টয়ে টমাস মান অন্বেষণ করার চেষ্টা করেছেন মানুষের সৃষ্টি- রহস্য, মৌলিক সত্তার এবং জীবনের লক্ষ্য। এভাবে টমাস মান তাঁর উপন্যাসে সমগ্র মানব সভ্যতাকে তাঁর লেখায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তার সমস্ত উপন্যাসের প্রধান নায়ক হল মানুষ, যে মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্তরে স্তরে পুঞ্জীভূত হওয়া সংস্কৃতির মধ্যে অবিরামভাবে জীবনের অর্থ এবং লক্ষ্যের সন্ধান করছে। টমাস মানের রচনার সঙ্গে পরিচিত না হয়ে কোনো সাহিত্যরসিকই বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি এবং আধুনিক মানুষের জীবন জিজ্ঞাসার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে পরিচিত হওয়া বলে দাবি করতে পারে না।
একবার কোনো একজন টমাস মানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–' আপনি কেন লেখেন? মান উত্তর দিয়েছিলেন–' মৃত্যুর ভয়ে,ঈশ্বরের ভয়ে।'
কঠোর পরিশ্রমী লেখক টমাস মান নিজের মনেই নিজের সাহিত্য সাধনায় লেগে থাকার জন্য যে কয়েকটি জিনিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করে ছিলেন– সেগুলি হল' রাতে ভালো ঘুম, ভালো বই, নির্মল বাতাস, মাত্র দুই চার জন বন্ধু এবং শান্তি, শান্তি।'
-------------------
লেখক পরিচিতি- ১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন