বিদেহ নন্দিনী~ ২২
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(বাইশ)
পঞ্চবটী বন ঋষি অগ্যস্থের আশ্রম থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু আমরা ঋষির কথা এতটাই বলছিলাম যে কখন পঞ্চবটী বন পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎ আমাদের পথে এক বিশাল আকৃতির শকুনের মত পাখি দেখতে পেয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। অত্যন্ত বলবান, শক্তিবান পাখিটাকে দেখেই বুঝতে পারলাম এটা কোনো সাধারণ পাখি নয়, কোনো রাক্ষস পাখির রুপ ধরে আমাদের বিপদে ফেলতে চাইছে। তাই আমরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সাবধান হলাম। স্বামী গম্ভীর স্বরে বললেন-‘ আপনি কে?’ বৃহৎ পাখিটা নম্রভাবে সুমধুর কন্ঠে বলল-‘আমি তোমাদের পিতার বন্ধু।’ পিতৃ বন্ধু বলায় আমরা নিয়ম অনুসারে পাখিটিকে সম্মান প্রদর্শন করলাম। তারপর স্বামী বললেন-‘হে পক্ষী শ্রেষ্ঠ, যদি আপনি আমার পিতার বন্ধু তাহলে আপনার পরিচয় বা বংশের বিষয়ে আমাদের বলুন।’
পাখিটা হয়তো আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। তাই নিজের পরিচয় দেবার জন্য এই পৃথিবীতে যারা প্রজাপতির সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়েছিল তাদের একনাগাড়ে বর্ণনা করে শেষে বললেন যে তিনি সূর্যদেবতার সারথি অরুন পুত্র জটায়ু। কথাটা বলে পক্ষীরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর পুনরায় বললেন-‘আমার সম্পূর্ণ পরিচয় তোমাদের সামনে বললাম। যদি ভাব যে এই বনবাসে আমি কোনো কাজে আসতে পারি তাহলে বলবে। আমি নিশ্চয় সাহায্য করব।
এই মহাঅরণ্যে ভয়ংকর রাক্ষসের উৎপাত অত্যন্ত বেশি। তুমি আর লক্ষ্ণণ কোনো কাজে কুটির থেকে দূরে যেতে হলে আমি মহালক্ষ্ণী সীতাকে রক্ষা করতে পারব।’ জটায়ুর কথা শুনে আমার মন মুক্ত হয়েছিল। তাই স্বামী রামচন্দ্র বিনম্রভাবে জানালেন-‘হে বিপদের বন্ধু, আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা বনবাস সম্পূর্ণ করতে পারব না। আজ থেকে আপনি আমাদের সুহৃদ।’
পঞ্চবটি এতটাই বিশাল জায়গা যে আমার মনে যত দুশ্চিন্তা ছিল জায়গাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।গোদাবরী নদী পঞ্চবটির মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। অরণ্যটিতে কাঠ থেকে ঔষধ পর্যন্ত সমস্ত কিছুই পাওয়া যায়। কিছুটা জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিয়ে দেবর লক্ষ্ণণ কুটির তৈরি করার কাজ আরম্ভ করে দিল। অবশ্য স্বামী সব সময় শলাপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে থাকল।
এবারও লক্ষ্ণণ সমস্ত সুখ সুবিধা সম্পন্ন এত সুন্দর একটা কুটির তৈরি করল যে কোনো রাজপুত্র এই ধরনের কুটির তৈরি করতে পারে বলে বিশ্বাস করা শক্ত। পুজো দিয়ে পর্ণকুটিরে বসবাস করতে শুরু করলাম। আমাদের দিনগুলি এত সুন্দর অতিবাহিত হচ্ছিল যে দৈনন্দিন জীবনে আবশ্যকীয় জিনিসের অভাব এবং বনবাস দুঃখের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। প্রতিদিনই শুদ্ধচিত্তে আমরা হোম যাগ-যজ্ঞ পূজা-পার্বণ নিয়মমতো করছিলাম। সমস্ত সময়ে আমরা সৎ কথাবার্তা এবং ধর্মীয় কথা আলোচনা করছিলাম। মাঝেমধ্যে ঋষি মুনিরা আমাদের কুটিরে এসে পরিবেশ পবিত্র করে তুলছিল। অবশ্য তার মধ্যে কখনও আমি এবং লক্ষণ ছোট মা কৈকেয়ীর কথা যে বলছিলাম না তা কিন্তু নয়। তার জন্য স্বামীর কাছ থেকে বেশ কড়া কথা শুনতে হয়েছিল। নির্মল অন্তর ভরতের কথা মনে পড়লে আমার দুই চোখ ভারী হয়ে আসত। ভেবেছিলাম বনবাসে না এলে ভরতের সরলতা, উদারতা, মহানুভবতার সঙ্গে পরিচিত হতে পারতাম না।
একদিন আমরা পঞ্চবটির কুটিরের বাইরে বসে আনন্দের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলাম হঠাৎ একজন রাক্ষসী আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল। প্রথমে আমি রাক্ষসী বলে ভাবি নি। কোনো বনকুমারি বলে ভেবেছিলাম। কারণ মেয়েটি ছিল অপূর্ব সুন্দরী। সাজপোশাকও সুন্দর। রামচন্দ্রের কাছে এসে তার রূপ বর্ণনা করতে লাগল। মেয়েটি বলতে শুরু কর।-হে সুন্দর পুরুষ তুমি কে? তোমার মুখমন্ডল উজ্জ্বল, দুই বাহু বিশাল, চোখজোড়া পদ্মের পাপড়ির মতো, পরনে তপস্বীর বেশ, মাথায় জটা। কিন্তু সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র এবং নারী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। এইদেশ রাক্ষসের দেশ। এখানে তোমরা কী কাজে এসেছ?’
স্বামী ও হয়তো প্রথমে তাকে রাক্ষস বলে ভাবে নি। তিনি সংক্ষেপে আমাদের বনবাসের কথা বর্ণনা করে আমাকে এবং লক্ষ্ণণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমার পত্নী সীতা, ভাই লক্ষ্ণণ। তারপরে স্বামী রাক্ষসীর রূপ যে ভাবে ব্যাখ্যা করে পরিচয় চেয়েছিল তাতে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ছিলাম। স্বামী বলেছিল-‘ তোমার রুপ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। তোমার দেহের প্রতিটি অঙ্গের শোভা নিখুঁত। সাধারণত রূপসী হলেও কিছু না কিছু খুঁত থাকে। কিন্তু তোমার নেই। আমার এমন মনে হচ্ছে তুমি যেন ইচ্ছামত রূপ ধারণ করতে পারা মায়াবী রাক্ষস। সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী বললেন-‘ তুমি ঠিকইধরেছ। আমি মায়াবিনি রাক্ষসী। আমার নাম শূপর্ণখা । আমি অরণ্যে বিচরণ করে বেড়াই।আমাকে দেখলেই জীব জন্তু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা লঙ্কার অধিপতি, তার নাম রাবণ। দ্বিতীয়জন কুম্ভকর্ণ, তৃতীয়জনের নাম বিভীষণ। রাক্ষস কূলে জন্ম যদিও ধর্মকর্মে মতি বেশি। অন্য দুজন ভ্রাতা হল খর এবং দূষণ। খর এই অরণ্যের জনস্থানের অধিপতি। আমার প্রতিটি ভাই প্রতাপী যদিও আমি তাদের উপরে নির্ভর করে চলিনা।এই অরণ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় তোমাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মতো সুন্দর চেহারার লোক দেবতাদের মধ্যে নেই। আমি তোমাকে পতি হিসেবে পেতে চাই। তোমার সীতা নামের পত্মী দেখতে সুন্দর নয়। তোমার সঙ্গে একটুও মানায় না। আমার সঙ্গে তোমাকে মানাবে। এখন সীতাকে এবং ভাই লক্ষ্ণণকে আমি খেয়ে ফেলব। তারপর আমরা দুজন আনন্দে ঘুরে বেড়াব। তোমার ভয়ের কোনো কারণ থাকবে না। শূপর্ণখার কথা শুনে আমার রাগ হল। কিন্তু স্বামী তার কথা শুনে হাসতে লাগল। আমার কথা এভাবে বলার পরেও স্বামীর হেসে উঠায় আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল শূপর্ণখাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। এদিকে তার কথাবার্তায় ফুটে উঠেছিল যে তার মনে পুরোমাত্রায় কামভাব জেগে উঠেছে। স্বামী হাসি ঠাট্টা করে বলল-‘ সুন্দরী তোমার মনের ভাব আমি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। তবে আমি হলাম বিবাহিত পুরুষ। স্ত্রী সঙ্গে রয়েছে। তাতে আবার সে আমার খুব আদরের। আমি তোমার মতো একজন সুন্দরী কারও সতীন হবে তা চাইনা। তাই একটা কাজ কর। আমার ভাই লক্ষ্ণণ কে বল তোমাকে বিয়ে করার জন্য। সে বয়সে ছোট, চেহারা শক্তি বল বিক্রমে আমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তার মধ্যে তার সঙ্গে বর্তমানে কোনো মহিলা নেই। তাকে যদি রাজি করাতে পার খুব ভালো হবে। কামাতুরা শূপর্ণখা এবার লক্ষ্ণণ এর কাছে হাজির হল। লক্ষ্ণণও শূপর্ণখার কথায় মজা পেয়ে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করে বলল-‘হে পরম সুন্দরী, তোমার মতো একজন রূপসীকে দিয়ে আমি দাসীবৃত্তি করাতে চাইনা। আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে দাদা রামচন্দ্রের দাসী হতে হবে। কারণ আমি হলাম তার দাস। আমি দাদার আজ্ঞা পালন করি। তাই তুমি দাদাকে তোমাকে বিয়ে করার জন্য পুনরায় বল। তুমি ছোট বউ হলেও তোমার যে রূপ পরবর্তীকালে দাদা বৌদিকে ছেড়ে তোমাকে ভালোবাসবে।’ এভাবে শূপর্ণখা কয়েকবার রাম এবং লক্ষ্ণণের কাছে গেল। কামাতুরা শূপর্ণখা আমার উপরে রাগ হওয়া আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সে হিংসুক হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছিল। আমি স্বামীর পাশে বসে থাকাটা শূপর্ণখা সহ্য করতে পারছিল না। এবার সে ক্রোধে গর্জন করে উঠল-‘ রাম, তুমি এই মহিলাটির জন্যই আমাকে বিমুখ করেছ। দাঁড়াও আমি ওকে এখনই ধরে খেয়ে ফেলব। একথা বলে সুন্দরী নারীর ছদ্মবেশ ত্যাগ করে নিজের আসল রাক্ষসী রূপ ধারণ করল। তার চেহারা দেখে আমার প্রাণ ভয়ে শুকিয়ে গেল। মুখটা বৃহৎ, কোনো গড়ন নেই। চোখ দুটো লাল, সমগ্র শরীরের রং কুচকুচে কালো, চুলের রঙ তাম্র বর্ণের, পেটটা ঢোলের মতো। সে খপ করে আমাকে ধরতে যেতেই স্বামীর ফিরে চেতনা ফিরে এল। তিনি তৎক্ষণাৎ শূপর্ণখার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ধমক দিলেন। ধমক খেয়ে শূপর্ণখা থমকে দাঁড়াল। স্বামী লক্ষ্ণণকে বললেন-‘ লক্ষ্ণণ এর সঙ্গে অনেক ঠাট্টা -ইয়ার্কি হয়েছে। এই ঠাট্টা সর্বনাশ ঘটাত। সীতা কোনো মতে রক্ষা পেয়েছে। রাক্ষসীকে এখন শাস্তি দেওয়ার সময় হয়েছে । সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্ণণ তরোয়াল দিয়ে শূপর্ণখার নাক কান কেটে ফেলল। তার নাক কান থেকে রক্তের ধারা বইতে লাগল। আর্তনাদ করে শূপর্ণখা জঙ্গলের দিকে দৌড়ে গেল।
রাম লক্ষণ ভেবেছিল বিপদ দূর হল। আমি কিন্তু সেভাবে ভাবিনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কামাতুরা রাক্ষসীকে নাক কান কেটে শাস্তি দেওয়া উচিত হয় নাই। এই কার্য আমাদের ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে। এদিকে রাক্ষসীর অনেকগুলো ভাই ।ওরা বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য আসবে না কি? এই ধরনের কথা ভেবে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। স্বামী এবং দেবর কে আমার মনের কথা খুলে বললাম। তবে তারা দুজনই আমাকে বোঝালো যে একজন অনার্য মহিলার জন্য আমার এভাবে ভয় পাওয়া অনুচিত। আমি ভাবলাম ত্রিজগৎ কাঁপাতে পারা আমার স্বামী রামচন্দ্র এবং দেবর লক্ষ্ণণ থাকতে এসব চিন্তা কেন করতে যাব?
সেদিন বিকেলে সমস্ত কাজকর্ম করে অবসর যাপনের জন্য আমরা তিনজন পর্ণকুটিরের ভেতরে বসে কথা বলছিলাম। স্বামী বসা থেকে উঠে গিয়ে উঠোনের কোন থেকে দূরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন। তারপর লক্ষ্ণণকে বললেন-‘শূপর্ণখা যোদ্ধ নিয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। রাক্ষসের সঙ্গে বিরোধ শুরু হল বলে মনে হচ্ছে। ‘তুমি বৌদির সঙ্গে থাক। আমি ওদের নিহত করে আসি।এই কথা বলে স্বামী তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা কুটিরের দরজর মুখ থেকে সমস্ত দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চৌদ্দজন ভয়ঙ্কর চেহারার রাক্ষস। সবাইকে দেখে বড় যোদ্ধা বলে মনে হল। শূপর্ণখা তর্জন গর্জন করে দলটাকে বলল-‘ যে এগিয়ে আসছে সেই রাম। এই আমাকে অপমান করার জন্য ভাইকে প্ররোচিত করেছিল। ভেতরে বসে আছে শ্রী রামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্ণণ। দাদার প্ররোচনায় লক্ষ্ণনই আমার অঙ্গচ্ছেদ করেছিল। বসে থাকা মহিলাটি রামের পত্নী সীতা। আমার অঙ্গচ্ছেদ করায় কার্যত তারও সমর্থন ছিল। আজ আমি ওদের রক্ত পান করব। তারপর শূপর্ণখা স্বামী রামচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলল-‘আমার পরাক্রমী ভাই খর জনস্থানের অধিপতি। আমাকে অপমান করার জন্য তোদের বিনাশ করার উদ্দেশ্যে আমার তত্ত্বাবধানে চৌদ্দজন বীরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ তোদের মৃত্যু নিশ্চিত। স্বামী বিশেষ ভুমিকা না করে সোজাসুজি বললেন-‘যদি বেঁচে থাকতে চাস এখনই আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। না হলে আমার হাতে তোদের প্রাণ যাবে ।‘ চৌদ্দ জন বীর রণধ্বনি করে হাতে শূল নিয়ে এগিয়ে এসে স্বামীর দিকে নিক্ষেপ করল। স্বামী ক্ষিপ্রগতিতে বাণ মেরে ওদের প্রতিটি শূল খণ্ড-খণ্ড করে ফেললেন। তারপরে তীক্ষ্ণ বাণের দ্বারা কিছুক্ষণের মধ্যেই চৌদ্দ জন রাক্ষসকে নিপাত করলেন। শূপর্ণখা প্রাণ নিয়ে পালাল।
এই ঘটনার দুদিন পরে পুনরায় পঞ্চবটি বনে রাক্ষসের রণধ্বনি পুনরায় শোনা গেল । শূপর্ণখা দ্বিতীয়বার অপমানিত হওয়ায় ভাই খরকে নাকি তিরস্কার করে বলল যে তার রাজ্যে রাম নামের একটি মানুষ তার চৌদ্দ জন বীরকে মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করেছে। বোনের কথা শুনে খর নাকি ক্রোধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং ভাই দূষণের সঙ্গে চৌদ্দ হাজার সৈন্য দিয়ে আমাদের আক্রমন করতে পাঠায়। রাক্ষস বাহিনীর রণধ্বনি অনেক দূর থেকে আমাদের কানে আসে। এবার স্বামী গম্ভীরভাবে লক্ষ্ণণ কে বলেছিলেন-‘ভাই বেশ বড় রকমের যুদ্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য চিন্তা করার কিছু নেই। আমরা জয়ী হব। তবু বিপদে যাতে না পড়তে হয় তার জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা ভালো। তাই তুমি অস্ত্রশস্ত্র গুলি সঙ্গে নিয়ে সীতার সঙ্গে কোনো একটি গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। আমি আবশ্যকীয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হই। লক্ষ্ণণ কিছু একটা বলতে যেতেই রামচন্দ্র বললেন-‘যুদ্ধ আমি করব। আমি জানি তুমি অনায়াসে রাক্ষস শত্রু নিধন করতে পারবে। তবুও এই যুদ্ধটা আমি করব। এখানে তোমার কোনো ধরনের আপত্তি খাটবে না।’ তারপরে স্বামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন জানকী তুমি লক্ষ্ণণের সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হও। সে তোমাকে রক্ষা করবে ।বিন্দুমাত্র দেরি না করে তুমি এখান থেকে চলে যাও।’
আমার অন্তর হাহাকার করতে লাগল। এই সংকট কালে স্বামীকে শত্রুর মধ্যে ছেড়ে আমরা আত্মরক্ষার জন্য যাব কোন যুক্তিতে। এদিকে না গেলেও হবেনা। আমি সঙ্গে না থাকলে লক্ষ্ণণ দাদার সঙ্গে সমানভাবে যুদ্ধ করতে পারত। আমার জন্যই লক্ষ্ণণকে বন্দি অবস্থায় থাকতে হল। সেদিন আমার প্রথমবারের জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থার উপরে রাগ হয়েছিল। নারীকে দুর্বল করার জন্য। শারীরিক গঠনের জন্য নারী পুরুষের চেয়ে কিছুটা দুর্বল সেটা আলাদা কথা। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন পুরুষের সঙ্গে সমানে অস্ত্রশস্ত্র চালনার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না। আমার সেদিন নিজেকে তাদের উপর বোঝা বলে মনে হচ্ছিল। আমি যেতে অসম্মত হয়ে স্বামীকে বলেছিলাম, 'লক্ষ্ণণ আপনার সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করুক। আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না। কিছুই হবে না। কিছু ঘটলেও এখানে ঘটুক। কিন্তু স্বামী আমার কথা মানলেন না। অভয় প্রদান করে তিনি এক প্রকার কঠোর আদেশ দিয়েই আমাকে যেতে বাধ্য করলেন। স্বামীকে একা ফেলে অস্থির মন নিয়ে আমাকে চলে যেতে হল। চলে যেতে বাধ্য হলাম। সেদিন একটা কথা আমাকে বিরক্ত করছিল। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীকে কথা দিয়েছিলাম, জীবনে মরনে একসঙ্গে থাকব। কিন্তু এখন এরকম একটি মুহূর্ত এসেছে, স্বামীকে শত্রুর সামনে ফেলে আমাকে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে হচ্ছে। সেই সময় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করে বলেছিলাম -'হে দয়াময় তুমিই এই সমস্ত কিছু করাচ্ছ, স্বামীকে তোমার কাছে সঁপে দিয়ে গেলাম। তোমার সন্তানকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় কর। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার। আমিও লক্ষ্ণণ এরকম একটি জায়গা আবিষ্কার করে নিলাম যেখান থেকে যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও শত্রু আমাদের দেখতে পাবে না।
কিছুক্ষণ পরে স্বামীর ধেনুর প্রচন্ড টংকার শুনতে পেলাম। সেই টংকারে সমস্ত অরণ্য ধ্বনিত হয়ে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম কবচ পরিধান করে স্বামী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। আমি মনে মনে আবার কল্পনা করলাম একদিকে চৌদ্দহাজার রাক্ষস সেনা অন্যদিকে একমাত্র ধনুর্ধর রামচন্দ্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাক্ষস সেনা ঝাঁকে ঝাঁকে তীর মারার দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। প্রথম অবস্থায় স্বামীর বাণে প্রখরতা ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার ধেনু থেকে তীক্ষ্ণ শর বৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে লাগল।নিরবচ্ছিন্ন ধ্বংসাত্মক তীরগুলি রাক্ষস সেনাকে ক্রমশ ধ্বংস করে যেতে লাগল। প্রায় সমস্ত সৈন্য নিহত হওয়ায় স্বয়ং দূষণ স্বামীর সামনে এসে উপস্থিত হল। দূষণ প্রাণপণ যুদ্ধ করেও টিকে থাকতে পারল না। শেষ পর্যন্ত স্বামীর বাণে দূষণ মৃত্যুকে বরণ করে নিল।
রাক্ষসদের দলে দলে নিহত হতে দেখে জনস্থানের রাক্ষসের অধিপতি শূপর্ণখার দাদা খর নিজেই যুদ্ধ করতে এলেন। খর পরম বিক্রমের সঙ্গে স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুজনের ধেনু থেকে নির্গত শর আকাশ ছেয়ে ফেলল। সেই যুদ্ধ দেখার জন্য দেবতারা জমায়েত হয়েছিল। খরের যুদ্ধের কৌশল দেখে দেবতারা নাকি শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। একবার স্বামী এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতেই খর স্বামীর কবচ আর পোশাক ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। খরের শরে রক্তাক্ত হওয়া স্বামীর দেহ দেখে আমি খুব কেঁদে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত স্বামী মুনি অগ্যস্তের দেওয়া বিষ্ণুর ধেনুতে গুন লাগিয়ে খরকে আক্রমণ করলেন।ছয় বাণে খরের রথ ভেঙ্গে চুরমার করলেন। প্রচন্ড ক্রোধে খর গদা নিয়ে তেড়ে এল। স্বামীর বাণে সেই গদা খণ্ড-বিখণ্ড হল। উপায় বিহীন হয়ে একটা গাছকে উপড়ে নিয়ে খর স্বামীর দিকে তেড়ে এল। স্বামী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ইন্দ্র প্রদত্ত শর জুড়ে খরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে খরের প্রাণবায়ু উড়ে গেল।
সেই সময় একটা ঘটনা ঘটল। স্বর্গ থেকে স্বামীর দেহে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। আর দেবতারা হর্ষধ্বনি করে নেমে এল।ঋষি অগ্যস্থ সহ প্রায় সমস্ত মহামুনিরা এসে স্বামীকে ঘিরে দাঁড়ালেন। আমরাও আত্মগোপন করে থাকা জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের প্রণাম জানালাম। দেবতা গন্ধর্ব প্রত্যেকের আনন্দ দেখে স্বামীর দেহের আঘাত ভুলে গেলাম। আমি স্বামীর রক্তাক্ত দেহে হাত বুলিয়ে দ্রুত বনৌষধির জন্য এগিয়ে গেলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন