ঈশ্বরের ভবিষ্যৎ
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ –বাসুদেব দাস
পৃথিবীতে যতগুলি ধর্ম আছে সেগুলির বহিরঙ্গ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখতে পৃথক পৃথক বলে মনে হলেও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে প্রত্যেকটি ধর্মের মধ্যে সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। মিল থাকা প্রধান বিষয় গুলি হল আত্মার অমরত্ব এবং স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বে বিশ্বাস। ঈশ্বরের প্রশ্নে যে দুটি ধর্ম প্রায় নীরব, সেই বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম ও আত্মার অমরত্ব এবং স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। আসলে আত্মাকে অমর বলে ধরে না নিলে, অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও ব্যক্তিসত্তার কিছু একটা অবশেষ থাকে বলে বিশ্বাস না করলে মানুষের জীবনে ধর্মের প্রয়োজন প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। সেই জন্য মাক্স এবং ফ্রয়েড দুজনেই বলতে চান যে মানুষের মৃত্যু- ভয় তথা মৃত্যুর রহস্যময়তাই হল ধর্মের প্রধান আধার।
আত্মা এবং স্বর্গ-নরকের বাইরেও আর ও একটি কথায় পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের মিল দেখা যায়। সেটা হল এই যে সমস্ত ধর্মের নিজের নিজের তীর্থক্ষেত্র আছে। বিশ্বাসীরা তীর্থক্ষেত্রে যায় পুণ্যার্জনের আশায়, ঈশ্বরের করুণা লাভের আশায়। এমনকি পাপীও যখন তীর্থ দর্শন করতে যায়,সে হৃদয়ের সমস্ত আকুলতা নিয়ে ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করে। কিন্তু ভক্তি বিহ্বল হৃদয়ে ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করে থাকার সময় ঈশ্বর যদি তার ভক্তকে নির্মমভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, তখন এই ঘটনার ব্যাখ্যা কীভাবে করা যায়?
প্রশ্নটি মনে আসছে মক্কায় যাওয়া হজযাত্রীদের তাঁবুতে হওয়া ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে। এই দুর্ঘটনায় তিনশো জনের চেয়েও বেশি হজ যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিলেন। অবশ্য তাদের সকলেরই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়নি। অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে যেখানে সেখানে পালাতে চাওয়া মানুষের ভিড়ের ধাক্কায় । আগুনে জীবন্ত পুড়ে মরাটা যেমন একটা মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা, শত শত মানুষের ভিড়ের চাপে পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে মৃত্যু ঘটা তার চেয়ে কোনো অংশেই কম মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা নয়। মক্কায় এই ধরনের ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা এই প্রথম নয়। মাত্র গত এক দশকের ভেতরে সেখানে এই ধরনের ঘটনা আর ও কয়েকবার ঘটেছে । ভারতে এই ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে। উড়িষ্যার একটি তীর্থক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত ধর্মানুষ্ঠানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শতাধিক পুণ্যার্থী প্রাণ হারিয়েছে।
মানুষ ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে করুণা ভিক্ষা করে থাকার সময় করুনার পরিবর্তে কেন এই ধরনের ভয়ঙ্কর শাস্তি পেতে হয় তার উত্তর নিশ্চয় বিভিন্ন ধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থ গুলিতে রয়েছে । অবশ্য সেসবের উত্তর সমস্ত মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে কিনা সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, দূর বিদেশে তীর্থ করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শত শত পায়ের নিচে চাপা পড়ে মরা মানুষগুলির জীবনের শেষ মুহূর্ত গুলির কথা চিন্তা করে তাদের আত্মীয়-স্বজনের মনে মুহুর্তের জন্য ও একটি প্রশ্ন উদয় হয় না কি– যে প্রশ্ন চকিত একটি মুহূর্তের জন্য জীবনের অর্থ বা অর্থহীনতাকে একটি নতুন রূপে প্রতিভাত করে তোলে?
খুব সম্ভব হয়। কিন্তু সেই প্রশ্নকে তারা বেশি সময় প্রশ্রয় দিতে পারেনা। এই ব্যাখ্যাহীন বিশাল বিশ্ব চরাচরে মানুষ এত বেশি অসহায় যে কিছু একটা বিশ্বাসকে অবলম্বন না করে তাদের পক্ষে জীবনধারণ অসম্ভব। সেই জন্য অনেক মানুষ এখনও স্বর্গ এবং নরকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে । কিছুদিন আগে টাইম-সি এন এন চালানো একটি নমুনা সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৮১ জন মানুষ স্বর্গের এবং ৬৩ জন মানুষ নরকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। শতকরা ৬১ জন মানুষ বিশ্বাস করে যে মৃত্যুর পরে তারা সোজা স্বর্গে যাবে । নরকে যাবে বলে ভাবা মানুষের সংখ্যা একশোর মধ্যে মাত্র একজন।
অবশ্য মানুষের স্বর্গ এবং নরকের ধারণা – এমনকি প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণা ও আর কতদিন স্থায়ী হবে সে কথা বলা কঠিন। বাইবেলে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর নিজের আদর্শে মানুষকে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এখন গ্রহান্তরে বা সুদূর নক্ষত্রপুঞ্জে জীব থাকার সম্ভাবনা ক্রমশ বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। কার্ল সাগানের মতে খুব কমেও এক লক্ষ গ্রহে মানুষের চেয়ে উন্নত জীব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই জীব গুলি দেখতে নিশ্চয় মানুষের মতো হবে। তাহলে ঈশ্বর নিজের আদর্শে মানুষকে সৃষ্টি করেছে বলে এত দিন ধরে গৃহীত হয়ে আসা খ্রিস্ট্রিয় ধারণাটি অবশেষে পরিত্যক্ত হতে হবে না কি? মানুষের কল্পনার ঈশ্বর এতদিন ছিল পৃথিবী কেন্দ্রিক। কিন্তু অনেক বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক ইতিমধ্যেই এই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে মহাকাশের অন্যান্য জায়গাতেও মানুষের চেয়ে উন্নত জীব থাকার অনুমান প্রমাণিত হলে ঈশ্বরের ধারণা এবং সঙ্গে স্বর্গ এবং নরকের ধারণা ও আমূল সংশোধন করতে হতে পারে । চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ যেভাবে খ্রিস্টিয় ধর্ম বিশ্বাস এবং সৃষ্টিতত্ত্বের ভিতে প্রকাণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিল, সেভাবে মানুষের মহাকাশ -গবেষণা এবং অভিযান অদূর ভবিষ্যতে সমস্ত ধর্মকেই অনেক কথা নতুনভাবে ভেবে দেখার জন্য বাধ্য করতে পারে।
-------------
!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন