রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১

নিঃস্বার্থ জ্ঞান সাধনা || হোমেন বরগোহাঞি || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস Basudeb Das

 নিঃস্বার্থ জ্ঞান সাধনা

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস




ইংরেজ ঐতিহাসিক জিএম ট্টেভেলিয়ন পাশ্চাত্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন–' জ্ঞানের নিঃস্বার্থ অন্বেষণই  হল পশ্চিমা সভ্যতার মূল জীবনী-শক্তি।' এর অর্থ হল এই যে পশ্চিমের মানুষ কোনো ব্যক্তিগত পুরস্কার বা প্রতিদানের আশা করে জ্ঞানের সাধনা করে না, তাদের কাছে জ্ঞান লাভই  হল জ্ঞানচর্চার একমাত্র পুরস্কার।

ইলেকট্রিক উদাহরণস্বরূপ আমরা ডেনিস দিদেরোর কথা উল্লেখ করতে পারি। বিশ্ব বিখ্যাত ফরাসি বিশ্বকোষের তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক। প্রথম অবস্থায় তাঁর সহযোগী ছিলেন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ d'Alembert কিন্তু রাজ রোষে  পড়ার ভয়ে একটা সময়ে তিনি দিদেরোর সঙ্গ ছেড়ে দিলেন। ফরাসি বিশ্বকোষের কয়েকটি খন্ড দিদেরোকে একাই সম্পাদনা করতে হল। অষ্টম খন্ড ফরাসি বিশ্বকোষের ভূমিকাতে দিদেরো লিখেছেন–' বিশ্রাম কী জিনিস বুঝে উঠার আগেই আমাদের জীবনের গত কুড়িটা বছর পার হয়ে গেল। কার ও কাছ থেকে ধন্যবাদ বা পুরস্কার আশা না করে আমরা দিনের পর দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছিলাম, রাতগুলি উজাগরে  থেকে আমাদের প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল নিন্দুকের ঈর্ষা বহন করে আনা দুর্যোগের কথা ভেবে। আমাদের উপরের যেকোন সময়ে নেমে আসতে পারে আক্রমণের ভয়ে আমরা অনেকবার এমন একটি সম্ভাবনার কথা বল চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিলামঃ আমরা নিজেদের পরিবার, বন্ধুবর্গ এবং দেশ বাসী থেকে বিদায় নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাব নাকি? কিন্তু আমরা আমাদের দেশকে ভালোবেসে ছিলাম এবং সব সময়ই এই আশা করেছিলাম যে আমাদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা বৈরিতার অবসান ঘটবে এবং আমরা নিশ্চয় সুবিচার পাব। হে আমার দেশবাসী এবং বন্ধুরা, আপনারা যত কঠোর ভাবেই আমাদের কাজের বিচার করুন না কেন, কিন্তু আপনারা এক কথা নিশ্চয়ই জানবেন যে যে একমুঠো  মানুষ বিশ্বকোষ প্রনয়নের কাজ টা হাতে নিয়ে তা সম্পূর্ণ করেছে, তারা নিজের মত এবং আদর্শের জন্য সমাজ থেকে বহিস্কৃত এবং লাঞ্চিত হয়েছে, সত্যের প্রতি অবিচল অনুরোধ ছড়া তারা কারও কাছ থেকে কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা পায়নি, তিন চার জন ব্যবসায়ী মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সামান্য অর্থ সাহায্য ছাড়া তারা আর কার ও কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পায়নি।'

এই ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করে ডেনিস দিদেরো ফরাসি  বিশ্বকোষের সম্পাদনা করা ছাড়াও তিনি নিজে একা ১,২৫১ টি বিষয়ের প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধ গুলির জন্য সংগ্রহ করা তথ্যগুলি যাতে নির্ভুল হয় তা সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। তার উদাহরণ হিসেবে মাত্র একটি কথা বললেই যথেষ্ট হবে। তাকে যখন ফরাসি বস্ত্রশিল্পের বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে হয়েছিল তখন বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানার জন্য তিনি নিজে কয়েকটি কাপড়ের কলে কাজ করেছিলেন।

অবশ্য উপরের কথা থেকে এরকম একটি ধারণা করলে ভুল হবে যে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় যতগুলি বিশ্বকোষ লেখা হয়েছে তার প্রত্যেকটি ফরাসি বিশ্বকোষের মতো বৈপ্লবিক এবং যুগান্তকারী ঘটনা বলে পরিগণিত হয়েছে। ফরাসি বিশ্বকোষের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান ধারণার ওপরে ভিত্তি করে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র , যাজকতন্ত্র এবং মধ্যযুগের কুসংস্কার টিকে ছিল, সেই ধ্যান ধারণার অবসান ঘটিয়ে মানুষের মন যুক্তিবাদী চিন্তা এবং আধুনিক মানব তন্ত্রী আদর্শের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। সেইজন্যই ফরাসি রাজতন্ত্র এবং যাজকতন্ত্রের সঙ্গে ফরাসি বিশ্বকোষ বাদীদের প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়েছিল।

এক বিশেষ ঐতিহাসিক পটভূমিতে ফরাসি বিশ্বকোষের যে বৈপ্লবিক ভূমিকা ছিল সেই একই ভূমিকা অন্য বিশ্বকোষ গুলি দাবি করতে পারে না। এখন বিশ্বকোষ বললে আমরা যে জিনিসটা বুঝি তাহল সমগ্র মানবজাতির পুঞ্জিভূত জ্ঞানের সার–সংগ্রহ। পৃথিবীতে যত জ্ঞাতব্য বিষয় আছে সেই সমস্ত বিষয় গুলির  তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়ের গুরুত্ব অনুসারে দীর্ঘ বা ছোট প্রবন্ধ লিখে যে বইতে সন্নিবিষ্ট করা হয় তাকেই বিশ্বকোষ বলা হয়। এই তথ্য সংগ্রহের কাজটিও অতি সহজ হয়ে পড়েছে, কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় ইতিমধ্যে অসংখ্য বিশ্বকোষ লেখা হয়েছে। জাতির মাতৃ ভাষায় লিখিত বিশ্বকোষ গুলি বর্তমান যুগে লোক শিক্ষার একটি প্রধান মাধ্যম বলে পরিগণিত হয়েছে। ভারতের সমস্ত প্রধান ভাষাতেই এক  বা একাধিক বিশ্বকোষ রয়েছে। নেই কেবল অসমিয়া ভাষায়। মাতৃভাষায় বিশ্বকোষ থাকলে ইংরেজি বা অন্যান্য বিদেশি ভাষা না জানা মানুষেরাও সেই বিশ্বকোষের সাহায্য নিয়ে নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। বর্তমান যুগকে তথ্য বিস্ফোরণের যুগ বলা হয়ে থাকে। গ্রামেগঞ্জে বাস করা সাধারণ মানুষকেও রেডিও, টেলিভিশন এবং খবরের কাগজের মাধ্যমে প্রতিদিন নতুন শব্দ শুনতে হয়। পাশের সরকারি গ্রন্থাগারে যদি অসমিয়া বিশ্বকোষ থাকে , তাহলে মানুষ সেখানে দৌড়ে গিয়ে বিশ্বকোষ খুলে নিয়ে নতুন নতুন বিষয়ের জ্ঞান আহরণ করতে পারে। একুশ শতকের যে নতুন সমাজ সৃষ্টি হবে তা হবে Knowledge based Society, অর্থাৎ সেই সমাজের ভিত হবে জ্ঞান। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার করায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে মাতৃ ভাষায় রচিত বিশ্বকোষ।

অসমিয়া ভাষায় বিশ্বকোষ অসমের শিক্ষিত সমাজের সামনে একটি বিশাল  প্রত‍্যাহ্বান হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বৌদ্ধিক কেন্দ্র এবং সংস্থা হাতে নেওয়া বিশ্বকোষ অভিধান এবং সাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদি প্রণয়নের কাজ অর্ধ সমাপ্ত করে রেখে ফেলে রাখতে হয়েছে অসমিয়া শিক্ষিত সমাজের আলস্য এবং অসহযোগিতার জন্য । এর ফলে জাতিটার মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছে । বড় কাজ করার জন্য যে ধরনের আত্মবিশ্বাসে প্রয়োজন তার অভাব দেখা দিয়েছে । প্রস্তাবিত অসমীয়া বিশ্বকোষের দুটি খন্ড যদি আমরা নির্দিষ্ট সময়ে প্রণয়ন এবং প্রকাশ করে বের করতে পারি তাহলে সেই হারানো আত্মবিশ্বাস আমরা বহু পরিমাণে ফিরে পাব। এই বিভাগে এর আগে এইচ জি ওয়েলসের কথা লেখা হয়েছিল ।তিনি হাজার হাজার বই পড়ে এবং সেইসবের সারসংগ্রহ করে মাত্র এক বছরের ভেতরে লিখে ফেলেছিলেন সাড়ে চার লক্ষ শব্দের বিশ্ব ইতিহাসের রূপরেখা ।আজ ডেনিস দিদেরোর উদাহরণ উত্থাপিত করা হল। এই সমস্ত লোকের নিঃস্বার্থ জ্ঞান-তপস‍্যা এবং শ্রম সহিষ্ণুতার আদর্শ অনুসরণ করতে পারলেই আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সভ্য জাতিগুলির মধ্যে নিজের আসন দাবি করতে পারব ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...