বিদেহ নন্দিনী~১৯ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Basudeb Das
(উনিশ)
ভরতেরা চলে যাবার পরে আমার কোনো কিছুতেই মন বসছিল না। চার পাশটা কেমন যেন খালি খালি লাগছিল। আমাদের ঘর কেমন যেন শূন্য হয়ে পড়েছিল। চারপাশে নির্জন একটা পরিবেশ বিরাজ করছিল। এই কয়েকদিন শাশুড়ি দেবর ,জা এবং অযোধ্যাবাসীর ভালোবাসার মধ্যে ডুবে গিয়ে আমরা অরণ্যের মধ্যে ও স্বর্গীয় শান্তি লাভ করেছিলাম। একদিন স্বামী তাদের দুজনের মধ্যে আমাকে বসিয়ে বলেছিল –‘জানকী, তোমার কেমন মনে হচ্ছে আমি জানিনা। আমাকে কিন্তু এই জায়গা বিরক্ত করে তুলছে । মাতা-ভ্রাতা এবং অযোধ্যাবাসী সবাই চলে যাবার পরে তাদের স্মৃতি আমাকে বড় বেশি করে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।তাই এই জায়গা ছেড়ে আমরা অন্য জায়গায় যাওয়াটা সমীচীন হবে বলে মনে করছি।’
লক্ষ্ণণ তার কথায় সায় দিয়ে বলল-‘ ঠিকই। আমাদের তো এক জায়গায় বনবাস পর্বটা কাটাতে হবে সেরকম কোনো নিয়ম নেই।বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ালে তবেই জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বাড়বে।’
তাদের কথা সমর্থন করে আমিও বললাম-‘ অন্য জায়গায় গেলে খুব একটা খারাপ হবে না। তারমধ্যে ভরতের শোভাযাত্রায় আসা হাতি ঘোড়ার গোবর-জাবরও জায়গাটিকে অপরিষ্কার করে তুলেছে।’ স্বামী ও আমার কথায় সায় দিলেন।
আমরা চিত্রকূট ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময়ই সেই অঞ্চলটিকে ছেড়ে ঋষি মুনি সবাই অন্য একটি বনাঞ্চলে যেতে শুরু করেছিল। স্বামী রামচন্দ্র ঋষিদের হঠাৎ চিত্রকূট ছেড়ে যাবার কারণ জানার জন্য ঋষিদের কুলপতির কাছে গেলেন। ঋষি কুলপতি জানালেন যে সুখে থাকতে শুরু করার পর থেকেই লঙ্কার রাজা রাবণের ছোট ভাই খর নামক দস্যুটির উৎপাত বেড়েছে । অনেকঋষি তপস্বীকে সে বধ করেছে। তার দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে ঋষিদের শান্তিতে হোম যজ্ঞ পূজা-পার্বণ করতে দেয় না। খর এবং তার সঙ্গীরা যজ্ঞের অগ্নিতে হাড়- মাথা, রক্ত মাংস ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যজ্ঞস্থলকে অপবিত্র করে তোলে। কখনও কলস ফুটো করে জল ঢেলে যজ্ঞের আগুন নিভিয়ে দেয়। কখনও চুপি চুপি আশ্রমে লুকিয়ে থেকে কোমল বয়সের তপস্বীদের অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে বধ করে। তাই এই জায়গায় থাকাটা সমীচীন হবে না বলে অন্য জায়গায় যাবার কথা ভেবেছি। ঋষি কুলপতি স্বামীকেও এই জায়গা ত্যাগ করার উপদেশ দিলেন। যদিও আমার স্বামী রাক্ষস বধ করতে সক্ষম তবু একজন মহিলার সঙ্গে এই জায়গায় থাকাটা উচিত নয়।
ঋষিকুলের আপত্তির কথা শিরোধার্য করে এবং আমাদের অনবরত খারাপ লেগে থাকা মনের পরিবর্তন হওয়ার জন্য একদিন আমরা সেই জায়গা পরিত্যাগ করে অত্রি মুনির আশ্রমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ঋষি অত্রির আশ্রমে পা দিয়েই নিজেকে ধন্য মনে করলাম। গাছ লতা ফুল সমগ্র আশ্রম টাকে জাঁকজমক করে তুলেছিল।আশ্রমের পশুপাখিরাও জ্ঞানী এবং অন্তর্যামী বলে মনে হয়েছিল। আমরা তিনজন প্রণাম জানালাম। মহর্ষি অত্রি, তার পত্মী মহাতপস্বিনী মাতা অনুসূয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা তার চরণ স্পর্শ করলাম। মাতা অনুসূয়া নামটির মতোই নির্মল চিত্তের হিংসাশূন্য, অন্তরের। ঋষি পতি পত্নীর তিনজন পুত্র। তারা হলেন দত্ত,সোম এবং দুর্বাসা। এককালে যে ঋষি মাতা অনুসূয়া সুন্দরী ছিলেন সে কথা তাকে দেখলেই অনুমান করা যায় ।
মাতা অনুসূয়া মহর্ষি অত্রির চেয়ে কিছু বেশি বার্ধ্যক্যের কবলে পড়া বলে মনে হয়েছিল। তার চুল সম্পূর্ণ রূপালী এবং চামড়া কুঁচকে গিয়েছিল। কিন্তু মুখের জ্যোতি তখনও অটুট ছিল। চলাফেরা ঠিকমতো করতে পারছিলেন না। কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছল। কিন্তু তার তপ শক্তি বিন্দুমাত্র হ্ৰাস হয়নি। আমি ঋষি মাতার তপশক্তি দেখে অবাক হয়ে যাওয়ায় মাতা অনুসূয়া বলেছিলেন-‘ জানকী, এখানকার অরণ্য গুলিতে রাক্ষসের উৎপাত বড় বেশি। যদি এখানকার ঋষি মুনিরা অপবিত্র কাজে লিপ্ত হয় অথবা তপশক্তি হ্রাস হয়ে থাকে তখন রাক্ষসরা নানা বিধ দুর্ভোগ সৃষ্টি করা ছাড়াও বধ করার সুযোগ পায়। তপোবলে বলীয়ান তপস্বীদের দুষ্ট বুদ্ধি নাশ করতে পারে না।
তারপরে ঋষি মাতা আমাকে তার কাছে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিলেন। মাতা অনুসূয়া আমার অতীতের কথা জানার বড় আগ্রহ দেখানোয় আমি সংক্ষেপে আমার জন্ম বৃত্তান্ত, বিবাহ, বধু হিসেবে আমার জীবন এবং বনবাসের কথা বললাম। আমার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের কথা শুনে মাতা অনুসূয়া অভিভূত হয়ে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন-‘ মা তোমার জন্ম এবং বিবাহের বৃত্তান্ত শুনে আমি বড় আনন্দ অনুভব করছি। তোমার কণ্ঠস্বর এবং ভাষা আমার কানে অমৃত বর্ষণ করছে। তারপর ঋষিমাতা আমার রূপ গুণের প্রশংসা করে বলেছিলেন-‘ মাতা বৈদেহী, তোমার রূপ গুণ কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়। বল্কল বসন তোমার সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। আমার অনেক সুন্দর অলঙ্কার এবং দিব্যবস্ত্র আছে। যে সমস্ত পরিধান করলে তোমাকে তুলে ধরবে। আমি একবার তোমাকে একবার সেই রূপে দেখতে চাই।’ এই কথা বলে তিনি নিজের অলংকার, বস্ত্র এবং প্রসাধনের ভান্ডার আমার সামনে মেলে ধরলেন। মাতা অনুসূয়া পুনরায় বললেন-‘ মা, তুমি এই বস্ত্র, অলংকার পরিধান করে রাঘবের শোভা আরও বর্ধন কর। এই ধরনের সাজপোশাক, প্রসাধন এবং দিব্য অলংকার তোমাকে বিষ্ণুর কাছে লক্ষীদেবী যেমন, রাঘবের কাছে তোমাকেও সেরকম দেখাবে। এখন এই সমস্ত পোশাক পরিধান করে আমাকে দেখাও।
ঋষি মাতার ইচ্ছা পূরণ করাটা আমার কর্তব্য। কিন্তু হঠাৎ এই ধরনের সাজ পোশাক পরতে কিছুটা সংকোচ এবং লজ্জা হল। কে জানে স্বামী রাম এবং দেবর লক্ষণ যদি আমাকে ভুল বুঝে। বল্কল বসন পড়ে বিরক্ত হয়েছি বলে আপনার কাছ থেকে অলংকার চেয়ে নিয়েছি বলে ভাবে। কথাটা মনে মনে ভাবতে ভাবতেই মাতা অনুসূয়া আমার গলায় একটা হার পরিয়ে দিলেন। উপায় বিহীন হয়ে আমি সেই জাঁকজমক পরিপূর্ণ পট্ট বস্ত্র এবং অলংকারে সজ্জিত হয়ে মাতা অনুসূয়ার সামনে দেখা দিলাম। ঋষিমাতা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন- মা, বৈদেহী, বিকেল হতে চলেছে। পাখ-পাখালি বাড়ি ফিরে আসছে। মহর্ষিরও যজ্ঞের সময় হল। তুমিও এই সাজেই রাঘবের শোভাবর্ধন কর গিয়ে। আমি মাতা অনুসূয়াকে প্রণাম জানিয়ে স্বামীর কাছে এলাম। স্বামী এবং দেবর হঠাৎ আমাকে এইরূপে দেখে অবাক হওয়ার সঙ্গে আনন্দ পেল। আমি মাতা অনুসূয়া দেওয়া সমস্ত জিনিস এক এক করে তাদেরকে দেখালাম। আমাকে ভুল না বোঝার জন্য দুজনকে ধন্যবাদ জানালাম।
আমরা মহর্ষি অত্রির আশ্রমে সেই রাত বড় আনন্দে কাটালাম। পরের দিন সকালে ঋষি অত্রি,মাতা অনুসূয়া, তপস্বী, ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তারা আমরা কোন পথে বিপদ না ঘটিয়ে এগোতে পারব সেই সম্পর্কে উপদেশ দিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন