মেরুদণ্ড সোজা রাখার প্রয়োজন
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
মেরুদণ্ড সোজা রাখার ওপরে দৈহিক স্বাস্থ্য অনেক পরিমাণে নির্ভর করে।অজ্ঞতা বা দুর্বলতার জন্য যে সমস্ত লোক মেরুদণ্ড বাঁকা করে রাখে ,তাঁরা অকালে বুড়ো হয়।কিন্তু দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্য মেরুদণ্ড সোজা করে রাখা যতটা প্রয়োজনীয়,নৈতিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তা হাজারগুণে বেশি প্রয়োজনীয়।
এক প্রকারে দেখতে গেলে মানুষের ইতিহাস হল মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টার ইতিহাস। একসময় মানুষ ছিল অন্যান্য ইতর জন্তুর মতো একটা চতুষ্পদী জন্তু মাত্র। যখনই সে দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে মেরুদণ্ড সোজা করতে শিখল,তখন থেকেই সে মানুষ হতে আরম্ভ করল। তবুও তো সমাজের বেশিরভাগ মানুষের জন্য মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ সোজা করে রাখাটা সম্ভব হল না। মাত্র কয়েকজন শক্তিমান মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াল,বাকি লক্ষ কোটি মানুষ যুগের পরে যুগ,শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে তাঁদের সামনে নতজানু বা ভূ-লুণ্ঠিত হয়ে পড়ে রইল। কীভাবে কত বেশিসংখ্যক মানুষের মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ সোজা করে দাঁড়াতে সমর্থ করা যায়,যুগ যুগ ধরে সেটাই হয়ে আসছে ইতিহাসের সাধনা। কারণ যে মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না ,সে কখনও সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারে না । মানুষের সমাজে বহুযুগ ধরে চলে আসা অসমতা কেবল আর্থিক বা সামাজিক অসমতা নয়,মেরুদণ্ডের ঋজুতা বা বক্রতা সৃষ্টি করা অসমতা বহুগুণে বেশি ব্যাপক,বহুগুণে বেশি অশ্রদ্ধেয়। আর্থিক বা সামাজিক শ্রেণি-বৈষম্য নির্মূল করতে পারি,বহুদেশে ইতিমধ্যেই তা করা সম্ভব হয়েছে,কিন্তু আর্থিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হলেই যে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক দাসত্ব থেকেও মুক্ত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেইজন্যই আমরা অহরহ চোখের সামনে দেখতে পাই-নিজেকে সমাজের বড় মানুষ বলে জাহির করা অনেক ধনী ,মানী এবং ক্ষমতাশালী মানুষও নানা লোভ –মোহের বশবর্তী হয়ে কথায় কথায় শক্তিমানের কাছে নতজানু হয় বা এত বেশি মেরুদণ্ড বাঁকা করে দাঁড়ায় যে সামান্য ধাক্কা দিলেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। এই সমস্ত লোকেরা ভুলে যায় যে মানুষ মাথা তুলে অন্য একজন মানুষের মুখের দিকে তাকাতে পারে না ,তাঁর চোখ যায় কেবল পায়ের দিকে। অন্যের পায়ে যার দৃষ্টি সদায় নিবদ্ধ,সে বুদ্ধি,ক্ষমতা এবং ধন বৈভব ইত্যাদি সমস্ত সম্পদের অধিকারী হলেও মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ মানবিক মর্যাদাবোধ এবং নৈতিক মহত্ত থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এই ধরনের মানুষ অন্যের আতঙ্কের কারণ হতে পারে ,কিন্তু সে কখনও কারও শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না।
আমাদের দেশে সম্প্রতি মানুষের দারিদ্র্য দূর করে জীবন ধারণের মান উন্নত করাটাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু জীবন ধারনের মান উন্নত করাটাই একমাত্র কাজ নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে quality of life অর্থাৎ জীবনের গুণগত উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টাও করে যেতে হবে। জীবনের গুণগত উৎকর্ষ কেবল আর্থিক নিরাপত্তা বা সমৃদ্ধির ওপরে নির্ভর করে না। সেটা হলে সমাজের সবচেয়ে ধনী মানুষই সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় এবং সংস্কৃতিবান মানুষ হতেন। কিন্তু তা যে হয় না,তা নিশ্চয় কারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই।
জীবনের গুণগত উৎকর্ষ-সাধন কেবল,শাসক,রাজনৈতিক নেতা এবং অর্থনীতিবিদের কাজ নয়। সেই কাজের আসল দায়িত্ব নিতে হবে শিল্পী,ভাবুক এবং বুদ্ধিজীবীদের। তাঁরা যদি মানুষকে নৈতিক সাহস,মহত্ত এবং সৌন্দর্যবোধের শিক্ষা দান করে,তখন সমাজে মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের উপযোগী অনুকূলের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা যে ভারতবর্ষে শতাব্দী প্রাচীন সামন্তবাদের শিকড় উপড়ে ফেলে মানুষকে আর্থিক এবং সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য যতই চেষ্টা চলছে ,ততই এমন কি সমাজের সবচেয়ে বুদ্ধিমান শ্রেণির মানুষের মধ্যেও সামন্তবাদী পরবশ্যতা,মোসাহেবিয়ানা এবং দাস সুলভ মনোভাব দিন দিন বেড়ে চলেছে। একটি মুক্ত মহৎ জীবনের গৌরবে মানুষের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে যাবার পরিবর্তে দিনদিন তা বেঁকে যেতে চলেছে। বলাবাহুল্য মাত্র যে এটা সমগ্র জাতিটার নৈতিক স্বাস্থ্যহীনতার লক্ষণ। সমস্ত দেশে সমস্ত যুগে সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী শ্রেণিটিই মানুষের মনে মুক্তির আকাঙ্খা এবং মানবিক মর্যাদাবোধ বাঁচিয়ে রাখে।কিন্ত যখন সমাজের সেই শ্রেণি মানুষই নিজের ঐতিহাসিক মহৎ ভূমিকার কথা ভুলে গিয়ে খেতাব এবং বকশিসের লোভে মো-সাহেবের দলে নাম লেখানোর জন্য ঠেলাঠেলি করে,তখন সেই সমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তার কারণ ঘটে। আজকের ভারতবর্ষে এমন কতজন কবি,শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবী রয়েছেন –যিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো বলতে পারেনঃ
‘These men, my dear Raj, little understand the heart of a proud, silent, lonely man of song! They regret his want of popularity, while perhaps his heart swells within him in vision of glory –such as they can form no conception of.’
ভারতবর্ষের মানুষ চিরকাল ধরে সাহসের সাধনা করেছে।‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’ বলে ঘোষণা করা উপনিষদের ঋষিদের থেকে শুরু করে গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই দেশের সমস্ত মহাপুরুষই সাহসকেই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ বলে অভিহিত করেছে,মানুষের মেরুদণ্ড সোজা রাখার চেষ্টা করেছে। সেই সাধনার যাতে কখনও বিরাম না ঘটে ,তারজন্য প্রতিটি মুক্তবুদ্ধি চিন্তাশীল মানুষই চিরসজাগ হয়ে থাকা দরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন