লুই আলথুসারের দ্বিতীয় মৃত্যু
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
১৯৯০ সনের নভেম্বর মাসে একটি বিদেশি ম্যাগাজিনে লুই আলথুসার নামের একজন ফরাসি দার্শনিকের মৃত্যুর বিষয়ে একটি ছোট প্রতিবেদন পড়েছিলাম। প্রায় প্রতিদিন এই ধরনের কত কথাই পড়ি- যার বেশিরভাগই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বা একটা সময়ে ভুলে যাই। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির ভান্ডারে এত কথা জমতে শুরু করে যে সেই সমস্ত কথাগুলির জন্য মগজে জায়গার অভাব দেখা দেয়। তখন অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি দরকারি বা প্রয়োজনীয় কথাগুলির জন্য অদরকারি কথাগুলি ভুলে যাবার প্রয়োজন হয়। অবশ্য ভুলে যাওয়া মানে কথাগুলি মগজ থেকে বেরিয়ে যাওয়া নয়। শরীর বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেছেন যে একজন মানুষ যদি সত্তর বছর বেঁচে থাকে , তাহলে তার মগজে সেই সময়ের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ এবং সঞ্চয় করে রাখা যেতে পারে । মানুষ অবশ্য এই অসংখ্য তথ্যের একটা অতি সামান্য পরিমাণ মনে রাখতে পারে বা ব্যবহার করতে পারে। মগজের জমা হয়ে থাকা কিন্তু কাজে না লাগায় তথ্য থাকা বা না থাকা একই কথা। সে যাই হোক না কেন, প্রত্যেক মানুষই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিকে মানুষের স্মৃতিশক্তি কমে আসে এবং মানুষ নিজেও অপেক্ষাকৃত অদরকারি কথাগুলি সচেতনভাবে মগজ থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করে। এরকম অবস্থায় কিছু একটা বিশেষ কথা যদি একজন মানুষের মনে বারবার আসতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে সেই বিশেষ কথাটির কোনো কারনে মানুষটির মনের মধ্যে গভীরভাবে ছাপ রেখে গেছে। উপরে উল্লেখ করা বিদেশি ম্যগাজিনটি ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসারের বিষয়ে লেখা কথাটাও নিশ্চয় আমার মনে গভীর ভাবে ছাপ রেখেছিল, কারণ গত এক বছরে কমেও পঞ্চাশবার আমি সেই কথাটা স্মরণ করেছি এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটা চিন্তা করতে চেষ্টা করেছি।
পৃথিবীর যে কয়েকটি জায়গা জ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র, সেইসবের মধ্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস অন্যতম। সেই প্যারিসে অবস্থিত Ecole Normal Superior নামের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রটি জ্ঞানচর্চার উচ্চমানের কারণে জগদ্বিখ্যাত। ফ্রান্সের রাজনীতি সাহিত্য শিক্ষা দর্শন এবং প্রশাসনে যে সমস্ত লোক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী স্থান দখল করে থাকে তাদের বেশিরভাগই এই কেন্দ্রটির ছাত্র।
প্রায় ত্ৰিশ বছর ধরে এই শিক্ষা কেন্দ্রটির দার্শনিক অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান সঞ্চালক ছিলেন লুই আলথুসার- যার কথা এই প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই না বললেও নিশ্চয় হবে যে ফ্রান্স তথা ইউরোপের বৌদ্ধিক জীবনে লুই আলথুসার দীর্ঘকাল ধরে অতি প্রভাবশালী স্থান দখল করেছিলেন ।ষাটের দশকের বেশিরভাগ ফরাসি বুদ্ধিজীবীর মতো আলথুসার ও ছিলেন মার্ক্সবাদী। । তিনি ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির ও আজীবন সদস্য ছিলেন। মার্ক্সবাদকে তিনি একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করে তার একটি নতুন ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন। আল থুসারের নিজের স্বীকারোক্তি মতেই তার মার্ক্সবাদ ছিল সামাজিক গণতন্ত্র (Social Democracy এবং মানবতাবাদের বিরোধী ।মার্ক্সবাদের আলথুসার দেওয়া ব্যাখ্যা ফরাসি কমিউনিস্টদের বিরক্ত করলেও শিক্ষক এবং দার্শনিক হিসেবে তিনি এত প্রতাপী ছিলেন যে তাকে কেউ ঘাটাতে সাহস করত না । বরং তিনি লেখা প্রতিটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বিপুল আলোড়ন এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল ।
১৯৯১ সনের নভেম্বর মাসে লুই আলথুসারের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। অবশ্য মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি Ecole Normal Superiure দর্শন বিভাগের সঞ্চালক হয়েছিলেন না। তার দশ বছর আগেই তিনি পদচ্যুত হয়েছিলেন কারণ সমগ্র জীবন ধরে চিত্ত-ভ্রংশ (dementia)রোগে ভোগা আলথুসার একদিন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে স্ত্রীর গলা টিপে ধরে হত্যা করেছিলেন ।তা
তাঁর জীবনের শেষ দশটি বছর অতিবাহিত হয়েছিল মানসিক রোগের চিকিৎসালয়ে।
যে মানুষটি একদিন ছিলেন ইউরোপের পন্ডিত শিরোমণি ,যার নতুন মৌলিক ব্যাখ্যা বিংশ শতাব্দীর কেন্দ্রীয় দর্শন মার্ক্সবাদকে একটি নতুন আয়তন দিয়েছিল, তেমনই একজন মানুষের এই ধরনের শোকাবহ শেষ পরিণতি আমাদের স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথিত করে তোলে। কিন্তু তাঁর অন্য একটি মৃত্যু ছিল অধিক শোকাবহ। যে মার্ক্সসবাদের চর্চায় তিনি সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন আর যার দ্বারা সমসাময়িক ইউরোপীয় মানসে তিনি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, সেই মার্ক্সবাদের শিক্ষা ইউরোপের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়াটা তিনি নিজের জীবন কালেই দেখে গেলেন। যে মানুষটি Ecole Normal Superiure এর দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ রূপে ফ্রান্সের জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর কাল ধরে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেছিলেন সেই মানুষটির চিন্তা ধারা এবং পাণ্ডিত্য তার জীবনকালেই এত অসার্থক বলে প্রমাণিত হল যে তাঁর মৃত্যুর ঠিক পরের দিনই তাঁর বিষয়ে Ecole Normal Superiure এর ছাত্রদের জিজ্ঞেস করা একটি প্রশ্নের উত্তরে তারা বলল- লুই আলথুসারের রচনা করা বই পত্র গুলি পড়ার তাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
প্লেটো তার 'রিপাব্লিক'এ এই বলে পরামর্শ দিয়েছিল যে প্রজার মঙ্গল সাধন করার জন্য কেবল দার্শনিককেই রাজ্যশাসনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তার উপদেশ আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করে প্রাচীন গ্রিসে দুই-একটি রাজ্যে দার্শনিককে রাজা করা হয়েছিল কিন্তু তার ফল কী বিষময় হয়েছিল সে কথা ইতিহাসবিদরা তথ্যসহকারে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। পরবর্তীকালে দার্শনিক কে রাজা না বানালেও অন্তত একটি দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে একাধিক রাষ্ট্র স্থাপিত হল। একটি বিশেষ দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই প্রথম এবং সম্ভবত এটাই শেষ। সেই দার্শনিক তত্ত্বটি হল মার্ক্সবাদ। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা এই যে পৃথিবীর যে দৃষ্টিতে ইতিহাসে সর্বপ্রথম বারের জন্য একটা দার্শনিক তত্ত্ব তথা মার্ক্সবাদ ভিত্তিতে এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠল। সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা সেখানে মাত্র একটা শতাব্দীও টিকে থাকতে পারল না।
মার্ক্সবাদ নিরীশ্বরবাদের শিক্ষা দিয়েছিল। ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেছিল কিন্তু কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থা সমাপন হওয়া প্রতিটি দেশের মানুষ পুনরায় ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ দেখাতে শুরু করল। অনেক রাশিয়ান নেতা এখন খোলাখুলিভাবে এই বলে মত প্রকাশ করছেন যে ধর্মকে জোর করে দমন করার চেষ্টা চালানো একটা বড় ভুল কাজ হয়েছে। তা না করলে কমিউনিজমের এভাবে অকালমৃত্যু হত না।
আমি নিজে কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করিনা ।আমার ঈশ্বর কোনো একটি বিশেষ ধর্ম কল্পনা করে নেওয়া ঈশ্বর নয়। তাই ধর্মের হয়ে ওকালতি করা বা ধর্মের প্রত্যাবর্তনকে সম্বর্ধনা জানানোটা আমার উদ্দেশ্য নয় ।কিন্তু তা বলে এই সত্যটাও আমি অস্বীকার করতে পারি না যে আনুষ্ঠানিক ধর্ম নিশ্চয় মানুষের এরকম একটি গভীর এবং রহস্যময় প্রয়োজন পূর্ণ করে যা অন্য কোনো দার্শনিক তত্ত্ব বা পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনা। বাইবেলের এই কথাই বোধহয় শেষ সত্যঃ Man can not live by bread alone।
রাশিয়াতে যুগান্তকারী ঘটনা গুলি ঘটে থাকার সময় কয়েকদিনের জন্য আমি দিল্লিতে ছিলাম। একদিন কথা প্রসঙ্গে একজন পন্ডিত আমাকে জিজ্ঞেস করল 'বরগোহাঞি আপনি কি এখন স্বীকার করেন না যে কার্ল মার্ক্সের চেয়ে আর্নল্ড টয়েনবি বেশি বড় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা?'
আমি তাঁর প্রশ্নের কোনো সোজাসুজি উত্তর দিলাম না। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম-' ঠিকইতো, টয়েনবি কি সারাজীবন ধরে পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস অধ্যয়ন করে অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন নি যে পাশ্চাত্য জগতে কত সাম্রাজ্যের পতন ঘটল,কত রাজা মহারাজা এল গেল , কিন্তু চিরস্থায়ী হয়ে টিকে রইল কেবল যীশু খ্রিষ্ট প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া ধর্ম?'
মানুষের জীবন যেমন নশ্বর ঠিক তেমনই বেশিরভাগ দার্শনিক তত্ত্ব বা সামাজিক ধ্যান-ধারণাও নশ্বর। সেই জন্য মানুষ যে বস্তুকে সযতনে পরিহার করে চলা উচিত তা হল মতান্ধতা। আমিই শেষ সত্যটি জানি , এরপরে আর জানার কিছু বাকি নেই , এই ধরনের মনোভাবই যুগ যুগ ধরে মানুষের ইতিহাস রক্তে লাল করে রেখেছে। রাশিয়াতে কমিউনিজম স্থাপন করার জন্য স্টালিন ত্রিশ লক্ষ দেশবাসীকে হত্যা করেছিল। তাঁর আদর্শনিষ্ঠা ( বা ক্ষমতালিপ্সা) তাকে এরকম এক নির্মম নর রাক্ষসে পরিণত করেছিল যে তার একসময়ের ডানহাত স্বরূপ এবং রাশিয়ার সামরিক গুপ্তচর বাহিনীর প্রধান জেনারেল জান বার্জিনকে স্টালিন কেবল মৃত্যুদণ্ড দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, তার মৃত্যুর ব্যবস্থা করা হয়েছিল অভিনব ভাবে। লুবিয়াঙ্কা কারাগারে বন্দি হয়ে থাকা অবস্থায় জেনারেল বার্জিনের অণ্ডকোষ দুটি (testicles) লোহার গজাল মেরে একটা কাঠে সেলাই করে রাখা ছিল- যাতে তাঁর মৃত্যু হয় তিল তিল করে, মানুষের কল্পনার অতীত যন্ত্রণা ভোগ করে। এই ধরনের পৈশাচিক নৃশংসতার প্রয়োজন হয়েছিল কি কমিউনিজমের স্বার্থে? বা প্রয়োজন হতে পারে
কি অন্য যে কোনো মতবাদের স্বার্থে? যে কমিউনিজমের নামে ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তে রাশিয়ার মাটি রক্তাক্ত করে দেওয়া হল সেই রাশিয়ার মাটিতে আজ কমিউনিজম পরিত্যক্ত। কিন্তু সেই ত্রিশলক্ষ মানুষের নির্মম এবং নিরর্থক হত্যার নৈতিক দায়িত্ব আজ কে নেবে?
যে সমস্ত আদর্শ বা মতবাদের জন্য মানুষ হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, সেই ধরনের বেশিরভাগ মতবাদই ইতিহাসের আবর্জনায় পরিণত হয়। কিন্তু মানুষ তাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। রক্ত দিয়ে হোলি খেলাটাই মানুষের সবচেয়ে প্রিয় খেলা। কিন্তু যে সমস্ত মানুষ অন্যের রক্ত পান করার জন্য বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না তারা নিজের রক্ত দেবার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকা উচিত। পুনরায় বাইবেলের কথা মনে পড়ে-Those who live by the sword will perish by the sword।
-----------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন