একটি প্রশ্ন
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
ডক্টর এড্রিয়েন প্রুস্ত ছিলেন উনিশ শতকের ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। বিপুল ধনসম্পত্তির এবং খ্যাতির অধিকারী ডক্টর প্রুস্তের দুই পুত্র সন্তান মার্সেল এবং রবার্ট। রবার্ট যদিও মার্সেলের চেয়ে দুই বছরের ছোট তবু তার পরিচিতিটাই প্রথম দিয়ে নিচ্ছি। রবার্ট বড় হয়ে পিতার মতো একজন বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক হয়েছিলেন। পিতা যেভাবে The different Forms of the Softening of the Brain নামে মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ লিখেছিলেন ঠিক সেভাবেই রবার্টও লিখেছিলেন The Surgery of the Female Genitalia। রবার্ট ছিলেন অতুলনীয় সুস্বাস্থ্য এবং দৈহিক শক্তির অধিকারী। তার বিষয়ে লেখা একটি রচনা তার দৈহিক পরাক্রমের বিষয়ে নিচে উল্লেখ করা কয়েকটি উদাহরণ আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
একদিন তিনি সিএন নদীর তীর ধরে সজোরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি সাইকেল থেকে ছিটকে পড়লেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক পাঁচ টন কয়লা বহন করে নিয়ে আসছিল। ট্রাকটা রবার্টের উপর দিয়ে চলে গেল। মনে রাখবেন ট্রাকটায় ছিল পাঁচ টন কয়লা। সবাই আশঙ্কা করেছিল যে পাঁচ টন কয়লা বহন করা ট্রাকের চাপে তার হাড়গোড় এবং মাংস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। তিনি বেঁচে থাকবেন বলে কেউ আশা করেনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে রবার্ট হাসপাতাল থেকে ফিরে এল শরীরের কোনো স্থায়ী ক্ষতি ছাড়াই। কয়েক বছর পরের কথা। ইতিমধ্যে তিনি একজন নিপুন শল্য চিকিৎসক হিসেবে বিপুল সাফল্য এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন। একদিন তিনি নিজের মোটরগাড়ি করে কোনো এক জায়গায় যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল ড্রাইভার। ড্রাইভার ঘুমে ঢলে পড়ল। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি এম্বুলেন্স গাড়ির সঙ্গে রবার্টের গাড়ি জোরে ধাক্কা লাগল। রবার্ট গাড়ি থেকে ছিটকে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি কাঠের বেড়ায় পড়ল। তার মাথাটা দুভাগ হয়ে গেল। কিন্তু কেউ খবর পাওয়ার আগেই তিনি নিজে উঠে এসে গাড়িতে বসেন এবং নিজেই গাড়ি চালাতে লাগলেন। রবার্টের অসাধারণ সুস্বাস্থ্য এবং দৈহিক শক্তির প্রমাণ দেবার জন্য এই দুটো উদাহরণই বোধহয় যথেষ্ট।
এইবার আসছি রবার্টের দাদা মার্সেলের কথায়। মাত্র নয় বছর বয়সে মার্সেল দুরারোগ্য হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হয়। অনেকে অনুমান করেন যে মায়ের প্রতি মার্সেলের অত্যধিক আসক্তি ছিল তার হাঁপানির প্রধান কারণ। হাঁপানির আক্রমণ দিনে গড় হিসেবে দশবার হয় এবং প্রতিটি আক্রমণ একঘন্টা ধরে স্থায়ী হয়। তিনি দিনে শোবার চেষ্টা করেন এবং রাতের বেলা জেগে থেকে কাজ করেন। ঘরের বাইরে তিনি খুব কমই যেতে পারেন। তার ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ করে রাখা হয় যার ফলে তিনি সূর্যের আলো কখনও দেখতে পান না। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। আর কোনো ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করতে পারেন না। তিনি দিনে মাত্র একবারই খেতে পারেন। একবারের চেয়ে বেশি খেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হজম শক্তি দুর্বল হওয়ার জন্য তাকে বারবার পায়খানায় যেতে হয়। তার অন্য একটি প্রধান সমস্যা ছিল কোষ্ঠকাঠিন্য। তাকে ঘনঘন জোলাপ নিতে হত। জোলাপ খেলেও আবার তার পেট পাকায়। প্রস্রাব করার সময় তরে এত জ্বালা পোড়া করে যে ত্রিশ বছর বয়সে মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখেছিল-‘মা বাবাকে জিজ্ঞেস কর তো জ্বালাপোড়া ছাড়া তিনি প্রস্রাব করতে পারেন কি না?’
মার্সেলের গায়ের ত্বক এত বেশি স্পর্শকাতর ছিল যে সে কখনও কোনো ধরনের সাবান এবং ক্রিম ব্যবহার করতে পারত না।গা মোছার জন্য তাকে অতিশয় সুকোমল টাওয়েল ব্যবহার করতে হত। প্রতিদিন তার বাইশটি তোয়ালের দরকার হত। তোয়ালে গুলি ধোয়ার জন্য এক ধরনের বিশেষ কাপড় ধোয়ার সাবান ব্যবহার করতে হত। সর্দি জ্বর এবং কাশির হাত থেকে একদিনের জন্য ও মার্সেল রেহাই পায়নি।
তার নাক থেকে সব সময় জল পড়তে থাকত। তিনি নিজে ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন যে একবার একটি তিন পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি লেখার সময় তাকে ৮৩ বার রুমাল দিয়ে নাক মুছতে হয়েছিল। তার কাশির শব্দ আশেপাশের মানুষদের জাগিয়ে দিত।
মার্সেলের অসুস্থতার তালিকাটা এখানেই শেষ হয়নি । তার প্রায়ই জ্বর হত ,দৃষ্টিশক্তি ছিল খুবই ক্ষীণ, খাবার জিনিস গিলতে ত়ার কষ্ট হত, ঘন ঘন তার দাঁতের ব্যথা এবং কোমর ব্যথা হত, প্রায়ই তার মাথা ঘুরত।
৫১ বছর বয়সে মার্সেলের মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর আগের দশটা বছর তাকে অতিবাহিত করতে হয়েছিল বিছানায়-বাতাস প্রবেশ করতে না পারা একটি চির অন্ধকার ঘরে।
মার্সেল বিছানায় শুয়ে শুয়েই লিখে শেষ করেছিলেন ৩৩০০ পৃষ্ঠার A la recherche du temps perdu অর্থাৎ 'হারানো সময়ের সন্ধানে' নামে বিশাল মহাকাব্যিক উপন্যাস। অনুমান করা হয় যে পৃথিবীতে মানুষ যতদিন পর্যন্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কিছু মানুষ এই বইটি পড়বে আর যারা বইটি পড়তে পারবে না তারা বইটির কথা গল্পের মতো শুনবে। মানবমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্রিয়া প্রক্রিয়া চিন্তা অনুভূতি এবং আবেগের বিশ্লেষণ থাকা এই অসামান্য উপন্যাসটি মানব চেতনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্নটি হলঃ মার্সেল এবং রবার্ট- এই দুজন মানুষের মধ্যে আপনি নিজে কোন মানুষটি হতে পছন্দ করবেন?
প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছে এলেন দ্য বটন- তাঁর How Proust can change your life গ্রন্থে।
প্রায় সাত বছর আগে পর্যন্ত আমার বছরে একবার করে-, মাঝে মধ্যে দুবার ও - সর্দি জ্বর হত(আজকালকার ভাষায় Virsl fever) স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে বেশি করে জানার ফলে সর্দি-জ্বর আমার জীবন থেকে বিদায় চেয়েছিল। কিন্তু পরিশ্রমের আতিশয্যের ফলে এক সপ্তাহ আগে আমি প্রায় সাত বছর পরে পুনরায় সর্দি-জ্বরের দ্বারা আক্রান্ত হলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এলেইন দ্য বটনের দুটি বই পড়লামঃThe Consolations of philosophy এবং How Proust can change your life।দ্বিতীয় গ্রন্থে উত্থাপিত হয়েছে এই প্রশ্নটিঃ মার্সেল এবং রবার্ট ফ্রস্টের মধ্যে তুমি কোন জন মানুষ হতে পছন্দ করবে?
প্রশ্নটি ভাবতে ভাবতে আমার শরীর ভালো হয়ে গেল। বই দুটি আমার ঔষধ হল, টনিকও হল। আপনিও প্রশ্নটি চিন্তা করে দেখবেন তো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন