বিদেহ নন্দিনী~১৫ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Basudeb Das
(পনেরো)
মেজ শাশুড়ি সুমিত্রা কথা আরম্ভ করে বলেছিলেন-‘বুঝেছ জানকী, মহারাজ মাত্র শোকে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন। অন্তর দগ্ধ করা শোক না পেলে এত তাড়াতাড়ি মহারাজের মৃত্যু হত না। কী করবে। আমাদের কপালই এমন।’ তারপর তিনি আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে আমরা বনবাসে বেরিয়ে আসার পরে শ্বশুর দশরথের মানসিক অবস্থা কীরকম হয়েছিল তা বর্ণনা করে গেলেন।
পিতা রাজা দশরথ নাকি রাস্তায় বেরিয়ে এসে আমাদের যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় তাকিয়ে ছিলেন। তারপর নাকি তিনি অবশ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। বড় শাশুড়ি কৌশল্যা তাকে ধরে ফেলেন। অন্যদিকে ছোট শাশুড়ি কৈকেয়ী ধরতে যেতেই রাজা উচ্চস্বরে বলে উঠেন-‘ পাপিনী স্ত্রী, আমাকে স্পর্শ করবি না। তুই আমার পত্নী বা বন্ধু কেউ নস। তোর সঙ্গে সম্পর্ক আমার শেষ হল। আমি তোকে ত্যাগ করলাম। যদি ভরত তোর কথায় আনন্দ পায় তাহলে সেও আমার পিণ্ড দিতে পারবে না। রাজার কথা শুনে চাকর বাকরেরা এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে কৈকেয়ীর রাজপ্রাসাদের দিকে নিয়ে যেতে রাজা নাকি আর্তনাদ করে বলেছিল-‘আমাকে ওখানে নিয়ে যেও না। কৌশল্যার কাছে নিয়ে চল। তার কথা মতোই বড় শাশুড়ি কৌশল্যার প্রাসাদে রাজাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রাজাকে শুশ্রূষা করার জন্য মেজ শাশুড়ি বড় শাশুড়ির প্রাসাদে চলে এসেছিল। তা দেখে রাজা নাকি চোখের জল ফেলে দুই পত্নীকে বলেছিলেন-‘ আমার প্রকৃত ভার্যা তোমরা দুজনই। আমাকে এই বিপদের সময় কখনও ছেড়ে যেও না।
সেদিন সারারাত নাকি রাজা ছটফট করছিলেন। মাঝেমধ্যে রাম সীতা বলে নাকি বিকট চিৎকার করে উঠেছিলেন।
সারথি সুমন্ত্র আমাদের বনবাসে রেখে যেদিন অযোধ্যায় ফিরে গিয়েছিলেন, সেদিন নাকি শাশুড়ি কৌশল্যা শোকে বিহ্বল হয়ে সুমন্ত্রের সামনে রাজাকে অন্তর উজার করে বকাবকি করেছিলেন। শাশুড়ির নাকি রাগ হয়েছিল। রাজা সুমন্ত্রের কাছ থেকে আমাদের বিষয়ে সমস্ত শুনেও মৌন হয়ে থাকায় তিনি নাকি রাজাকে বলেছিলেন-‘ আপনার আদেশে মন্ত্রী সুমন্ত্র আমার ছেলেকে বনবাসে রেখে এসেছে। আপনি ওদের বিষয়ে একটি কথা জিজ্ঞেস করলেন না? নাকি কৈকেয়ীর ভয়ে জিজ্ঞেস করছেন না। কৈকেয়ীর ভয়ে জিজ্ঞেস না করে থাকা ঠিক না। কৈকেয়ী এখানে নেই। আপনি হয়তো ছেলে আপনার কথা রক্ষার জন্য বনবাসে গিয়েছে বলে গর্বিত হয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তবে আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকব? এমনিতেই আমার হৃদয় ভগ্ন। তার মধ্যে একমাত্র পুত্রকে আপনার জন্য বনবাসে পাঠাতে হল। আমি আপনার সঙ্গে বিয়ে হয়ে আসার সময় স্বর্গ,মর্ত্য, তীর্থ সুখ-দুখ আকাঙ্ক্ষা সমস্ত কিছুই আপনি বলেই ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে ছলনা করলেন। এখন আপনার যন্ত্রণা দেখলে আমার শোক হালকা হয় না। ভালো করে চিন্তা করলে আমি স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত একজন মানুষ। আপনার ভালোবাসার কৈকেয়ীকে আদর করে বর দিয়েছিলেন।কৈকেয়ীকে মন প্রাণ সবকিছু সমর্পন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কৈকেয়ী বর নিয়ে আপনার এরকম অবস্থা করল কেন? তারপর নাকি মাতা কৌশল্যা বিলাপ করতে শুরু করেন। তিনি নাকি কেঁদে কেঁদে সুমন্ত্রকে বলেন –‘ আমাকে রামের কাছে নিয়ে চল সুমন্ত্র। রাজা জনকের কন্যাকে বধূ করে এনে এখন তাকে যন্ত্রণার জন্য বনে পাঠালাম। আমি এখানে রাজপ্রাসাদে থাকতে পারব না সুমন্ত্র। আমাকে ছেলে বধূর কাছে রেখে এসো গিয়ে।
তখন নাকি সুমন্ত্র তাকে এভাবে বুঝিয়েছিল-‘ আপনি ধৈর্য ধরুন রাণী। রামের মনে কোনো দুঃখ নেই। তিনি ঋষি মুনিদের সঙ্গে কুশলে আছেন। লক্ষ্ণণ দাদা-বৌদির শুশ্রূষা করতে পেরে মনে বড় আনন্দ পেয়েছেন। এবং রাজপ্রাসাদে থাকার সময় যেভাবে প্রতিটি মুহূর্ত রামের জন্য ব্যয় করত তেমনি এখনও সেভাবেই করছেন। সীতা ভয় কাকে বলে জানে না। সে খালি পায়ে কখনও বনে কখনও বালিতে হাঁটার সময় তার চরণ দুটি রক্তপদ্ম পাপড়ির মত লাল হয়ে পড়ে। তারা তিনিও যে কঠোর পুন্যের কাজ করতে গিয়েছেন, সে কথা পৃথিবীতে সব সময় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।তাই আপনি দুঃখ করবেন না।
মেজ শাশুড়ি সুমিত্রা ও নাকি নিজের শোক ভুলে রাণী কৌশল্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল-‘দিদি রামচন্দ্রের মতো গুণবান এবং শ্রেষ্ঠ পুরুষ জগতে নেই। বিদেহ নন্দিনী সীতা কঠোর জীবন যাপন করে স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য নিজের ইচ্ছায় বনে গিয়েছে। আপনি এরকম একজন বধূর শাশুড়ি। তারচেয়ে গৌরবের কথা আর কিছু হতে পারে কি? লক্ষ্ণণ দাদার সঙ্গে থেকে তার অনুগামী হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। রাম লক্ষ্ণণ একসঙ্গে থাকলে কোনো বিপদ ঘটবে না। এরকম মহৎ ঘটনা জগতে কয়টি ঘটে বলুনতো। দেখবেন চোখের পলকে চৌদ্দ বছর পার হয়ে যাবে। তিনি হাসিমুখে আমাদের কাছে চলে আসবেন, তাই আপনি দুঃখ করা অনুচিত।’
সেদিন নাকি রাজা মন্ত্রী সুমন্ত্র, বড় শাশুড়ি কৌশল্যা এবং মেজ শাশুড়ি সুমিত্রার সামনে নিজের দোষ স্বীকার করে বলেছিল-‘হ্যাঁ, সুমন্ত্র, কৌশল্যা ঠিকই বলেছে। আমি খুব বড় অপরাধ করেছি। ছলনাময়ী রানী কৈকেয়ীর কথায় বাধা পড়ে গেলাম বলেই রামকে বনবাসে পাঠানোর কথায় সম্মত হওয়া উচিত হয়নি। যা ঘটে গেছে তা পরিবর্তন করার কোনো উপায় নেই।’ তারপরে নাকি বড় শাশুড়ি কৌশল্যা ওর মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে বলে ছিল কৌশল্যা আমি তোমার কাছে জেনে এবং না জেনে অনেক দোষ করেছি সেই সমস্ত ক্ষমা করে দিও তখন নাকি শাশুড়ি কৌশল্যা রাজার চরণ চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে বলেছিল-‘ হে স্বামী,আমাকে ক্ষমা করুন-‘শোকে দগ্ধ হয়ে আপনাকে অনেক অনুচিত কথা বলেছি।আমি মূর্খ, না জেনে অপরাধ করেছি বলে তিরস্কার করুন। সেদিন নাকি দুজন পতি পত্নী অনেকক্ষণ পর্যন্ত অনেক সুখ দুঃখের কথা বলেছিল। সেদিন নাকি শশুর দশরথ তার যৌবনের একটি ঘটনার কথা দুই রানিকে বলেছিল-‘বুঝেছ কৌশল্যা,শোন সুমিত্রা আমি শব্দভেদী বাণ চালনায় খুব দক্ষ ছিলাম। একবার আমার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য একজন ব্যক্তির মৃত্যু হল। সেই ব্যক্তির বৃদ্ধ পিতা-মাতা আমাকে পুত্রশোকে মৃত্যুবরণ করতে হবে বলে অভিশাপ দিয়েছিল। তাই আমার মৃত্যু অনিবার্য। ঘটনাটা বলে তিনি নাকি অন্তর্যামী পুরুষের মতো বলেছিলেন –‘কৌশল্যা আমার মৃত্যু একেবারে নিকটে। আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি আমাকে একবার স্পর্শ কর তো। তোমার হাতটা আমার দেহে বুলিয়ে দাও।’ রাজার কথামতোই শাশুড়ি নাকি তার দেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। কথাবার্তা বলতে বলতেই রাজা একবার নীরব হলেন। দুজন শাশুড়ি ভাবলেন রাজা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রয়েছেন। তাই দুজনেই রাজার বিছানাতে পায়ের কাছে শুয়ে পড়লেন।
রাজার শয়ন কক্ষের বাইরে প্রতিদিন সকালে স্তুতি প্রার্থনা এবং মঙ্গলাচরণ হয়। তারপরই রাজা শয্যা ত্যাগ করেন। পরের দিন সকালবেলা অন্যান্য দিনের মতোই স্তুতি প্রার্থনা হল। তারপরেও রাজা উঠছেন না। রাজাকে স্নান করানোর জন্য নির্দিষ্ট লোকেরা এসে পড়েছিল। তবু রাজা নিদ্রামগ্ন। যে সকল পরিচারক এবং পরিচারিকার রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশ করার অনুমতি আছে তারা রাজার ঘরে ঢুকে দেখল বিছানায় রাজার পায়ের কাছে দুই রানি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তারা ভাবলেন সারারাত শুশ্রূষা করে শেষ রাতে রানিরা শুয়ে পড়েছেন। রাজার হয়তো খুব ঘুম পেয়েছে তার মধ্যেই একজন রাজাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে বলে মহারাজা আর নেই বলে বিকট চিৎকার করে উঠল। তখনই দুইজন শাশুড়ি জানতে পারলেন যে তাদের স্বামীর প্রাণবায়ু অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দুই রানি পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে।
রাজার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র কোশল রাজ্যে শোকের ছায়া ছড়িয়ে পড়ল। মাতা কৌশল্যা নাকি মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে শুরু করে-‘হে অযোধ্যাবাসী, ‘আপনারা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন না। আমি স্বামীর সঙ্গে সহমৃত্যু বরণ করব। আমার স্বামী এবং পুত্র অবিহনে বেঁচে থাকতে পারব না।’
রাজার তিনশ পঞ্চাশজন পত্নী একসঙ্গে হৃদয় উজার করে কান্নার দৃশ্য নাকি মর্মস্পর্শী ছিল।এরকম দুঃখের দৃশ্য নাকি কেউ কোথাও দেখেনি। রাজসভার মন্ত্রীরা নাকি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য একটি জরুরি সভা আহ্বান করে। এদিকে রাজাহীন রাজ্য বিপদজনক। তাই আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে দ্রুতগামী দূত পাঠিয়ে ভরতকে তক্ষুনি কেকয় রাজ্য থেকে ডেকে আনতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে মুহূর্তের মধ্যে দ্রুতগামী দূতকে কেকয় রাজ্যে পাঠানো হয়েছিল। দূতকে বারবার মন্ত্রীরা সাবধান করে দিয়েছিল যাতে ভুলেও ভরতকে অযোধ্যার দুঃসংবাদ জানানো না হয়। মাত্র জরুরি কিছু কাজের জন্য অযোধ্যায় ভরতের উপস্থিতি আবশ্যক বলে দূতকে শিখিয়ে পাঠানো হয়েছিল। তাছাড়া সমস্ত কথা সহজ এবং সাধারন বলে দেখানোর জন্য রাজপ্রাসাদের নিয়ম অনুসরণ করে যথেষ্ট পরিমাণের উপহার কেকয় রাজ্যে দূতের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল।
এদিকে ভরত এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাজার দেহ নষ্ট হয়ে যাবে বলে এক বৃহৎ তেলের পাত্রে ডুবিয়ে রাখা হল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন