বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১

বিদেহ নন্দিনী~১৪ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Basudeb Das

 

বিদেহ নন্দিনী~১৪ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Basudeb Das


(চৌদ্দ)

বনবাসের দিনগুলি আনন্দেই পার হয়ে যাচ্ছিল। বনবাসেও কারও ব্যস্ততা কোনো অংশে কম ছিল না।  আমি পরিষ্কার পরিছন্নতা বজায় রাখা এবং সকাল বিকেলের খাবার তৈরি করায় খুব ব্যস্ত ছিলাম।  শুরুতে আমি ঘর মোছার কাজটা ভালোভাবে পারতাম না। কুটিরের মেঝেটা এবড়োখেবরো  ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে আমি সেই কাজটা আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম। সকালে লাল মাটি দিয়ে কুটিরের মেঝেবারান্দা এবং উঠোন সুন্দর করে মুছে রেখেছিলাম। স্নান করে পুজোর জায়গা এবং যজ্ঞস্থলী পরিষ্কার করে তিনজন পুজোয় বসেছিলাম। লক্ষ্ণণ প্রতিদিনই উঠোনে খড়ি কেটে জমা করে রাখত। সকালে দুজন দাদাভাই ফলমূল সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে যেত। কাজ থেকে অবসর পেলে আমিও তাদের সঙ্গে যেতাম। স্বামী আমাকে বিভিন্ন গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে প্রতিটি গাছের গুণাগুণ বর্ণনা করত। ঔষধি গুণসম্পন্ন অনেক গাছ আমি পর্ণকুটিরের সামনে লাগিয়েছিলাম। যাতে কেটে গেলে, পুড়ে গেলে জ্বলে যাওয়া জায়গাতে এনে লাগাতে পারি। প্রতিদিন বিকেলে স্বামীর সঙ্গে চিত্রকূট পর্বত এবং মন্দাকিনী নদীর অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতাম। তাই বলে যে আমার অযোধ্যার কথা মনে পড়ত না তা কিন্তু নয়।  শ্বশুর শাশুড়িকে এরকম অবস্থায় ফেলে আসার দুঃখ মনটাকে মাঝে মাঝে ভারী করে তুলত। বিশেষ করে উর্মিলার কথা মনে পড়লে আমি ছটফট করতাম। লক্ষ্ণণ বিহীন জীবন সে কীভাবে কাটাচ্ছে ভাবলেই আমার চোখে জল এসে যেত। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতাম-‘উর্মিলাকে শক্তি দাও প্রভু।’ লক্ষ্ণণ সত্যিই বড় আশ্চর্য ধরনের ছেলে। ভুলেও কখনও উর্মিলার কথা বলে না। আমি ইচ্ছা করে উর্মিলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আড়চোখে তার প্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণ করি। কিন্তু লক্ষ্ণণের কোনো পরিবর্তন আমার চোখে ধরা পড়ে না। দাদাই যেন তাঁর সর্বস্ব। দাদা অবিহনে সে যেন অসম্পূর্ণ। আমি যেহেতু স্বামী রাম এবং দেবর লক্ষ্ণণের জন্ম বৃত্তান্ত জানি তাই দুজনের একাত্মতাকে সমর্থন করি এবং  সহজ ভাবে তা গ্রহণ করি। উর্মিলাও আমার মতো দুজনের জন্মরহস্য জানে যদিও এই একাত্মতাকে সে সহজভাবে নিতে পারে না। কখনও উর্মিলা ক্রোধে অতিষ্ঠ হয়ে লক্ষ্ণণকে আমার সামনে দাদার ভৃত্য বলে বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাই মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে উর্মিলা আমার জন্যই লক্ষ্ণণের দাদার প্রতি আকর্ষণ প্রবল বলে ভাবে না তো? অযোধ্যায়  থাকার সময় কখনও আমি লক্ষ্ণণকে স্বামী রামচন্দ্রের কাছ থেকে সরিয়ে উর্মিলার কাছে পাঠাতাম। তাবলে উর্মিলার প্রতি লক্ষ্ণণের ভালোবাসা নেই সে কথাও কিন্তু ঠিক নয়।

কখনও অনবরত দাদার সঙ্গে লেপ্টে  থাকার জন্য লক্ষ্ণণের উপরে আমারও রাগ হয়। কারণ আমিও তো আমার স্বামীর সঙ্গে কিছু সময় নিরালায় কাটাতে চাই। লক্ষ্ণণ এই কথাটা বুঝতে পারে না। ঠিক সেভাবেই ভরত এবং শত্রুঘ্নের কথা মনে পড়ে। তারা মামার বাড়ি থেকে ফিরে এল কিনা, দাদার বনবাস ভরত কীভাবে নিয়েছে, তার অভিষেক কখন অনুষ্ঠিত হল ইত্যাদি নানা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করে। অবশ্য এই কথাগুলি আমি দাদা ভাইয়ের সামনে উত্থাপন করি না। তারা কথা বললে আমি পাশে বসে শুনি, অংশগ্রহণ করি না, কারণ স্বামী ঘরোয়া কথায় বধূদের মন্তব্য দেওয়াটা সমর্থন করে না। তাঁর মতে একটি মেয়ে একটি বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পরে তার নিজস্ব কোনো মতামত থাকতে পারেনা। স্বামীর মতই তার মত হওয়া উচিত। আমি কথায় কথা বাড়াতে অপছন্দ করি। ঘরোয়া আলোচনায় সব সময় মৌন হয়ে থাকি। তাবলে যে স্বামীকে এই কথাগুলির জন্য খারাপ পাই তাও নয়। আমি বুঝতে পারি যে একজন মানুষ ষোলো আনা শুদ্ধ হতে পারে না। দোষ গুণ নিয়েই মানুষ।

সকালবেলা আমি আলু পোড়ানর জন্য আগুন ধরিয়ে পর্বতের পাদদেশে ফলমূল এবং আলু কচু জোগাড় করে থাকা স্বামীর কাছে গেলাম। হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি  ভয় পেয়ে উড়ে যাবার মতো উড়ে গেল। তারপরে হরিণ,বন্য মহিষ এবং  দুটো হাতির  দল ও একটা বিশেষ দিকে যেতে দেখলাম। স্বামী কান খাড়া করে রইলেন। তারপরে চিৎকার করে ভাইকে বললেন-‘ভাই লক্ষ্ণণ এই শব্দগুলি শুনতে পাচ্ছ কি? মানুষের কোলাহল,জীবজন্তু গুলি  ভয় পেয়ে যেদিকে পারছে পালিয়ে যাচ্ছে। এতদূরে মৃগয়া করার জন্য কোনো রাজা আসবে কি?একবার দেখতো।’ লক্ষ্ণণ দ্রুত একটি  উঁচুগাছে উঠে চারপাশে তাকাল।  তারপর সে উপর থেকেই চিৎকার করে বলল-‘ দাদা উত্তর দিক থেকে এক বিশাল সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে। গজারোহী, অশ্বারোহী এবং পদাতিক সৈন্যের এক চতুরঙ্গ সেনার দল।আপনি আগুনটা নিভিয়ে দিয়ে বৌদিকে ভেতরে যেতে বলুন। আমাদের কবচ পরে তীর-ধনুক নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। 

লক্ষ্ণণের কথা শুনে স্বামী রামচন্দ্র বললেন-‘দাঁড়াও, প্রথমে রথের পতাকাটা কোন দেশের হতে পারে তাকিয়ে দেখ।’ 

লক্ষ্ণণ পুনরায় ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে ক্রোধের সঙ্গে বলল-‘ কার হবে আর? কৈকেয়ী পুত্র ভরত। বুদ্ধি করে রাজপাট হস্তগত করে সে ক্ষান্ত না  থেকে আমাদের দুজনকে বধ করে রাজ সিংহাসন নিষ্কণ্টক করার জন্য এখানে এসে পৌঁছেছে। আমি রথের উপরে কোশল রাজ্যের পতাকা দেখতে পেয়েছি।’ লক্ষ্ণণ গাছ থেকে নেমে এল। ক্রোধে তার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছে। তর্জন গর্জন করে লক্ষ্ণণ বলল-‘দাদা কৈকেয়ী নন্দন ভরত আজ আমার হাত থেকে জীবন্ত ফিরে যেতে পারবেনা। মায়ের রাজ সিংহাসনের লোভ আজ লয় পাবে।  আমাদের আক্রমণ করার জন্য আগে ভরতকে  বধ করলে হত্যার পাপ হবে না। দাদা আজ আপনি এই অরণ্য রক্তে লাল হওয়া দেখতে পাবেন। ভরতের সেনাবাহিনীর মাংস দিয়ে আজ অরণ্যের জন্তুদের উৎসবের  ভোজ হবে।’ 

আমি লক্ষ্ণণের ক্রোধ দেখে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু স্বামী রামচন্দ্র লক্ষ্ণণের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে খুব সাধারণভাবে বললেন-‘ ভাই লক্ষ্ণণ, আমি তোমার শক্তির কথা জানি। তুমি অতি সহজে ভরত এবং তার সৈন্যবাহিনীকে শেষ  করতে পারবে। কিন্তু এরকম করলে আমাদের পিতাকে অমান্য করার সঙ্গে আমরা অপযশ অর্জন করব। আমাদের নিজেদের ইষ্টিকুটুমদের বধ করে লাভ করা রাজ্য বিষযুক্ত আহারের মতো হবে না কি? যে ক্ষমতা এবং সম্পত্তিকে তুমি, আমি, ভরত এবং শত্রুঘ্ন সমানভাবে ভোগ করতে পারিনা সেই ক্ষমতা এবং সম্পত্তিকে আমি কোনো মূল্যই দিই না। আমি বুঝতে পারছি ভরত কেন এসেছে। সে আমাদের অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে। আসলে কি জান ভরত সেদিন অযোধ্যায় থাকলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারত না। সে মায়ের মন পরিবর্তন করে পিতাকে গভীর শোক থেকে উদ্ধার করত। তাই তুমি ভরত সম্পর্কে  এভাবে ভাবাটা ভুল হয়েছে। যদি তোমাকে রাজ্যের প্রতি মোহ নিষ্ঠুর করে তুলেছে তাহলে আমাকে স্পষ্ট করে বল, আমি ভরতকে বললেই সে আনন্দের সঙ্গে তোমার হাতে রাজ্যভার অর্পণ করবে।’

এই বলে রামচন্দ্র কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। স্বামীর কথা শুনে আমার অন্তর ভরে গেল। এদিকে এই বাক্য শুনে লক্ষ্ণণ লজ্জায় মাথা নিচু করল। তারপর সে বলল – ‘হ্যাঁ, দাদা আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। হয়তো পিতা দশরথও আমাদের দেখার জন্য এসে থাকতে পারে। স্বামী বললেন-‘তুমি ঠিকই বলেছ, আমরা বনে কষ্ট পাচ্ছি ভেবে হয়তো তিনি নিজেই আমাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য এসেছেন।’ তারপর লক্ষ্ণণ কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল-‘ তবে মহারাজার শ্বেতবর্ণ রাজছত্রটা  আমার চোখে পড়েনি।’

লক্ষ্ণণের কথায় তখনও সন্দেহের ভাব থাকতে দেখে রামচন্দ্র বিশ্বাস জন্মানোর জন্য বললেন –‘তুমি নিশ্চিন্ত থাক। খারাপ কিছুই হবে না। লক্ষ্ণণ নম্রভাবে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আমরা কিছুক্ষণ  অযোধ্যার বিষয়ে কথাবার্তা বলতে থাকলাম। তারা তখনও বেশ কিছুটা দূরে ছিল। আমাদের কুটিরে পৌছাতে কিছুটা সময় লাগবে।তাই আমরা পুনরায় নিজেদের কাজে লেগে গেলাম।

ভরত যখন এসে পৌঁছাল তখন স্বামী রামচন্দ্র যজ্ঞবেদীর সামনে বসেছিলেন। একপাশে কুশবনের আসনে আমি এবং লক্ষ্ণণ। ভরতের সঙ্গে এসেছিল শত্রুঘ্ন, নিষাদ রাজ গুহ, সারথি সুমন্ত্র এবং দুই জন মন্ত্রী। ভরতকে দেখে আমরা উঠে এলাম। ভরত দাদাকে দেখেই শোকে কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি আকুল  চিত্তে বলতে লাগলেন-‘ হে প্রভু, আমি এটা কি দেখছি। অযোধ্যার রাজকুমারের এই বেশ। এই সমস্ত দুঃখের কারণ হলাম আমি।আমার  জীবনে ধিক। এভাবে বলে কাঁদতে কাঁদতে ভরত অস্থির হয়ে পড়ল। তারপরে হাঁটুগেড়ে দাদাকে প্রণাম জানাতে গিয়ে সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। শত্রুঘ্ন কাঁদতে কাঁদতে  আমাদের চরণ ভিজিয়ে দিল। ভরতের অবস্থা দেখে আমি আশ্চর্য হলাম। মানুষটাকে একেবারেই চিনতে পারিনি। খুব রোগা হয়ে গেছে। পরনে গাছের ছাল, মাথায় জটা। স্বামী ভরতকে উঠিয়ে নিল। তারপরে ভরত শত্রুঘ্নকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখে আমি, লক্ষ্ণণ, সুমন্ত্র এবং মন্ত্রীরা কেউ থাকতে পারছিলাম না। এই চার ভ্রাতার মিলনে ছিল এক স্বর্গীয় আনন্দ। আমি সেই মিলন পর্ব কোনোদিন ভুলতে পারব না।

ভরত আমার এবং লক্ষ্ণণের চরণে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। যেন এই কান্নার কোনোদিন শেষ হবেনা। শেষে স্বামী রামচন্দ্র ভরতের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ছোট ছেলেকে বসানোর মতো কোলে বসিয়ে নিয়ে একনাগাড়ে অনেকগুলো প্রশ্ন করল-‘আমার প্রাণের ভরত, তুমি বনে কীভাবে  এসেছ? গাছের ছাল এবং জটা কেন ধারণ করেছ? মামারবাড়ি থেকে কবে ফিরে এলে? বাবা তোমাকে এভাবে বনে আসতে অনুমতি দিল?তিনি কুশলেই আছেন তো? মায়েরা সবাই ভালো আছে তো?’

স্বামী ভরতের কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে আলগোছে তার দেহে হাত বুলিয়ে  বলল-‘তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। কোনো অসুখ হয়েছিল কি? কতদিন যে তোমাদের দেখতে পাইনি।’ একথা বলে  পাশে বসে ভরত এবং শত্রুঘ্নকে পুনরায় বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

ভরত হাতজোড় করে সভক্তিতে স্বামী এবং লক্ষ্ণণকে  বললেন-‘হে শ্রদ্ধাভাজন দাদা, রামচন্দ্র এবং আমার প্রিয় ভাই লক্ষ্ণ্‌ণ, আমি খুব দুঃখের সঙ্গে জানাই যে আমার মাতার কুবুদ্ধির পাকচক্রে পড়ে পিতা তোমাদের বনবাসে পাঠিয়ে শোকদগ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। সমস্ত দুঃখের মূল হল আমার মা। তাঁর জন্যই আজ আপনাদের, আমার অন্য দুই মাতার, প্রজার, রাজ্যের সবাই দুঃখিত হয়েছে। আমার সঙ্গে তিনজন মাতা, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ এবং অন্য পণ্ডিতরাও এসেছেন…।’

ভরতের কথা শেষ না হতেই স্বামী রামচন্দ্র অচেতন হয়ে কুটিরের বারান্দায় ছিটকে পড়লেন। আমরা সকলেই তাকে ঘিরে ধরে কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে পুনরায় শোকাবহ ঘটনাটা মনে পড়ায় স্বামী বিলাপ করতে লাগলেন। আমি তার শোক লাঘব করার জন্য সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। বাকি সমবেতরা সবাই তার কর্তব্য বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-‘হে রাম, আপনি শোক পরিহার করে পিতার প্রতি জল তর্পণ করার জন্য প্রস্তুত হন।’  

তখনই স্বামীর মৃতের উদ্দেশ্যে পারলৌকিক কর্মের কথা মনে পড়ল। তিনি লক্ষ্ণণকে কয়েক ধরনের ফলের গুড়ি তৈরি করার আদেশ দিলেন। 

মন্ত্রী সুমন্ত্রকে মুখ্য করে প্রত্যেকেই আমাদের মন্দাকিনী নদীর তীরে নিয়ে গেলেন। সেখানে নিয়ম অনুসারে জল তর্পন এবং পিণ্ডদান করা হল। সাধারণত পিণ্ড বলে বললে যে সমস্ত দ্রব্যের প্রয়োজন হয়,  সেসব আমাদের কাছে দুষ্প্রাপ্য, তাই কয়েক ধরনের ফলের গুড়ি মিশিয়ে পিণ্ড প্রস্তুত করা হয়েছিল।

নিয়ম অনুসারে সমস্ত কাজ সমাধান করে আমরা কুটিরে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে কুলগুরু বশিষ্ঠের সঙ্গে আমাদের তিনজন শাশুড়ি এবং তিনজন জা এসে উপস্থিত হয়েছিল।  মায়েদের বৈধব্যের  সাজ দেখে পুনরায় কান্নার রোল উঠল। কাঁদতে কাঁদতে প্রথমে স্বামী রামচন্দ্র কুলগুরু বশিষ্ঠ থেকে শুরু করে মান্যজনদের প্রণাম জানালেন। তারপরে লক্ষ্ণণ। শেষে আমি। আমাকে দেখে শাশুড়ি কৌশল্যা তার বুকের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমার চেহারা দেখে তিনি বিলাপ করতে লাগলেন। তারপরে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-‘মা তুমি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছ।রোদ-বাতাস-বৃষ্টি তোমার চুল রুক্ষ করে তুলেছে। তোমার মুখের চেহারা ঝরে পড়া পদ্মের মতো হয়েছে। চন্দ্রকে ধুলো আবৃত করে রাখলে যেমন দেখায় তোমাকেও সে রকম দেখাচ্ছে। আমি তোমার এই চেহারা সহ্য করতে পারছিনা।’ মেজ শাশুড়ি সুমিত্রাও আমার মাথায় কপালে হাত বুলাতে লাগলেন। লক্ষ্ণণের পত্নী উর্মিলা ছাড়া বাকি দুজন জা মান্ডবী আর শ্রুতকীর্তি  আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি মন্দাকিনী নদীর দিকে তাকিয়ে  বসে থাকা উর্মিলার কাছে এসে পৌঁছলাম। তার পিঠে ধীরে ধীরে হাতটা রেখে পাশে বসলাম। কিন্তু উর্মিলার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমি আস্তে করে ডাকলাম ‘উর্মিলা’।

উর্মিলা আমার কন্ঠস্বর শুনতে পেলনা বলে মনে হল। সেই সময়ে মহারাজ জনকের কন্যা উর্মিলা কে এক পাশ থেকে মৃত্যুপথযাত্রী একজন রোগাক্রান্ত মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল। আমি তার গালে মুখে হাত বুলিয়ে বললাম-‘তুমি বস। আমি লক্ষ্ণণকে পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে।’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরটা শিউরে উঠল। তারপর সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। সে দৃষ্টিতে আমি উর্মিলার আমার প্রতি রাগ ক্রোধ, ঘৃণা, দুঃখ, করুণা, স্নেহ সমস্ত কিছু দেখতে পেলাম। উর্মিলার দৃষ্টি যেন আমাকে বলল- ‘লক্ষ্ণণ? কে লক্ষ্ণণ? আমি কোনো লক্ষণ কে জানিনা। যে সুমিত্রা নন্দনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল তাকে আমি তোমার হাতে সমর্পণ করেছি। তুমি দেবর, বন্ধু, দাস যেভাবে তাকে নিতে চাও নিতে পার। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিছুক্ষণ আমি উর্মিলার কাছেই নীরবে বসে থেকে সবাইকে খাবার দাবার দেবার জন্য কুটিরে ফিরে এলাম।’ 

সেদিন কান্নাকাটি, দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেল। মাঝখানে স্বামী ভরতকে রাজ্যশাসন কীভাবে করতে হয় সেই বিষয়ে অনেক জ্ঞান দিলেন। স্বামী এত সুন্দর সারগর্ভ কথা বলছিলেন যে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ সহ প্রত্যেক ব্যক্তি সে কথা শোনার জন্য তাঁকে ঘিরে ধরল।ভরত তার কাছে বসে ছোট ছেলে রূপকথার গল্প শোনার  মতো শুনতে লাগল।

  আমরা মহিলারাও স্বামীর মুখ থেকে নির্গত উপদেশ বাণী শোনার জন্য ভরতের কাছে বসে পড়লাম। একজন রাজার কর্তব্য বিষয়ে স্বামী রামচন্দ্র ভরতকে বলেছিলেন যে রাজ্যের মন্ত্রী পদ সমূহ  পূরণ করার জন্য যে সমস্ত ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়,তাদের প্রকৃতি কী ধরনের সেটাও রাজার জানা কর্তব্য। কারণ মন্ত্রীরা বিশ্বাসী,জিতেন্দ্রিয়,নীতিশাস্ত্রজ্ঞ,পন্ডিত হওয়াটা আবশ্যক। কারণ মন্ত্রীদের সুমন্ত্রণাই একটি দেশ বা রাজ্যের উন্নতির কারণ। ঠিক এভাবেই যে সমস্ত ব্যক্তি বিদ্বান এবং জ্ঞানী, যার অন্তর শুদ্ধ, যে কখনও ঘুষ খায় না, যার পিতা-পিতামহ মন্ত্রণা কার্যে নিযুক্তি পেয়েছিল সেরকম লোককেই  দেশের বা রাজ্যের উচ্চ পদ সমূহে নিযুক্ত করা উচিত। কারণ এই ধরনের অমাত্যদের গুপ্ত মন্ত্রণাই রাজার বিজয় এবং রাজ্যের সমৃদ্ধির মূল কারণ। একইভাবে সেনাপতি পদে প্রতিষ্ঠিত  করতে চাওয়া ব্যক্তি ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমান,বীর,চতুর এবং অনুরক্ত হওয়া উচিত। দৌত‍্য কার্যেও বিদ্বান এবং পণ্ডিতদের নিযুক্ত করা উচিত। তেমনই এক একটি বিষয়ে  নিযুক্ত করা গুপ্তচররা একে অপরকে চিনতে না পারা উচিত। তাহলেই আত্মপক্ষ এবং শত্রুপক্ষের খবর পাওয়াটা সম্ভব হয়।

ধনের লোভে যাতে কেউ নিজের কর্তব্য থেকে সরে না যায়, তার জন্য দেওয়া একটা উপদেশে স্বামী রামচন্দ্র বলেছিলেন ধনের লোভে নির্দোষ একজনকে যেমন দণ্ড দেওয়া উচিত নয় ঠিক তেমনই ধরা পড়া চোরকে ধনের লোভে কোনো কর্মচারী যাতে ছেড়ে না দেয় তার জন্য রাজাকে সতর্ক থাকতে হবে। বিবাদ নিষ্পত্তির সময়ও ধনের লোভ পরিত্যাগ করে সুবিচার যাতে হয় তার জন্য বিচারক অমাত্য শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষ হওয়া উচিত।

একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশে স্বামী রামচন্দ্র ভরতকে বলেছিলেন যে সৈন্যের আহার এবং বেতন সময়মতো দেওয়াটা অত্যন্ত প্রয়োজন।সেনাবাহিনীর লোকদের উৎকৃষ্ট খাওয়া-দাওয়া,ভালো বেতন, নিয়মিত অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া ছাড়াও সমস্ত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। ঠিক সেভাবেই চাকুরীজীবী এবং  ভৃত্যদের ও  প্রাপ্য ধন সময়মতো দেওয়া উচিত। চাকুরীজীবী হোক বা ভৃত‍্যই হোক প্রাপ্য ধন সময়মতো না পেলে প্রকৃত প্রভুর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এই ধরনের মানুষের ক্ষোভ দেশের অনর্থের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

প্রতিবছর যাতে ব‍্যয়ের পরিমাণের চেয়ে আয়ের পরিমাণ বেশি হয় রাজার সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।দেশ বা রাজ্যের আয়ের পরিমাণ বেশি দেখলে প্রজারা ও আনন্দিত হয়। রাজা হয়ে ভোগবিলাসে দিন কাটালে  প্ৰজারা খুশি হয় না। দেশের বা রাজ্যের উন্নতির জন্য মন্ত্রী এবং নীতি শাস্ত্রে পণ্ডিত অমাত্যদের সঙ্গে আলোচনা করে যে কার্যসূচি তৈরি করা হয়, তা কার্যে পরিণত করলে প্রজারা রাজাকে ভালোবাসে। সেই রাজা দেশের সুচিন্তা করে বলে প্রজারা জানতে পারে। তার বেশি প্রজারা রাজার বিষয়ে কোনো কিছু জানতে পারে না। প্রজারা কাজের দ্বারা  রাজাকে চিনতে পারে।

অন্য একটি উপদেশে রামচন্দ্র বলেছিলেন যে মিথ্যা ক্রোধ, নাস্তিকতা, অন্যমনস্কতা, দীর্ঘদিনের  শত্রুতা, জ্ঞানী পুরুষের অদর্শন, আলস্য, ইন্দ্রিয় বশ্যতা, নির্ধারিত কর্তব্য পরিহার, মন্ত্রণা প্রকাশ, সকালের মাঙ্গলিক কাজে অনীহা -এই ধরনের কাজকে রাজদ্রোহ বলা হয়। এই সমস্ত দোষগুলি সবসময় বর্জন করা উচিত। মৃগয়া,পাশা খেলা, দিবানিদ্রা, পরস্ত্রীর প্রতি আগ্রহ, মদ, বৃথা ভ্রমণ-এই সমস্ত দোষ পরিহার না করলে রাজ্য বা দেশের বিপদ অনিবার্য।

শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সব সময় ধন-ধান,জল,অস্ত্র,যোদ্ধা ধনুর্ধর  পরিপূর্ণ করে রাখা উচিত। বৃক্ষের দ্বারা নির্মিত দুর্গ,জল দুর্গ,গিরি দুর্গ,মরু দুর্গ আর গ্রীষ্মকালে নির্মাণ করা দুর্গ, এই পাঁচ রকমের দুর্গকে পঞ্চম দুর্গ বলা হয়ে থাকে।এই দুর্গ সমূহ সবসময় গ্রহণীয় নয়। তাই একজন রাজা সব সময় সতর্ক থাকা উচিত বলে স্বামী ভারতকে উপদেশ দিয়েছিলেন। ঠিক তেমনই ভাবে শত্রু, মিত্র, মিত্রের মিত্র,মিত্র জনের শত্রু, বিজয় অভিলাষী রাজা এর ভিতরে যাদের পরিত্যাগ করলে দেশের মঙ্গল হবে সে কথা চিন্তা করে সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যাগ করা উচিত। হঠাৎ আগত বিপদ যেমন- আগুন, জল, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ রাজ্যকে যাতে দুর্বল করে তুলতে না পারে তার জন্য সবসময় প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা উচিত।

স্বামী রামচন্দ্র উপদেশের শুরুতে বলেছিলেন যে একটি দেশের রাজ্যের সম্মানীয় ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাটা একজন রাজার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।অস্ত্র বিশারদ, রাজনীতিবিদ, ধনুর্বিদ্যা আচার্যদের শ্রদ্ধা এবং সম্মান করলে দেশের মঙ্গল হবে। দুই তিনবার যার বীরত্ব পরীক্ষা করা হয়েছে তেমন ধরনের বলী, যুদ্ধ বিশারদ এবং বিক্রম শীল পুরুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক। স্বল্প বেতনভোগী লোভী মানুষ এবং অপমানিত হওয়া সম্মানীয় ব্যক্তির ক্রোধকে উপেক্ষা না করার জন্য স্বামী রামচন্দ্র ভরতকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। স্বামী উল্লেখ করা অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হল দেশের যে সমস্ত জায়গায় অনেক  মঠ মন্দির শোভা বর্ধন করছে, যেখানে হিংসার লেশমাত্র নেই, চাষবাস করে যথেষ্ট উপার্জন করছে, যেখানে সোনার  রুপোরখনি রয়েছে সেই সমস্ত জায়গায় যাতে কোনো দুষ্ট প্রকৃতির লোক প্রবেশ করে অমঙ্গল ঘটাতে না পারে তার জন্য রাজাকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। ভরতকে স্বামী রামচন্দ্র সাজপোশাকের বিষয়ে ও উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে একজন রাজা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে প্রজাদের দর্শন দেওয়া উচিত কারণ সাজ পোশাক ও রাজার রুচি এবং প্রকৃতি প্রতিফলিত করে। স্বামী ভরতকে সুচারুরূপে রাজকার্য চালানোর জন্য হাজার মূর্খকে পরিত্যাগ করে প্রয়োজনে একজন পণ্ডিতকে কাছে টেনে নিতে উপদেশ দিয়েছিলেন। স্বামী রামচন্দ্রের কথা শুনে আমরা প্রত্যেকেই অতিশয় আনন্দিত হয়েছিলাম। তারপরে আমরা তিনজন বধু এবং শাশুড়ি এক সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম। হাসি কান্নার মধ্য দিয়ে নানা কথা হয়েছিল। সেই কথায় উর্মিলা ছাড়া প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি ছোট শাশুড়ি কৈকেয়ী ও মেজ শাশুড়ি সুমিত্রা আমরা বনবাসে চলে আসার পরে কী কী ঘটেছিল সেই সমস্ত কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে বলেছিলেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...