বিদেহ নন্দিনী~১৩ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Basudeb Das
(তেরো)
সূর্য উদয় হওয়ার আগেই আমাদের যাত্রা আরম্ভ হল। এই যাত্রা ছিল ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমের অভিমুখে। আমি অযোধ্যায় থাকার সময় ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের মুখে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমের কথা অনেকবার শুনেছিলাম। কিন্তু এত গভীর অরণ্যের মধ্যে গিয়ে আশ্রম দেখতে পাব বলে আমি কল্পনা করতে পারিনি। স্বামী রামচন্দ্র বা দেবর লক্ষ্ণণ ও আগে কোনোদিন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম আগে দর্শন করেনি। যদিও দুজনেই বাল্যকালে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে অনেক আশ্রমে যাবার সুবিধা পেয়েছেন মাত্র।স্বামী ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম সম্পর্কে কেবল এতটুকুই জানতেন যে সেই আশ্রম প্রয়াগ তীর্থের কাছে। অর্থাৎ যেখানে যমুনা নদী গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আমরা তিনজন গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্ণণ আগে আগে পথ মুক্ত করে যাচ্ছিল। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে বিশ্রাম নিতে নিতে গিয়ে ঠিক সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে আমরা উত্তাল তরঙ্গের শব্দ শুনতে পেলাম। স্বামী আনন্দের সঙ্গে বললেন –জানকী, সেই যে কলধ্বনি শুনতে পাচ্ছ,দুই পবিত্র নদীর সংযোগস্থল থেকে ভেসে আসা শব্দ। আমরা ঋষির আশ্রমের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। পথ ভুল না করে ঠিক পথে আসার জন্য আমাদের মনে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। নানান ধরনের কথা বলে আমরা সন্ধের আগেই ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে পৌঁছে গেলাম। আশ্রমে প্রবেশ করার পথে একজন শিষ্যকে পেয়ে আমরা ঋষিকে দর্শন করার জন্য আসার কথা বললাম। সে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ঋষির অনুমতি নিতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই সেই শিষ্য আমাদের ঋষি ভরদ্বাজের কাছে নিয়ে গেলেন।
ঋষির শান্ত,সৌম্য,তেজস্বী এবং জ্ঞান পুষ্ট চেহারা দেখে আমাদের মাথা নিজে থেকেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসছিল। আমরা তার চরণ স্পর্শ করে প্রণাম জানালাম। তারপর স্বামী আমাদের পরিচয় নিবেদন করলেন। আমাদের পরিচয় পাওয়ার পরে ঋষি বললেন-‘রাম, তোমার বিষয়ে আমি সমস্ত কিছুই জানি। এমনকি বিনা কারণে তোমার বনবাস হয়েছে বলেও জানতে পেরেছি। অনেক দিন থেকে এই আশ্রমে একবার পদার্পণ করবে বলে আশা করেছিলাম। আজ আমার সেই আশা পূর্ণ হল। আমি অত্যন্ত সুখী যে তুমি আজ আমার আশ্রমে।’
তারপরে ঋষি আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য শিষ্যদের আদেশ দিয়ে পুনরায় বললেন-‘ রাম, গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল এই জায়গা অত্যন্ত পবিত্র এবং মনোরম। এখানে ফলমূল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তোমরা বনবাসের জীবনটা এই অঞ্চলে কাটাতে পার।’ স্বামী নম্রভাবে তাকে বললেন-‘হে প্রভু, আপনার এই তীর্থভূমি কোশল রাজ্যের কাছে। আমরা এখানে থাকলে অযোধ্যার প্রজারা জানতে পারবে এবং ঘন ঘন আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে আসতে থাকবে। ফলে আপনার আশ্রমের শান্তি ভঙ্গ হবে। তাই আমি এখানে থাকাটা সমীচীন হবে না বলেই ভাবছি। আপনি আমাকে অন্য কোনো জায়গার কথা বলুন যেখানে আমরা একা শান্তিতে কাটাতে পারব।’
ঋষি আমাদের অনেক সারগর্ভ উপদেশ দিয়ে চিত্রকূট নামের একটি জায়গার সন্ধান দিলেন। জায়গাটার সৌন্দর্য বর্ণনা করে তিনি বললেন-‘যাবার সময় তোমাদের চিত্রকূটে যাওয়ার বিষয়ে বুঝিয়ে বলব। আজ বলছি না কারণ তোমরা ক্লান্ত হয়ে এসেছ তাই খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নাও।
’ আমরা সেই রাত ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে বড় শান্তিতে কাটালাম। নানা ধরনের ফলের রস এবং সুস্বাদু ঋষি মুনির উপযোগী আহার করে নিশ্চিন্ত মনে তিনজন শুয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন সকালে প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে আমরা চিত্রকূটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে ঋষিকে প্রণাম জানালাম। ঋষি আমাদের কোন পথে কীভাবে যেতে হবে তা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন-‘ যমুনা পার হয়ে কিছুদূর যাবার পরে একটি চিরসবুজ বড় গাছ দেখতে পাবে। সেই গাছের নিচে অনেক ঋষি মুনি বাস করে। গাছের নিচে তোমাদের কিছুক্ষণ থাকাটা ভালো হবে। সীতা গাছটিকে মনের আশা পূর্ণ করার জন্য প্রণাম জানাবে’। ঋষির শেষের কথাটা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। মনে মনে ভাবলাম তিনি বা কী আশার কথা বলতে চাইছেন। নাকি যোগ শক্তির বলে ঋষি বুঝতে পেরেছেন যে আমার অন্তর সবসময় একটি সন্তানের জন্য হাহাকার করতে থাকে।’ কথাটা ভেবে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম বুঝতে পারলাম না। পুনরায় ঋষির কথা শুনে আমি সচকিত হলাম। তিনি বললেন-‘গাছটির থেকে কিছু দূরে এগিয়ে গেলে চিত্রকূট দেখতে পাবে। কিছু অসুবিধা হলে দুই এক জন তপস্বীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পার। এভাবে জায়গাটার কথা বুঝিয়ে দিয়ে আমাদের অনেকখানি রাস্তা এগিয়ে দিলেন। আমরা পুনরায় তাঁর চরণ স্পর্শ করে চিত্রকূটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ঋষি ভরদ্বাজের বর্ণনা অনুসারে আমরা পথ হাঁটছিলাম। পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। যেতে যেতে আমরা কালিন্দী নদী পেলাম।কালিন্দী নদীকে অনেকে যমুনা নদীও বলে।কলিন্দ পর্বত থেকে উদ্ভব হওয়ার জন্য এই নদীর নাম হয় কালিন্দী। লক্ষ্মণ বাঁশ কাঠ আর লতা জোগাড় করে একটা ভেলা বানালেন। কোমল বেত বাঁশ দিয়ে বসে যাবার জন্য একটি আসনও তৈরি করলেন। আমি লক্ষ্ণণের কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। রাজকুমার হয়ে বাঁশ বেতের কাজ এত নিপুণভাবে করতে দেখে আমার মুখে কোনো কথা সরছিল না । মনে মনে ভেবেছিলাম ‘লক্ষ্ণণ সত্যি খুব কাজের ছেলে।’
লক্ষ্ণণের কাজের প্রশংসা করে দু'একটি কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু সেদিন রাতের কথাগুলি মনে পড়ে যাওয়ায় আমি সেটা দমন করলাম। আমরা সেই ভেলায় উঠে কালিন্দী নদী পার হলাম। ঋষির বর্ণনা অনুসারে বড় গাছ দেখে আমাদের আনন্দের সীমা রইল না। কী যে সৌন্দর্য ছিল সেই গাছটিতে। আমি বৃক্ষকে প্রার্থনা জানিয়ে বলেছিলাম-‘ হে পুণ্য বৃক্ষ শুনেছি তুমি নাকি মনের কামনা পূরণ করতে পার।তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমার অন্তর কি চাইছে? মনের বাঞ্ছা পূর্ণ কর হে আশ্রয়দাতা পুণ্য বৃক্ষ।হে বৃক্ষ শ্রেষ্ঠ বর্তমানে আমরা বনবাসে। আমার স্বামী রামচন্দ্র যেন কোনো বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই পিতার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে তার জন্য আমাদের শক্তি দাও। আমাদের বৃদ্ধ রাজা, মাতা কৌশল্যা, সুমিত্রাকে মুখ্য করে সমগ্র অযোধ্যাবাসীকে কুশলে রাখ।’ তারপরে আমরা তিনজন সেই পুণ্য বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় পথ চলতে লাগলাম ।
বসন্তকাল হওয়ার জন্যই সমগ্র অরণ্য ফলে-ফুলে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গাছগুলিতে যেখানে সেখানে রসে পরিপূর্ণ মৌমাছির বাসা। আমরা আনন্দিত মনে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চিত্রকূটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এমনকি এতটা পথ যে হেঁটে এসেছি সে কথাও আর মনে রইল না। অবশ্য যেখানেই ক্লান্ত লাগছিল বা বিকেল হয়ে এসেছিল,আমরা সেখানেই বিশ্রাম নিয়ে ছিলাম। এভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত চিত্রকূটে পৌঁছে গেলাম।
জায়গাটা সত্যি বড় সুন্দর। অসংখ্য ফলমূলের গাছ। ভিন্ন রঙের পাখির সুমধুর গান জায়গাটিকে মুখরিত করে তুলেছিল। দলে দলে হরিণ এবং হাতির দল আপনমনে খেলে বেড়াচ্ছিল। নদী ঝর্ণা এবং জলপ্রপাত চিত্রকূটের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই নির্মল জলের স্বাদই ছিল আলাদা।
দুই দাদা ভাই আলোচনা করে একটি কুটির নির্মাণ করার কথা ভাবলেন। লক্ষ্ণণ সোজা ঘূণে না ধরা কাঠ পাওয়ার জন্য গাছের খুঁটি কেটে বের করল।খর, বাঁশ বেত দিয়ে ঘরের চালা তৈরি করল। বাঁশের কামি দিয়ে বেড়া বানাল এবং বাতাস আসা-যাওয়ার মতো করে জানালা তৈরি করল। মোটকথা লক্ষ্ণণ স্বামীর সাহায্যে একটি সুন্দর ঘর বানিয়ে ফেলল। আমি তাদের কাজ দেখে বিস্মিত হলাম।
একদিন একটা ভালো দিন দেখে আমরা গৃহ প্রবেশ করলাম।
স্বামী রামচন্দ্র বিন্দুমাত্র অসুবিধা না থাকা নির্মাণ করা কুড়ে ঘরটি দেখে লক্ষ্ণণকে জড়িয়ে ধরে বললেন-‘ ভাই তুমি এসব কাজ কোথায় শিখলে? আমি তোমার কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছি। আর একটি কথা ভেবে আমি অবাক হয়েছি, জানকী কীভাবে এতটা পথ পায়ে হেঁটে এল। আমি বুঝতে পেরেছি মানুষের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। বিপদ এবং অবস্থা মানুষকে নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে শেখায়। তার প্রমাণ তোমাদের মধ্যেই পেলাম।’
স্বামীর মুখে প্রশংসা শুনে আমার মন আনন্দে ভরে উঠেছিল। আমরা চিত্রকূটের সেই কুটিরে আনন্দে দিন কাটাতে লাগলাম। বনবাসের দুঃখের কথা ভুলে গেলাম ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন