বিদেহ নন্দিনী
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(আট)
(আট)
আমি আজকাল এভাবেই ভাবছি যে যা ঘটার তা ঘটবেই, তা কেউ আটকাতে পারে না। এমন কি যাগ-যজ্ঞ, পূজা অনুষ্ঠানেও তা আটকাতে পারে না। তা না হলে ছোট শাশুড়ির মতো একজন মা কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
ছোট শাশুড়ি পরেরদিন যে রামের অভিষেক হবে এই খবরটা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেননি। অবশ্য তার কাছে এই খবরটা নতুন নয়। কারণ ছোট শাশুড়ি প্রায় প্রতিদিনই রাজাকে দ্রুত রামকে যুবরাজ পাতার কথা বলেছিল। একদিন আমি তাদের কথোপকথন নিজের কানে শুনে ছিলাম। তিনি রাজাকে বলেছিলেন-‘আর্য পুত্র আমাদের সর্ব্বগুণ সম্পন্ন পুত্র রামের অভিষেক উৎসব দেখার আশায় পথ চেয়ে রয়েছি। দ্রুত রামকে যুবরাজ পেতে আমার আশা পূর্ণ করুন।’
রাজা নিষ্কলুষ মনের যুবতি পত্নী কৈকেয়ীকে দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন-‘ধৈর্য ধর প্রিয়া, প্রতিটি কথার একটি সময় থাকে। রামের অভিষেকের সময় নিশ্চয় সমাগত। তোমার রামের প্রতি স্নেহ দেখে আমি আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েছি।’
তবে এই সুখবরটা ছোট মা প্রথম পেয়েছিলেন তার অতি বিশ্বস্ত চাকরানি মন্থরার কাছ থেকে। শ্বশুর রাজা দশরথ হয়তো ভেবেছিলেন সমস্ত কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পরে যখন অবসর কাটানোর জন্য কৈকেয়ীর প্রাসাদে যাবেন তখনই তিনি এই শুভ খবরটা দেবেন। নতুবা আমাদের কাছ থেকেই এই খবর পাবেন বলে হয়তো তিনি ভেবেছিলেন।
মন্থরা শাশুড়ি কৈকেয়ীর কেবল নির্ভরযোগ্য ভৃত্যই নয়,সম্পর্ক রয়েছে। ছোট শাশুড়ি নাকি মন্থরাকে যৌতুক হিসেবে এনেছিলেন। মন্থরা নাকি রানি কৈকেয়ীকে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করেছে। তাই মন্থরা রানীর দুটি পরিবারের সমস্ত কথাই জানতেন। আমি বধূ হয়ে নতুন আসার পরে মন্থরা কয়েকদিন কেকয় রাজার গল্প শুনিয়েছিল। আরেকদিন গল্পের ছলে শ্বশুর রাজা দশরথ এবং শাশুড়ি কৈকেয়ীর প্রেমের কাহিনিও বলেছিলেন। আমি তখন সেই কাহিনী শ্বশুর এবং শাশুড়ি কৈকেয়ীর বলে জানতাম না। রাজা দশরথ নাকি কৈকেয়ীর রূপ দেখে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বয়সের পার্থক্যের জন্য কেকয়রাজ তার কাছে কন্যাকে সমর্পণ করবেন না বলায় প্রথম দুই পত্নীর সন্তানসন্ততি না হওয়ার কারণ দেখিয়ে কৈকেয়ীকে পেতে চেয়েছিলেন। তখনই নাকি রাজা দশরথ কৈকেয়ীর পিতার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কৈকেয়ীর গর্ভজাত সন্তানই অযোধ্যার রাজা হবে। এই কথাগুলি নাকি অযোধ্যায় মন্থরা এবং রাজা দশরথ ছাড়া আর কেউ জানতেন না। এমনকি কৈকেয়ীও জানত না। মন্থরা কখনও কাউকে বলেছিল যদিও কেকয় দেশের গল্প বলেছিল। সেই গল্পে রাজা রানির নাম ছিলনা।
মন্থরা যেহেতু আগে থেকেই সমস্ত কিছু জানতো তাই সেও দশরথের পরে কৈকেয়ী পুত্র ভরতই অযোধ্যার রাজা হবে বলে নিশ্চিত ছিল।
রাজা দশরথ পরের দিনই রামচন্দ্রের অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করার পরে প্রজারা রাজপ্রাসাদ এবং নগর সাজানোর কাজে লেগে গেল। রাজপ্রাসাদেও একটা উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হল। চারপাশে আনন্দ উৎসবের পরিবেশ দেখে মন্থরা একজন চাকরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল যে পরের দিনই রাজা দশরথ রামকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করতে চলেছেন। কথাটা শুনে মন্থরা ভীষণভাবে চমকে উঠল। কারণ অন্নদাত্রী কৈকীয়ে কখনও কারও কাছে ঠকে যাবে এটা মন্থরা কোনোদিন ভাবতে পারেনি। মন্থরা নাকি কর্মচারীর সামনেই রাজার বিষয়ে বিড় বিড় করে বলেছিল-এত প্রবঞ্চনা। মানুষটাকে একা পেয়ে রাজা এভাবে ঠকাল? ক্রোধে জ্বলে পুড়ে মন্থরা রানি কৈকেয়ীর অন্তপুরে প্রবেশ করল।
সেই সময়ে নাকি শাশুড়ি কৈকেয়ী এমনিতে শয্যায় শুয়ে ছিলেন। মন্থরা নাকি সোজাসুজি উপহাসের সুরে কথা বলতে শুরু করে –‘ তুমি এখনও শুয়ে আছ? তুমি জান না কি যে আগুন তোমার ঘরে চলে এসেছে। রাজা যে তোমাকে ছলনা করল তুমি কি সেটা বুঝতে পারনি? তোমার সরলতার সুবিধা নিয়ে তিনি এরকম করাটা ঠিক হয়নি। তোমার জীবনের সূর্য ডুবে গেল বলে ধরে নাও। এভাবে অলসের মতো শুয়ে-বসে কাটাবে না আমার কথা শুনবে?’
শাশুড়ি কৈকেয়ী নাকি মন্থরার কোনো বিপদ ঘটেছে ভেবে জিজ্ঞেস করেছিল-‘ কী হল তোমার? এত অধৈর্য্য হয়ে পড়েছ যে?’
মন্থরা নাকি তখন শশুড়িকে আঘাত করে বলতে শুরু করল-‘ তোমার এবং আমার দুজনেরই আজকেই সুখভোগ এবং আনন্দের ইতি পড়বে বলে ধরে নিতে পার। তুমি জানতেই পারনি সংসারে কী ঘটতে চলেছে। রাজা রামকে যুবরাজ করার আয়োজন করছে। তুমি রাজার বাড়ির মেয়ে, রাজার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখন রাম রাজা হওয়ার পরে তোমার যে সমস্ত সুখের ইতি পড়বে তা কি তুমি ভেবে দেখেছ? বুদ্ধি করে তোমার পুত্র ভরতকে দূরে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে রাস্তার কাঁটা সরিয়ে দিয়েছে। আগামী কালের মধ্যে রামের যুবরাজ পদে অভিষেকের কাজ করে ফেলতে চাইছে। এরকম ষড়যন্ত্র দেখেও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? তুমি বসে থাক। কিন্তু আমরা যারা তোমার মুখের দিকে চেয়ে বেঁচে আছি সেই আমাদের কি গতি হবে?’
শাশুড়ি কৈকেয়ী মন্থরার কথাগুলি মন দিয়ে শুনেছিল যদিও বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিলেন না। কারণ তিনি জানতেন মন্থরার স্বভাবটাই এই ধরনের। মানুষের বিরুদ্ধে নিন্দা করা তার স্বভাব। মন্থরার খবর নাকি তাকে আনন্দ দিয়েছে। তাই শাশুড়ি কৈকেয়ী নাকি মন্থরাকে বলেছিল-‘তুমি আমাকে বড় শুভসংবাদ দিলে। আমার পুত্র রামের আগামীকাল অভিষেক হবে। এর চেয়ে সুখের কথা আর কি হতে পারে? তাই উপহার হিসেবে তোমাকে এই হাড়টা দিচ্ছি। এই বলে শাশুড়ি নাকি গলা থেকে হাড়টা খুলে নিয়ে মন্থরার হাতে দিয়েছিল।
মন্থরা নাকি তখন হাড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুনরায় বলেছিল-‘তুমি সত্যিই নির্বোধ মহিলা। তোমার নিজের আগত দুর্দশার কথা জানার পরেও তুমি কীভাবে আনন্দ করতে পারছ সেটা ভেবে আমি অবাক হয়েছি। তোমার দুর্গতির কথা ভেবে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। তোমার সতিন কৌশল্যা সৌভাগ্যবতী। তারপুত্র রাম রাজা হবে আর তুমি হবে তোমার সতিনের দাসি। তোমার পুত্র ভরত হবে রামের দাস। ভরতের কাছ থেকে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ভেবে রাম ভরতকে মেরে ফেলতেও পারে বলে আমার ভয় হচ্ছে।কথাটা বলেই মন্থরা নাকি কাঁপতে শুরু করেছিল।
শাশুড়ি কৈকেয়ী তখন মন্থরাকে অনর্থক খারাপ চিন্তা না করার জন্য বলেছিল-‘তুমি মিথ্যা শোক করছ। তুমি যেরকম আশঙ্কা করছ রাম সেই ধরনের নয়। তাঁর চিত্ত অত্যন্ত নির্মল। আমার প্রতি এবং ভাইদের প্রতি রামের কতটা ভালোবাসা তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। রাম যেহেতু আমাদের রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ কুমার তাই নিয়ম অনুসারে তারই রাজসিংহাসনে বসার কথা। ভরতের জন্য সময় তো আর চলে যাচ্ছে না। রামের পরেও চাইলে ১০০ বছর রাজত্ব করতে পারবে।
শাশুড়ির কথা শুনে নাকি মন্থরা এবার কপাল চাপড়ে বলেছিল-‘হায় হায়, তুমি রাজকন্যা হয়ে রাজা হওয়ার নিয়ম কানুন ভুলে গেলে? রাম রাজা হলে রামের পরে তার সন্তানেরা রাজা হবে। ভরত রাজা হওয়ার কোনো আশাই নেই। কারণ রাজার পুত্রই রাজার পরে সিংহাসন লাভ করে। তুমি এত জ্ঞানী হয়েও এই সাধারণ কথাগুলি জান না।মোটকথা শোন, ভরতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে বাড়িতে ফিরে আসতে দিও না। সে পালিয়ে থাকুক। বাড়িতে এলে জানবে মৃত্যুর মুখে পড়বে। সে বর্তমানে মামারবাড়িতে থাকাটা প্রত্যেকেই জানে। রাম লোক লাগিয়ে তাকে সেখানে মেরে ফেলতে পারে বলে ভয় করছে। সেখানে থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়।’
এভাবে বলার পরে নাকি শাশুড়ির মুখে ভয়ের ছাপ প্রকট হয়ে উঠে। তখনই নাকি ছোট শাশুড়ি বুঝতে পারে যে তার ভীষণ সংকটের সময় উপস্থিত হয়েছে। এই বিপদে মন্থরা ছাড়া তাকে রক্ষা করার মতো আর কেউ নেই। তিনি নাকি অসহায় অনুভব করে মন্থরাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।–‘হ্যাঁ,মন্থরা তুমি সত্যি কথাই বলেছ। আমি কৌশল্যার দাসী হয়ে দিন কাটাতে পারব না। এখন আমার তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমতী এবং অনেক উপায় জান। তাই দ্রুত কিছু একটা কর। ভরতকে যেভাবেই হোক সিংহাসনে বসাতে হবে।’
রানি কৈকেয়ীর অন্তর জয় করে মন্থরা নাকি মুহূর্তের মধ্যে গর্বিত হয়ে পড়েছিল। সে নাকি কৈকেয়ীকে একেবারে সমবয়সী মেয়েদের বলার মতো বলেছিল- ‘তুমি কি আশ্চর্য কথা বলছ? তুমি কি সত্যিই ভুলে গেলে নাকি আমাকে ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে দেখাচ্ছ?’মন্থরার কথা শুনে শাশুড়ি কৈকেয়ী নাকি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মন্থরার দিকে তাকাল। মন্থরা বলেছিল-‘তুমি যদি আমাকে বলতে বল তাহলে আমি বলতে পারি।’
রানি কৈকেয়ী নাকি তখন প্রায় অধৈর্য হয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল-‘বল,তাড়াতাড়ি বল আমি ভরতকে রাজমুকুট পরাতেই হবে।রামের অভিষেক বন্ধ না হলে হবে না।’
মন্থরা নাকি তখন ছোট শাশুড়ির পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল-‘বলছি শোন।কিন্তু অধৈর্য হয়ে পড় না। অনেকদিন আগে তোমার স্বামী দশরথ সম্বরাসুর এবং ইন্দ্রের মধ্যে যুদ্ধে দেবতাদের সাহায্য করার জন্য গিয়েছিল না? অসুর খুব শক্তিশালী ছিল বলে দেবরাজ ইন্দ্র দশরথেরকাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করার কথা তুমি ভুলে গেলে নাকি? কেন তুমিও তোমার স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিলা না কি? দাক্ষিণাত্যে গিয়ে তোমার স্বামী সম্বরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করার কথা মনে করে দেখ তো কী ঘটেছিল? যুদ্ধে দশরথ অচেতন হয়ে পড়ে ছিল না? তখন তুমি কৌশলে রথটা যুদ্ধের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলে? রাজার দেহে প্রবেশ করা তিরগুলি তুমি বের করে দিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে প্রাণে বাঁচিয়েছিলে না কি? তোমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা বর দিতে চাওয়ার কথা ভুলে গেলে নাকি? তুমি তখন বর দুটি না চেয়ে পরে চেয়ে নেবে বলেছিলে। তুমি এই সমস্ত কথা ভুলে যেতে পার আমি কিন্তু কখনও ভুলিনি। এখন তোমার বর গ্রহণ করার সময় উপস্থিত হয়েছে। তুমি রাজাকে বর দুটি দিতে বল। প্রথম বরে রামের জায়গায় ভরতকে রাজা করতে হবে বল দ্বিতীয় বরে রামকে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে বলে দাবি কর। বড় দুটি চাইতে ভয় বা শঙ্কা কর না। পাপের কথা বলেও ভাববে না। কথাটা বলে মন্থরা নাকি রানির প্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণ করলেন। তারপরেও মন্থরা পুনরায় রানিকে বলল-‘এখন তুমি এই সমস্ত অলঙ্কার,পাটের বস্ত্র পরিত্যাগ করে মলিন কাপড় পরে গোঁসাঘরের মেঝেতে পড়ে থাক। যখন রাজা তোমার কাছে আসবে তুমি কথা বল না। রাজার দিকে তাকাবেও না। রাজা তোমার দুঃখ সহ্য করতে পারবেনা। আর তুমি সেই সুযোগে বর দুটি চেয়ে নেবে। তুমি রাজার কথায় ভুলে যেও না। রাজা বরের বিনিময়ে অন্য অনেক কিছু দিতে চাইবে কিন্তু তুমি সেই দুটো বরের কথাই জোর দিয়ে ধরে থাকবে।’ তারপরে মন্থরা রানি কৈকেয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল-‘কোনো ভয় নেই। মন শক্ত কর এবং আমি যেভাবে বলছি সেভাবে কাজ কর। তাহলেই ভরতকে সিংহাসনে বসাতে পারবে, না হলে মিথ্যা চেষ্টা।’
শাশুড়ি মা কৈ্কেয়ী নাকি পুনরায় মন্থরাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল-‘মন্থরা তোমার কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’
মন্থরা নাকি রানির গালে-মাথায় হাত বুলিয়ে এভাবে আশ্বাস দিয়েছিল-‘কোনো চিন্তা কর না। রাজার তোমার প্রতি যে আকর্ষণ তাকে তোমার কথা মানতেই হবে। এখন বিন্দুমাত্র দেরি না করে তুমি সমস্ত অলংকার খুলে রেখে মেঝেতে শুয়ে পড়।’
মুহূর্তের মধ্যে ছোট শাশুড়ি নাকি সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিল। মানুষটা নাকি দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে শুরু করেছিল। তিনি শরীরের সমস্ত অলংকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খুবই সাধারন একটা কাপড় পরে চুলগুলিকে উল্টোপাল্টা করে ফেলেছিলেন। তারপরে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।
এই সমস্ত কথা আমি পরে শুনেছি। বনবাসে বের হওয়ার সময় চাকর বাকরেরা মন্থরাকে গালিগালাজ করার সময় আমরা অনেক কথাই শুনতে পেয়েছিলাম।
ছোট শাশুড়ি কৈকেয়ীর মতো একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ধৈর্যশীলা সুন্দরী রমণীকে একজন দাসী কীভাবে বশীভূত করে ফেলল সে কথা ভেবে অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মর্মান্তিক দুঃখিত হয়েছিলাম। কৈকেয়ীর মতো একজন বিরল প্রকৃতির স্নেহময়ী মায়ের মন একজন সাধারন দাসী এভাবে কলুষিত করতে পারাটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। তারচেয়েও দুর্ভাগ্যজনক কথাটা হল এত বড় একটা ঘটনা মাত্র কয়েকজন চাকর বাকর এবং দাসী ছাড়া কেউ জানতে না পারাটা।
আমার বিবেচনায় এই ঘটনাটির জন্য মন্থরা যতটা দোষী আমরাও ঠিক তার চেয়ে কোনো অংশে কম দায়ী নই। শ্বশুর রাজা দশরথ তার প্রিয়তমা পত্নী কৈকেয়ীকে রামের অভিষেক যে পরের দিনই অনুষ্ঠিত করা স্থির করেছেন সেই খবরটা রানিকে আগেই দেওয়া উচিত ছিল। যে মাতা রামচন্দ্রের অভিষেকের কথা প্রায় প্রতিদিনই রাজাকে বলে আসছিল সেই মাকে আড়াল করে অভিষেক উৎসব আয়োজন করা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি বিয়ে হয়ে আসার দিন থেকে বনবাসে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর মাতা কৈকেয়ীর সঙ্গে একসঙ্গে খেয়েছি, কথা বলেছি এবং ঘোরাফেরা করেছি। অত্যন্ত উদার মনের মানুষটির অন্তরে আমার প্রতি কোনো কলুষ ছিল না। সতিনদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শত্রুতার অভাব না থাকলেও সেটা আলাদা কথা। শ্বশুর রাজা দশরথ তাকে প্রথম থেকেই রামের অভিষেকের কথা জানিয়ে রাখলে মন্থরা নিশ্চয় রানি কৈকেয়ীকে প্রভাবিত করতে পারত না।
আমার বিশ্লেষণে বড় শাশুড়ি কৌশল্যা এবং স্বামী রামও অনেক পরিমাণে দায়ী। শ্বশুর হয়তো কিছু আশঙ্কা করে ছোট শাশুড়িকে অগ্রিম কথাটা বলে দেয়নি, তাবলে বড় শাশুড়ি কৌশল্যা ছেলের অভিষেকের কথা তাকে একবারও বলার প্রয়োজন মনে করল না। সম্বন্ধে সতিন হলেও অভিষেক, ছেলে মেয়ের বিয়ে সাদি এই ধরনের কাজে কোনো রাগারাগি থাকলেও নিজের মানুষকে নিজের মুখে একবার বলা উচিত। স্বামী রামচন্দ্র ছোটমাকে বড় ভালোবাসতেন। পিতার কাছ থেকে অভিষেকের খবরটা পাওয়ার পরে তিনি মা কৌশল্যার কাছে যেভাবে গিয়েছিলেন, মেজ শাশুড়ি সুমিত্রার কাছ থেকে যেভাবে হাঁটু গেড়ে বসে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই মাতা কৈকেয়ীর কাছে গিয়ে সেই শুভবার্তাটা দিয়ে তার আশীর্বাদ চাওয়াটা স্বামীর কর্তব্য ছিল। তাই আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে হয়তো স্বামী রামচন্দ্রের মনে ভরতের দিক থেকে কিছুটা শঙ্কা ছিল। অভিষেক সুন্দরভাবে হওয়ার পথে মাসি কৈকেয়ী বাধা নিষেধ আরোপ করতে পারে বলে তিনি হয়তো মনে মনে আশঙ্কা করেছিলেন। পিতা দশরথ মাসির কাছ থেকে কথাটা গোপন রাখার জন্য বললেও তিনি পিতাকে বোঝানো উচিত ছিল। স্বামীর পিতা রাজা দশরথকে বলা উচিত ছিল যে মাসির কাছ থেকে অভিষেকের খবরটা গোপন করলে তিনি অন্তরে খুব দুঃখ পাবেন। যদি মাসির অন্তরে কোনো অভিলাষ থেকে থাকে তাহলে রাজা সেটা পূরণ করলেই তিনি সুখী হবেন। এই কথাটা তিনি পিতা দশরথকে কেন বলতে পারলেন না সে কথা ভেবে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। নাকি পিতা কোনোরকমে সিংহাসন জোগাড় করে দেওয়াটা স্বামী মনে মনে কামনা করেছিলেন।
তাই আমার ধারণা হয় যে স্বামী রামচন্দ্র, শ্বশুর দশরথ,শাশুড়ি কৌশল্যা অভিষেকের কথা লুকিয়ে রাখার জন্যই এ রকম একটি ঘটনা ঘটল। আমি এই ভুলগুলি প্রত্যক্ষ করেছিলাম যদিও মুখ ফুটে কোনো কিছু বলতে পারিনি। কারণ আমি যে রাজ্যের বধূ,যে পুরুষের পত্নী,সেই পরিবারে উচিত-অনুচিত কথাগুলি নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচড়া করতে পারি, ব্যক্ত করতে পারিনা। কারণ সেই রাজ্যে, সেই ব্যক্তির কাছে নারী পুরুষের হাতের পুতুল মাত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন