সোমবার, ১০ মে, ২০২১

বিতৃষ্ণা সৌরভ কুমার চলিহা মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস

 বিতৃষ্ণা

সৌরভ কুমার চলিহা

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস





' এই যে দেখুন জামাইবাবু, ঠিক আপনি যেমন চাইছেন সেই ধরনের রুম', সহাস্য মুখে পিকলু বলল (আমার শালা), ‘এটা আপনার খুব পছন্দ হবে। এখানে এই কয়েকদিন থেকে আপনার ভালো লাগবে। সেকেন্ড ফ্লোর এবং থার্ড ফ্লোরে কয়েকটি রুম দেখিয়ে ছিল কিন্তু সেগুলি স্কোয়ার, আপনি যেমন চাইছেন অবলং নয় পাশে অন্যান্য রুমের হাল্লাও অনেক, শেষে আমি ইনসিস্ট করায় টপ ফ্লোরে  এটা পেয়ে গেলাম, জাস্ট দা রাইট সাইজ, নিরিবিলি-।'

অন্যমনস্কভাবে পিকলুর কথাগুলি শুনছি, মনে হচ্ছে যেন অনেক দূর থেকে শব্দগুলি আসছে, যেন রেকর্ড করা-হ‍্যাঁ, ঠিক এ রকমই একটি রুমের কথা আমি বলে থাকি- দীর্ঘ নিরিবিলি, রাস্তার হট্টগোল স্পর্শ করতে পারে না। পুবের দিকে দুটো জানালা, ভোরের রোদ আসে, সারাদিন ফুরফুরে বাতাস আসে, পর্দা কাঁপে, কাঠ এবং প্লাইউডের প্যানেলিং গুলিও আমি যেরকম চেয়েছিলাম পাতলা আখরোট রঙের, সম্ভব হলে একটা এসি(এখানে অবশ্য ফ্যান আছে) উত্তর দিকে একটি বড় জানালা,তার নিচে লেখাপড়া করার লম্বা টেবিল, বইয়ের থাক এবং  আলমারি, দূরের রাস্তা দেখা যায়, উঁচু উঁচু নারিকেল, সুপুরি-কলা- দেবদারুর শ‍্যামলিমা, তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, পাতাগুলি কাঁপে, গাছগুলি হেলে দুলে, ইচ্ছা হলে সেদিকেই তাকিয়ে থাকা যায়-’

মীরা প্রত্যাশিতভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, বলল,' পছন্দ হয়েছে কি? মাত্র তো কয়েক দিনের জন্য এবং-'

পছন্দের কথাই যদি উঠেছে, তাহলে কেবল কয়েকদিনের কথা কেন? হ‍্যাঁ, ঠিক আমি কল্পনা করার মতোই একটা রুম, কিন্তু কেমন যেন ধোঁয়াশা, নিরানন্দ একটি ছবি, যেন একটা এঁকে রাখা ছবি, দ্বিমাত্রিক এবং অসত্য, কিছু একটা যেন বুকটা চেপে ধরে - অনিশ্চয় সূচক  একটা 'হু'শব্দ করলাম( আর বিরক্ত ভাবে মনে মনে বললাম, ঠিক, পছন্দের রুম, কিন্তু এখানে এভাবে কে থাকতে চায়, নিয়ে যাও, এখনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, আমার নিজের বেডরুমে নিয়ে যাও-)

' আর দেখ, এদিক থেকে দূরের গাড়ি ঘোড়া ও দেখা যায়', মীরা বলল এবং উত্তর দিকের জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিল। গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, জানলাটা বাঁকা করে চোখে পড়ল, বিছানায় পা দুটি দিয়ে ছেঁচড়ে  পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম, একটা ব্যথা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, মীরা বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও ,আমি বালিশটা ঠিক করে দিই, এখানে হেলান দিয়ে নাও-',' না,পারব, পারব', ক্ষুব্ধস্বরে বললাম, আর বালিশে মাথাটা হেলান দিয়ে নিলাম । দেখলাম,কয়েকটা অট্টালিকার ফাঁক দিয়ে বহুদূরে রাস্তার একটা টুকরো দেখা যায়, একটা বাস স্টপ, একজন মানুষ অপেক্ষা করছে, বাস এল, মানুষটাকে আর দেখা গেল না, বাস চলে গেল, পুনরায় দুজন মানুষ এসে সেখানে সমবেত হল-ও , সেদিন পর্যন্ত তো আমিও এভাবে বাসস্টপে অপেক্ষা করেছি, বাস এসেছে, উঠেছি, বাস ছেড়ে দিয়েছে- আমিও কি আর এভাবে বাসে উঠতে পারব না, আমিও জানি-

পরিষ্কার নীল আকাশ,কেবল এখানে সেখানে দুই এক টুকরো মেঘ, এখন বাতাস নেই ,গাছের পাতা নিস্পন্দ, শ্রান্তভাবে চোখ ফিরিয়ে পূবের জানালার দিকে তাকালাম।  এইবিল্ডিংটার প্রায় গা ঘেঁষে অন্য একটি নির্মীয়মান দালান,এই তলাটার কিছু নিচে, দেখা যায় একটা কাঁচা ছাদ, শিল-ইটা- লোহা লক্কর এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মেঝেতে এখানে-সেখানে সিগারেটের প্যাকেট , কাঠের কুঁচি, ছেড়া কাগজ এবং প্লাস্টিকের ঠোঙা, পেপসির বোতল, দুটো সিমেন্টের বস্তায় মাথা দিয়ে একজন শ্রমিক লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। কাছে একটা লাল রংয়ের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক -বোধহয় ঠিকাদার বা মুহুরি -একটা ছোট খাতায় পেন্সিল দিয়ে কিছু একটা লিখছে- আমিও তো একদিন এভাবে আমার ঘরের ছাদ ঢালাই করার সময় উপরে উঠে গেছি, প্লাস্টিকের চেয়ার বা মোড়া একটাতে বসেছি। সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করা দেখেছি, ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলেছি। কখন ও দরকার পড়লে আমি কি পারব না এভাবে ছাদের উপরে হেলায় উঠে গিয়ে - নিচে আরও দেখা যায় সারি সারি কয়েকটি অসাম টাইপের কুটির, সবশেষে একটা মন্দিরের মতো দুতলা দালান দু'পাশে হাতির শুঁড়ের মতো রেলিং দিয়ে ঘেরা সিঁড়ি- ও ,জামাইবাবু, ওটা সত্য সাধন আশ্রমের ক্যাম্পাস, সকাল-সকাল সেখানে ছেলেমেয়েরা খুব সুন্দর সুর দিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র গায়, ভজন গায়, খুব শুদিং(Soothing) সেই ফিল্ডটিতে যোগাভ্যাস করে- আপনার শুনে খুব ভালো লাগবে-' সাদা ইউনিফর্ম পরা পরিচারিকা দুজন মীরাকে সুইচ গুলি বুঝিয়ে দিয়েছে, এটা  রুম সার্ভিস,এটা  ইমারজেন্সি, এটা টেলিফোনের এক্সটেনশন , এটা টিভির সুইচ এবং রিমোট, এটা দেরাজে কাপড়-চোপড়, এই সেলফে খাবার জিনিস রাখা যেতে পারে, টুথপেস্ট স্নো পাউডার ঔষধ পত্র ...মেয়ে দুটির কথাবার্তা এবং মীরার হু হা কানে এল যেন একটা বিমিশ্রিত চিৎকারের মতো,মন দিলে বোঝা যায়, কিন্তু কিছুই বোঝা যায় না ,যেন এক ঝাঁক মৌমাছির গুঞ্জন ,একটি শব্দের পর্দা ,ধ্বনি গুলির অর্থ আছে- কিন্তু অর্থহীন, অর্থহীন...।

এই গুঞ্জরণের মধ্যে ধুমধাম পদক্ষেপে এসে হাজির হল আমাদের পরিবারের ডক্টর জেহিরুদ্দিন আহমেদ ( বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক),ঝলমলে হাসি মুখ,' এই যে -এসে গেল? বেশ বেশ, ভালো হয়েছে, হাঃ হাঃ সব অ্যারেঞ্জমেন্ট টিপটপ? এখন কী রকম ফিল করছেন? ও দিদি, এখানে এসে কী রকম লাগছে? রুমটা সুন্দর। তাই না ?এটা তাদের এক ধরনের ভিআইপি রুম। এক্সপেন্সিভ অবশ্য ।কিন্তু হোয়াট অফ ডেট ?আপনাদের কয়েকদিন রিলাক্স মুডে কমফোরটেবলী কাটানো উচিত।এটাই মেইন কথা। একটা রিফ্রেশিং চেঞ্জ ,আলাদা সিন সিনারি, আলাদা মানুষ হাঃ হাঃ আচ্ছা দিদি ,আমাকে এখন যেতে হবে। (ঘড়ি দেখল), পরে আসব, দেখে যাব হাউ ইউ আর গেটিং অন-?'

বিব্রত ভাবে হাসলাম, মনে হল তার আনন্দ উৎসাহ নিতান্তই কৃত্রিম ,অর্থহীন-

' দাঁড়াও দাঁড়াও ,মীরা বলল এবং  কিছুটা দূরে গিয়ে কিছু একটা বলল, নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কথা ,কিন্তু আসলে, এইসবের কী অর্থ আছে, কী অর্থ থাকতে পারে-

' আচ্ছা ,আমিও আসি তাহলে এখন,মীরা বলল, ধোপার  কাছ থেকে তোমার পায়জামা গেঞ্জি বোধহয় এতক্ষণে রাজেন নিয়ে এসেছে, সেইসব না হলে তো হবেনা- তোমার ভাত খাওয়ার ইচ্ছা নেই বলছ, আমি কমপ্লান এবং কী কী পাই দেখে নিয়ে আসি- ও ,আর তুমি বলা জিনিস গুলি-,তুমি এখন বিশ্রাম নাও, ইচ্ছা হলে চা-কফি যা হয় কিছু একটা খেয়ে নিও- এই সৃইচটা টিপলে লোক আসবে- কিছু লাগলে নিচের ডেক্সে  ফোন কর। আর দেখ-।'

শব্দ, শব্দ, শব্দ। দরকারি কিন্তু তুচ্ছ ,নগণ্য trivial, অদরকারি, অর্থহীন, শব্দ, শব্দ ,শব্দ -রুমটা খালি হয়ে গেল।

  বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কোনো কিছু না ভাবার চেষ্টা করলাম, অর্থাৎ এখানে থাকলে  কী রকম অনুভব করে থাকব না ভাবার চেষ্টা করলাম। অর্থাৎ ভাবার চেষ্টা করলাম যে আমি এখানে থাকব না, আমি এখানে থাকতে পারব না...ভোর  হয়েছে, জানলা দিয়ে প্রবেশ করছে পাতলা মিষ্টি রোদ আর ফুরফুরে বাতাস ,জানালার কার্নিশে দুটো শালিকের কিচিরমিচির, নিচে দূরে কোথাও সমবেত কণ্ঠে কিশোর-কিশোরীর বন্দনা গানের রেশ পেতে চলেছে বোধ হয়। ওরা আমার চেয়ে অনেক আগে উঠেছে। গলা বাড়িয়ে দেখা  যায় হাতির শুড়ের  ঘরটার সামনের ঘাসে সাদা ইউনিফর্ম পরা দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা দুজন প্রশিক্ষক শিক্ষয়িত্রী, সত‍্য সাধন আশ্রমের দৈনন্দিনতার শুরু- দেখে ভালো লাগা উচিত, শুনে ভালো লাগা উচিত, কিন্তু কোনো ভাবাবেগ তো আসছে না, প্রতিক্রিয়া আসে কেবল একটা গভীর নির্লিপ্তি… সন্ধ্যে হয়েছে, ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে, নিচের কোথায় টিনের চালে সেই সেদিনের বিস্মৃত বাদল নুপুর রুমঝুম ঝু্‌ম, বই কাগজ গুলির উপরে একটা গোল আলোর ছাপ ফেলে ঢেকে দেওয়া টেবিল লাইট জ্বলছে, চোখ বুজে বুজে শুনছি জানালার পর্দা কয়েকটি বৃষ্টির ঝাপটায় পতপত করছে, হাতে হয়তো একটা সিগারেট এক কাপ কফি বা কিছু একটা ড্রিংক- কিন্তু না, এই রুমটিতে সেই সব বিসদৃশ যেন লাগে, অবাঞ্ছিত বলে মনে হয়, এই সুন্দর রুমটিতে সেইসব আমার চাই না, লাগেনা, ভাল লাগেনা, খারাপ লাগে, দুঃখ হয়, কষ্ট হয় ,ও কোমরের নিচের অংশে পুনরায় একটা জ্বালাময়ী ব্যথা চাড়া দিয়ে উঠছে, এক পাশে শোয়ার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। একহাতে কোমরের নিচে চাপ দিয়ে স্থির হয়ে পড়ে থেকে ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম... শব্দ, কারও কথাবার্তা... ও, দরজাটা কিছুটা খোলা রয়েছে, মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে আবার খুলে যাচ্ছে, কোনমতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেখলাম দরজাটা আরও কিছু মেলে দেওয়া যায়, ও ওই যে আধাআধি বাঁকা করে দেখাযায় করিডোরের ও পাশের প্রতিবেশী ২১৩ নম্বর রুম দরজাটা আধ খোলা, দরজার বাইরে একজন চশমা পরা মাঝবয়সী মানুষ সাফারি সুট পরা, হাতে একটা সুটকেস, দরজা মুখে শাড়ি পরা একজন আধবয়সী মহিলা, ডান হাতে একটা পান জর্দা বাক্স সেখান থেকে মানুষটা পান একটা মুখে ভরিয়ে দিয়েছে। দুজনের ফাঁক দিয়ে দরজার ভেতর দিকে ফ্রক পরা একটি ছোট মেয়ে হুইল চেয়ারে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং হাত তুলে মানুষটাকে কিছু বলছে। মহিলাটি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে এবং মৃদু স্বরে কিছু বলছিল, মানুষটা স্যুটকেসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে মেয়েটির গালে এবং চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যায় না- পারলে কি আর এই দুদিন থেকে যেতাম না, এরকম হঠাৎ কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম এসে যাবে কে জানত, কেঁদনা সোনামণি, আর দুদিন পরে তো এখান থেকে বেরোবে- স্পষ্ট বোঝা যায় না, কিন্তু বোধহয় মানুষটার হঠাৎ জরুরি টেলিগ্রাম এল, তাকে আগামীকাল যেভাবেই হোক কলকাতায় গিয়ে পৌঁছাতে হবে। মানুষটা স্যুটকেসটা তুলে নিল। হুইল চেয়ার এবং মহিলা ভেতরে ঢুকে গেলেন,২১৩ নম্বর রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। ব্যাথাটা কমে আসছে,আঃ কী ভাগ্যবান মানুষ, এখন টেলিগ্রামের কল্যাণে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল, কীলাকি মানুষ- আর আমি, আমি কবে...

দরজার বাইরে পায়ের শব্দ, কথাবার্তা, দরজা খুলল,মীরা এবং পিকলু, হাতে বিভিন্ন প্যাকেট।‘ এই যে আমরা এলাম। তুমি আছ?’ কর্কশ কন্ঠে বললাম, ‘না থেকে আর কি করব? কী বাজে কথা জিজ্ঞেস করছ?কোথায় যাব? কীভাবে যাব?’

মীরা থমকে দাঁড়াল, আমার মুখের দিকে তাকাল, পিকলু ও থমকে দাঁড়াল( তার মুখের ‘জামাইবাবু, এখন কেমন-’ বন্ধ হয়ে গেল) তারপরে অবরুদ্ধ কন্ঠে মীরা মৃদু অভিযোগের সুরে মীরা বলল-‘ কেন এভাবে রাগ করছ? কথার কথা মাত্র বলেছি- ও, তোমার সবগুলি কাপড় পেয়েছি। কিছু খেয়েছ কি?’ ঠিক আছে, এখনই কিছু একটা করে দিচ্ছি। তোমার কমপ্লান এনেছি, ক্রিম কেক এনেছি, চকলেট হরলিক্স, ক্যাডবেরি চকলেট পেয়েছি, অ্যাপেল টাপেল ও কিছু এনেছি- ও এই যে তোমার নোটবুকটা- এই নাও আজকের কাগজ- আর এটা তোমার আগাথা ক্রিস্টি-( আড়চোখে তাকালাম 4-50 From Paddington –বড়িয়া, ডিটেকটিভ কাহিনি, মিস মাপল  আছে, কিন্তু এখানে তো আর সেটা উপভোগ করতে পারবনা, কোনো ইন্টারেস্ট পাব না- ও আর আজকের কাগজ, কে পড়তে পারে সেই সব অখাদ্য মাথামুণ্ডু...)

মীরা ঘণ্টা টিপেএকজন পরিচারিকাকে ডাকল,ঠোঁট চেপে ক্লিষ্ট মুখে মেয়েটির সঙ্গে কিছু বলতে লাগল, পিকলু আমার কাছে বসে নিয়ে ঘনঘন হাত ঘড়ি দেখতে লাগল, বলে উঠল, দিদি, আমি তো এখন আর থাকতে পারব না। যাই এখন- জামাইবাবু, আপনি বসু্‌ন, আমি আবার আটটার সময় আসব-।’

‘দাঁড়া, দাঁড়া, কফি খেয়ে যা।’

‘না দিদি, টাইম হবে না, এলাম- আটটার সময় তো একবার আসবি-প্রায় পলায়ন করার মতো পিকলু আমার দিকে তাকিয়ে একটা অনিশ্চয় হাসি হেসে বেরিয়ে গেল। পরিচারিকা ও বেরিয়ে গেল

‘ নাও, এটাই এখন খেয়ে নাও।’

দু'কাপ ধূমায়মান কফি,সজীব গন্ধ,  দুটি প্লেটে দুটুকরো ক্রিম কেক,দেখতেই সুস্বাদু কিন্তু যেন কিছু জিদে জোর করে খাবার অনিচ্ছে একটা আনার চেষ্টা করলাম। মীরাও পাশে বসল, মুখ চাপা। মনে হল যেন একবার নিঃশ্বাস টেনে ফুঁপিয়ে উঠল, চোখ ছল ছলে, চামচ দিয়ে কফি নাড়ালো। চাপা কন্ঠে বলল,-‘ তুমি এরকম করতে থাকলে আমি কী করব, আমি কী দোষ করেছি।’

আমিও চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে কফি নাড়ালাম এবং বললাম,‘  না তোমাকে আর কোথায় দোষ দিলাম।’

‘তোমার মন-মেজাজ ভালো হবে বলে এখানে এলাম, অন্য পরিবেশ পাবে, আলাদা আলাদা মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, ভালো লাগবে। সবাই মিলে তোমাকে সমস্ত সুবিধা করে দিয়েছে, সব রকম আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এই দুই-তিনদিন চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে রিলাক্স মুডে মনটা ফুর্তিতে রেখে কাটিয়ে দিলেই তো হল, মীরা আরও একবার ফুঁপিয়ে উঠল, আঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছল, বলল, না সব সময় মুখ  গুমড়ে রয়েছ, মুখ বিকট করে রেখেছ- আমিও তো মানুষ, আমাকে এত  কষ্ট দিয়ে তুমি কী সুখ পাও-।’

‘না, তোমাকে কেন কষ্ট দিতে যাব,কষ্ট তুমি নিজেই পাচ্ছ।’

‘এভাবেই যদি এখানে কাটাতে হয় তাহলে কেন এখানে এলে-?’

‘এখানে এসেছি? কোথায় আমি এখানে এলাম? আমি তো নিজে আসিনি ,নিজে আসতে পারলে তো কথাই আলাদা ছিল। এখানে স্ট্রেচারে করে তুলে আমাকে নিয়ে এলে। আমার স্কুটার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আমার পা ভেঙেছে, দুদিন পরেই ডঃ আহমেদ অপারেশন করে ঠিক করে দেবে, চার দিন পরেই আমি এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি যেতে পারব –সব বুঝতে পারছি, এই কয়েকটি দিন তোমাদের চাওয়া অনুসারে হাসি ফুর্তিতে থেকে পার করে দিতে পারি, কিন্তু এটাও কি বুঝতে পার না  যে  আমার জন্য  এটা একটা প্লেজার ট্রিপ  নয়,এটা একটা হলিডে হোম নয় , এটা একটা হাসপাতাল -।'

------------


লেখক পরিচিতি-১৯৩০ সনে অসমের মঙ্গলদৈ শহরে সৌরভ কুমার চলিহার জন্ম। এটা ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সুরেন্দ্রনাথ মেধি। অসমিয়া ছোটগল্পের নতুন রীতির প্রবর্তক সৌরভ কুমার চলিহা পঞ্চাশের দশকে ‘অশান্ত ইলেকট্রন’ নামে একটি গল্প লিখে সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ গুলি যথাক্রমে ‘অশান্ত ইলেকট্রন’, ‘এহাত দাবা’, ‘গোলাম’, ‘জন্মদিন’ ‘নির্বাচিত সংকলন’দুপুরিয়া ইত্যাদি। গোলাম গ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন ।২০১১ সনে মৃত্যু হয়।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...