স্মৃতিকথা - ১০
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
। ১০ ।
( গত মাসের পর)
নীলাঞ্জন কুমার
( গত মাসের পর)
আমার একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল হরি সিনেমার ভেতরের করিডোরে প্রতি নতুন সিনেমায় স্টিল ফটো দেখে তার ডায়লগ কেমন হবে বা ঘটনাটা কেমন হবে এ নিয়ে অনেকক্ষণ কল্পনা করা । বাড়িতে রবিবার দুপুরে রেডিওতে ' অনুরোধের আসর ' হতো আড়াইটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত । আসলে রবিবার সকাল থেকে আমার ছিল দারুণ সময় । সকালে রেডিওতে শুনতাম 'শিশু মহল ' যাতে ইন্দিরা দেবী সকাল সাড়ে নটায় বলতেন ' ছোট্ট সোনা বন্ধুরা ভাই আদর আর ভালো বাসা নাও । কি ভালো আছোতো সব? ' তখন বাচ্চারা বলে উঠত সব ' হ্যাঁ ' । সকাল নয়টায় ছিল ' সঙ্গীত শিক্ষার আসর ' পঙ্কজ কুমার মল্লিকের পরিচালনয় শুনে শুনে শিখে নিয়েছিলাম রবীন্দ্র সঙ্গীত ' না না ভুল কোরো না গো ভুল করো না ' আর ' নজরুল গীতি ' ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি ' গান দুটি । তার সঙ্গে অনেক পাগলামি ঘিরে ছিল আমাকে । মনে আছে একটা হাস্যকর ঘটনা, মা বাড়ির দালানে দুই বাটিতে কুরে রেখেছিল নারকেল । আমি আর ছোড়দি ছাদ থেকে এসে দেখি কেউ কোথাও নেই শুধু দুই বাটিতে নারকেল কোরা রাখা । একটি বাটিতে অন্য বাটির থেকে অনেকটা বেশি । দিদি বললো, ' দ্যাখ কি সুন্দর নারকেল কোরা, ওগুলো আমার আর তোর জন্য রাখা আছে । তুই ছোট তাই তোরটা কম । আমরা মহানন্দে খেতে শুরু করলাম। দিদির শেষ হবার আগেই আমার বাটি ফাঁকা । ছোড়দি শেষ করার আগে রান্না ঘরের থেকে মা বেরিয়ে আমাদের খাওয়া দেখে ' হায় হায় ' করতে করতে ছোড়দির হাত থেকে বাটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ' সকলের জন্য নারকেল রেখেছিলাম, তোরা দুজনে খেয়ে নিলি? ' শেষে বাকি সকলের জন্য ছোড়দির বাটির সামান্য অবশেষ জুটেছিল ।
বলা যায় বেলা ভবনে থাকার সময় থেকে আমার বোধ ও বিবেচনা পোক্ত হতে শুরু করে । একটি ছোট্ট ছেলের কাছে বিরাট ছাদ বিরাট দালান আর তিনটি ঘর অবশ্যই অনেকটা । হাত পা ছড়িয়ে যথেষ্ট নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচা যায় ।নিয়মিত স্কুল যাওয়া ও সন্ধ্যায় পড়াশোনা বাদ দিলে সাংস্কৃতিক দিকটি বাড়িতে বেশ উজ্জ্বল ছিল । আমরা তিন ভাই বোন ( দাদা নির্লিপ্ত থাকতো ) মাঝে মধ্যে লাগিয়ে দিতাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাড়ির ভেতরে । মা বাহবা দিতো । দুঃখ ছিল শ্রোতার অভাব । রাতে স্বপ্ন দেখতাম আমরা অনুষ্ঠান আর বাড়ির দালান ভরা মানুষ শুনছে আর হাততালি দিচ্ছে । আমরা মাঝেমধ্যে মিটিং এ বসতাম, কত পরিকল্পনা করতাম আর অতি সামান্য তা বাস্তবায়িত হত । বাড়িতে আমার খেলার সামগ্রী বলতে ছিল একটা ট্রাই সাইকেল, যা দাদার ছোট্ট বেলায় কেনা হয়েছিল । পরে দিদিদের হাত ঘুরে আমার হাতে এসেছিল । ঐ সাইকেলে আমায় বসিয়ে দূই দিদি টেনে টেনে সারা দালান ঘুরত । দারুণ আনন্দ পেতাম । ষাটের দশকের ছোটদের তেমন চাওয়া পাওয়া বিষয় ছিল আজকের দিনের থেকে নগন্য । তাতে ।আমরা ছিলাম খুশি । পার্থিব জিনিসের প্রতি অহেতুক আকর্ষণ , জন্মদিনের কেক কাটা , গিফট ইত্যাদি তখন ছিল কল্পনার বাইরে । আমরা জানতামই না আমাদের জন্মদিন ও বছর ।জন্মদিনে আলাদা করে কোন আয়োজন করা হত না । আমরা সে সব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না । তবে মায়ের চার ছেলে মেয়ে মানে ভরা সংসার আর আর তা নিয়ে মায়ের আলাদা আনন্দ ছিল । তবে সে আনন্দ কোনদিন আতিশয্যে পৌছোয়নি । তবে স্বাভাবিক ভাবে দাদার সম্পর্কে বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে একটু বেশি প্রাধান্য দিলেও তার ভেতরে সংযম ছিল । মায়ের স্বপ্ন ছিল দাদা খুব ভালো রেজাল্ট করে ভালো চাকরি করবে তা মায়ের কথার স্পষ্ট হয়ে যেত ।
তবে বাবা ছিল একেবারেই অনাসক্ত । ছেলেমেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ত তা মনে থাকত না । এ নিয়ে বাড়িতে হাসাহাসি হত। রেজাল্ট বেরলে বাবা জিজ্ঞাসা করত পাস না ফেল । পাস মানে আনন্দ । আমরা খুশি করতে পারতাম । তখন এখনকার মত পরীক্ষা নিয়ে পারিবারিক আদিখ্যেতা ছিল না ।ফলে আমরা যথেচ্ছ খেলাধূলা, গানবাজনা করেছি । পড়ার বিষয় বাবা কিছু দেখিয়ে দিত । আমরা যতখানি অ্যাকাডেমিক দিক থেকে পৌঁছাতে পেরেছি তা মা'র স্বপ্ন স্নেহ ও শাসনের গুণে । ( চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন