নস্টালজিয়া ৪২
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
আমার ঠাকুর্দা বা দাদু আমি কাউকেই দেখি নি। আমার মা ছিল শৈশবে পিতৃহারা আর বাবা যৌবনে। আমার পরিবারের কেউ পূর্ববঙ্গ থেকে আসে নি। আমার ঠাকুমা বা দিদা এদের কারো জীবনে কাঁটা তারের বেড়া টপকে আসার দুঃখ দুর্দশার কাহিনি তাই কখনো শুনিনি আমি। বাবার কাছে শুনেছিলাম স্বাধীনতার ঠিক আগের রাত্রে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তান হয়ে যাবার সম্ভাবনা ও সেই সময়ের আতঙ্কের কিছু কথা।এদেশের এক স্বচ্ছল পরিবার ছিল আমাদের এটা বুঝতে পেরেছি বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের লালবাগের কুর্মিটোলাক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা থাকত একথা ছোটবেলায় শুনতাম। আমাদের প্রতিবেশীরা কে বাঙাল কে ঘটি এসব নিয়ে কথা বলতো না। এই শব্দগুলো স্কুলে যাবার পরে বন্ধু দের মুখে শুনেছি। আমার পিতামহের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে চন্দননগরে একটি রেশমের কাপড় তৈরির কারখানা ছিল। তিনি সেখানেই বেশি থাকতেন। ঠাকুমা অর্থাৎ যাকে আমি 'দাদা' বলতাম তিনি বিয়ের পর থেকে থাকতেন তাঁর শাশুড়ির কাছেই । আমার ঠাকুমা খুব গর্বের সঙ্গে গল্প করতেন তাঁর বাবা ঘোড়ায় চড়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে দেখতে আসতেন। তিনি ধনী পিতার আদরের কন্যা ছিলেন। মাতৃহারা আমার ঠাকুমার মাত্র সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরে প্রথম দিকে দৌলতাবাদে তাঁর বাবার বাড়িতেই অধিকাংশ সময় থাকতেন। মস্ত কড়াইএ করে দুধ ফুটতো তাঁর বাপের বাড়িতে। একবার রাগ করে ফুটন্ত দুধের কড়াইতে তিনি তেঁতুল ফেলে দেন। সব দুধ ছানা কেটে যায় কিন্তু তাঁর বাবা তাতে একটুও বকে নি মেয়েকে এসব গল্প খুব আনন্দের সঙ্গে বলতেন শ্বশুর বাড়িতে বিধবা শাশুড়ির কাছে থাকতেন। ব্রাহ্মণের বিধবা হওয়া সত্ত্বেও ছোট্ট বৌমাকে ভিজে কাপড়ে মাছ রান্না করে শাশুড়ি খাওয়াতেন। তারপর গঙ্গায় স্নান করে আসতেন । কিন্তু ডিম খাওয়া খুব সমস্যা ছিল। বাড়িতে ডিম ঢোকা তখন নিষেধ ছিল। একবার তাঁর এক বন্ধুর কাছে একটা ডিম চেয়ে এনে ঠাকুমা উঠোনের কোনে সাতদিন ধরে সেদ্ধ করেও সেই ডিম সেদ্ধ হচ্ছে না বন্ধুকে সেকথা বলাতে সে আশ্চর্য হয়ে দেখতে আসে। শাশুড়ি তখন গঙ্গাস্নানে গেছেন। ঠাকুমা রোজ ডিমটাকে টিপে দেখতেন কতটা সেদ্ধ হলো। এই আনাড়িপনা দেখে তার শৈশবের বন্ধু তো হেসে অস্থির। সেদ্ধ ডিম ছাড়িয়ে খেতে হয় এই বিষয়ে আমার ঠাকুমা প্রথমে এতটাই অনভিজ্ঞ ছিল। এইসব গল্প কথা আমি ছোটবেলায় বর্ষার রাতে তাঁর কাছে শুয়ে শুয়ে শুনতাম। শুনতাম টুনটুনির গল্প, ফিঙে পাখির গল্প, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, আলিবাবা- চল্লিশ চোরের গল্প । আমার শৈশব ও কৈশোর এইভাবে গল্প রসে জাড়িত হয়েছিল। পিতামহ দু'হাতে উপার্জন করতেন। যতদিন আমার ঠাকুমার বিধবা শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন শক্ত হাতে সংসার চালাতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে আমার ঠাকুমা তাঁর স্বামীর রোজগারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন নি। তিনি মোটেই সঞ্চয়ী ছিলেন না । অনেক বান্ধবী ছিল তাঁর। তাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেয়ে ,গল্প -গুজব করে দিন কাটিয়ে দিতেন। বাড়িতে রান্নার আয়োজন বরাবরই খুব ভালো ছিল আমাদের। অনেক অর্থ তিনি সবার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে খরচ করেছিলেন। টাকা ধার হিসেবে যাদের দিতেন তারা শোধ করে নি কখনো। এই সাংসারিক ঔদাসীন্য আমার বাবার মধ্যেও ছিল। রোজগার আর খরচের মধ্যে ব্যবধান বিশেষ ছিল না তারও।
আমার ঠাকুর্দা বা দাদু আমি কাউকেই দেখি নি। আমার মা ছিল শৈশবে পিতৃহারা আর বাবা যৌবনে। আমার পরিবারের কেউ পূর্ববঙ্গ থেকে আসে নি। আমার ঠাকুমা বা দিদা এদের কারো জীবনে কাঁটা তারের বেড়া টপকে আসার দুঃখ দুর্দশার কাহিনি তাই কখনো শুনিনি আমি। বাবার কাছে শুনেছিলাম স্বাধীনতার ঠিক আগের রাত্রে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তান হয়ে যাবার সম্ভাবনা ও সেই সময়ের আতঙ্কের কিছু কথা।এদেশের এক স্বচ্ছল পরিবার ছিল আমাদের এটা বুঝতে পেরেছি বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের লালবাগের কুর্মিটোলাক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা থাকত একথা ছোটবেলায় শুনতাম। আমাদের প্রতিবেশীরা কে বাঙাল কে ঘটি এসব নিয়ে কথা বলতো না। এই শব্দগুলো স্কুলে যাবার পরে বন্ধু দের মুখে শুনেছি। আমার পিতামহের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে চন্দননগরে একটি রেশমের কাপড় তৈরির কারখানা ছিল। তিনি সেখানেই বেশি থাকতেন। ঠাকুমা অর্থাৎ যাকে আমি 'দাদা' বলতাম তিনি বিয়ের পর থেকে থাকতেন তাঁর শাশুড়ির কাছেই । আমার ঠাকুমা খুব গর্বের সঙ্গে গল্প করতেন তাঁর বাবা ঘোড়ায় চড়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে দেখতে আসতেন। তিনি ধনী পিতার আদরের কন্যা ছিলেন। মাতৃহারা আমার ঠাকুমার মাত্র সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরে প্রথম দিকে দৌলতাবাদে তাঁর বাবার বাড়িতেই অধিকাংশ সময় থাকতেন। মস্ত কড়াইএ করে দুধ ফুটতো তাঁর বাপের বাড়িতে। একবার রাগ করে ফুটন্ত দুধের কড়াইতে তিনি তেঁতুল ফেলে দেন। সব দুধ ছানা কেটে যায় কিন্তু তাঁর বাবা তাতে একটুও বকে নি মেয়েকে এসব গল্প খুব আনন্দের সঙ্গে বলতেন শ্বশুর বাড়িতে বিধবা শাশুড়ির কাছে থাকতেন। ব্রাহ্মণের বিধবা হওয়া সত্ত্বেও ছোট্ট বৌমাকে ভিজে কাপড়ে মাছ রান্না করে শাশুড়ি খাওয়াতেন। তারপর গঙ্গায় স্নান করে আসতেন । কিন্তু ডিম খাওয়া খুব সমস্যা ছিল। বাড়িতে ডিম ঢোকা তখন নিষেধ ছিল। একবার তাঁর এক বন্ধুর কাছে একটা ডিম চেয়ে এনে ঠাকুমা উঠোনের কোনে সাতদিন ধরে সেদ্ধ করেও সেই ডিম সেদ্ধ হচ্ছে না বন্ধুকে সেকথা বলাতে সে আশ্চর্য হয়ে দেখতে আসে। শাশুড়ি তখন গঙ্গাস্নানে গেছেন। ঠাকুমা রোজ ডিমটাকে টিপে দেখতেন কতটা সেদ্ধ হলো। এই আনাড়িপনা দেখে তার শৈশবের বন্ধু তো হেসে অস্থির। সেদ্ধ ডিম ছাড়িয়ে খেতে হয় এই বিষয়ে আমার ঠাকুমা প্রথমে এতটাই অনভিজ্ঞ ছিল। এইসব গল্প কথা আমি ছোটবেলায় বর্ষার রাতে তাঁর কাছে শুয়ে শুয়ে শুনতাম। শুনতাম টুনটুনির গল্প, ফিঙে পাখির গল্প, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, আলিবাবা- চল্লিশ চোরের গল্প । আমার শৈশব ও কৈশোর এইভাবে গল্প রসে জাড়িত হয়েছিল। পিতামহ দু'হাতে উপার্জন করতেন। যতদিন আমার ঠাকুমার বিধবা শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন শক্ত হাতে সংসার চালাতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে আমার ঠাকুমা তাঁর স্বামীর রোজগারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন নি। তিনি মোটেই সঞ্চয়ী ছিলেন না । অনেক বান্ধবী ছিল তাঁর। তাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেয়ে ,গল্প -গুজব করে দিন কাটিয়ে দিতেন। বাড়িতে রান্নার আয়োজন বরাবরই খুব ভালো ছিল আমাদের। অনেক অর্থ তিনি সবার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে খরচ করেছিলেন। টাকা ধার হিসেবে যাদের দিতেন তারা শোধ করে নি কখনো। এই সাংসারিক ঔদাসীন্য আমার বাবার মধ্যেও ছিল। রোজগার আর খরচের মধ্যে ব্যবধান বিশেষ ছিল না তারও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন