বিদেহ নন্দিনী
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(চার)
বাসি বিয়ের দিন বিদায় পর্ব আরম্ভ হল। সবার আগে বিদায় নিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। আমাকে জীবনের সঙ্গী জোগাড় করে দিয়ে যেতে উদ্যত ঋষির চরণ স্পর্শ করে আমি নিজেকে ধন্য ভেবেছিলাম। মিথিলা নগরীতে আবার আনন্দের জোয়ার এল।চার মেয়েকে একই দিনে পতিগৃহের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে হল। সবারই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।পিতা জনক কিছুক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন যৌতুক হিসেবে অযোধ্যায় পাঠানো জিনিস গুলি ঠিকঠাক করে দেওয়ায়। যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল অজস্র সোনা-দানা, মনি-মুক্তা, পাট এবং কাপাসের বস্ত্র, অসংখ্য অলংকারাদি, ঘোড়া-হাতি, পদাতিক সৈন্য, অসংখ্য দাস-দাসী।
আমরা চারজন মান্যজনকে প্রণামাদি করে চোখের জলে দুগাল ভাসিয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা রথে গিয়ে বসলাম। পিতা অনেকদূর পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিলেন।
আত্মহারা হয়ে স্বামী রামচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে আসতে আসতে কতদূর পৌঁছেছিলাম লক্ষ্যই করিনি। মাঝখানে হঠাৎ তুফান এল। ভূমি কাঁপতে শুরু করল,গাছপালা উপড়ে গেল। চারপাশে ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে গেল। সবাই ভয় পেল। আমিও ভয়ে কেঁপে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরে এরকম ঘটনা ঘটার কারণ বুঝতে পারলাম। ক্ষত্রিয়দের শত্রু পরশুরামের আবির্ভাব। এতদিন আমি কেবল পরশুরামের নাম শুনেছিলাম। কারণ তাঁর ক্ষত্রিয় নিধন কার্যের জন্য মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। একজন রাজা তার পিতাকে হত্যা করার জন্য পরশুরাম সমগ্র ক্ষত্রিয় কূল নির্মূল করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করে একাদিক্রমে ক্ষত্রিয় নিধন করা শুরু করেছিলেন। এখন সেই পরশুরামের আবির্ভাবে আমার অন্তরে ত্রাসের সৃষ্টি হল। তাঁর ভয়ঙ্কর চেহারা স্বচক্ষে দেখলাম। পরশুরামের এক বাহুতে ঝুলছিল একটি প্রকাণ্ড ধেনু।স্বামী রামচন্দ্র মিথিলায় গুণ লাগিয়ে ভেঙ্গে আসা হরধেনুর মতো বিশাল ধেনু। এক হাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা সেই কুঠারটা এবং অন্য হাতে তূণের মধ্যে চকচক করছে কয়েকটি তীর। মাথায় একটা বিশাল জটা বাঁধা চুলের খোপা। শ্বশুর দশরথ, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ এবং অন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা পরশুরামকে নিয়ম অনুসারে সেবা করলেন। তাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করে পরশুরাম স্বামী রামচন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘দশরথ নন্দন, তোমার শৌর্য-বীর্যের কথা শুনেছি। তুমি রাজা জনকের রাজসভায় থাকা হরধেনুতে গুণ লাগিয়ে এভাবেই টানলে যে ধেনুটা ভেঙ্গে পড়ে রইল।’
তারপর তিনি নিজের বাহুতে ঝুলিয়ে রাখা ধেনুটা দেখিয়ে বললেন-‘এটা আমার ধেনু। এই ধেনুটা তুমি ভেঙ্গে আসা ধেনুর সমান।এই ধেনু ছিল বিষ্ণুর। আমার পিতাকে বিষ্ণু দান করেছিলেন। তুমি যদি এই ধেনুতে গুন লাগাতে পার, তাহলে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার মত যোগ্যতা অর্জন করেছ বলে ভাবব।’
ঋষির কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এমনিতেই আমাদের যাত্রাপথে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল।শ্বশুর দশরথ সেইসব অশুভ লক্ষণ বলে ভয় পেয়েছিলেন। অবশ্য ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ রাজাকে সেরকম ভাবে চিন্তা না করার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ক্ষত্রিয়কে পরম শত্রু বলে জ্ঞান করা জমদগ্নিপুত্র পরশুরামের ব্যবহারে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল।
শ্বশুর দশরথ কিছু অঘটন ঘটার ভয়ে ঋষি পরশুরামকে অনুনয়-বিনয় করে বললেন-‘হে ঋষিবর, আপনি ব্রাহ্মণ। শুনেছি আপনি নাকি ক্ষত্রিয়ের উপরে প্রতিশোধ নিয়ে খুশি হয়ে সেই ক্রোধ রাগ ছেড়ে দিয়েছেন। দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে প্রতিজ্ঞা করে আপনি দিগ্বিজয় করা পৃথিবী মহর্ষি কাশ্যপকে অর্পণ করে বনে চলে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে তপস্যাই আপনার কুলে শোভা পায়। এই কোমলমতি রাজকুমারকে আঘাত করার মানসে আসাটা আপনার পক্ষে অশোভনীয়। এই রাজকুমার আপনার কোনো ক্ষতি করেনি। এই পুত্র আমার প্রানের চেয়েও বেশি আদরের।’
কিন্তু পরশুরাম শ্বশুর দশরথের কথায় বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতে দৃঢ় হয়ে রইলেন। বিবাহ সম্পন্ন করে বর-কনে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসা দলের প্রতি তিনি কোনো আগ্রহ দেখালেন না। মাত্র তর্জন গর্জন করে অহংকারী মনে পুনরায় স্বামী রামচন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘বিশ্বকর্মা প্রথমে দুটি ধেনু তৈরি করেছিলেন। তারই একটি রুদ্রকে এবং অন্যটি বিষ্ণু কে দিয়েছিলেন। তুমি গুণ লাগিয়ে দু'টুকরো করে ভেঙ্গে আসা ধেনুটা ছিল মহাদেব শিবের। এটি বিষ্ণুর। এখন যদি তুমি বিষ্ণুর ধেনুটাতে গুণ লাগাতে পার তাহলে তোমার কৌশল এবং শক্তির প্রমাণ পাব এবং তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমাকে সম্মানিত করব।’
পরশুরামের অহংকারী কথাবার্তা শুনে স্বামী রামচন্দ্র নম্রভাবে বললেন-‘ হে জমদগ্নি পুত্র পরশুরাম, আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি যে একজন ক্ষত্রিয় রাজা আপনার পিতাকে হত্যা করার জন্য আপনি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নেমে পড়েছেন। তার জন্য আপনাকে দোষ দিই না। কিন্তু আপনি অন্য ক্ষত্রিয়দের বশ করার মতো আমাকে পারবেন না। আপনার ধেনুটা আমাকে দিন। আমি নিশ্চয় এতে গুণ লাগাব।’
স্বামী পরশুরামের কাছ থেকে ধেনুটা নিয়ে গুণ লাগালেন। তীর জুড়ে গুণ টানলেন। স্বামী গুণ টানার সঙ্গে সঙ্গে পরশুরামের মুখের জ্যোতি লোপ পেল। স্বামী রামচন্দ্র মুচকি হেসে পরশুরামকে বললেন –‘হে দেব,বিষ্ণুর আশীর্বাদে শক্তিশালী এই বাণে একবার গুন লাগানোর পরে বিনা নাশে একে সম্বরণ করা সম্ভব নয়। তাই আপনিই বলুন এটা কী নাশ করবে? আপনার চলার শক্তি না তপস্যার ফল?’
এরপরে অহংকারের সুরে কথা বলা পরশুরাম একেবারে ধীর,স্থির, আত্মসংযমী ঋষির মতো বললেন-‘হে অযোধ্যা কুমার, তুমি কে সে পরিচয় পেলাম। আমার অহংকার খর্ব করার জন্য আমি বিন্দুমাত্র দুঃখ পাইনি বা মনঃক্ষুণ্ণ হইনি। আমার সমস্ত তপস্যার ফল তোমার কাছেই যাক। আমাকে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই মহেন্দ্র পর্বতে পৌছাতে হবে। তাই আমার চলন্ত শক্তি হ্রাস কর না। ধেনুতে জোড়া তীর আমার তপস্যার শক্তিকেই হ্রাস করুক।’ কথাটা বলে পরশুরাম স্বামী রামচন্দ্রকে প্রণাম জানিয়ে প্রদক্ষিণ করলেন এবং তার পরে একজন ধীর-স্থির সাধারণ ঋষির মতো সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমাদের দলের মধ্যে আনন্দের সীমা রইল না। শ্বশুর দশরথ এবং আমার তিনজন দেবর স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা চারজন নতুন বধূও তাকে অভিনন্দন জানালাম। আমি সেই সময় নীরবে একটি কথা লক্ষ্য করেছিলাম । এই ঘটনার পরে যেন আমার স্বামী আগের চেয়েও বেশি জ্যোতিষ্মান হয়ে পড়েছিলেন। আমি তার চরণ স্পর্শ করেছিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন