নস্টালজিয়া ৪৩
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
কৈশোরের দিনগুলো কি শুধুই পড়াশোনা আর মায়ের স্নেহ, বাবার আদরে মাখা ছিল? তা মোটেই না। একটু একটু করে যত বড়ো হয়েছি ফুলের মত জীবনও পাঁপড়ি মেলে ধরেছে। ডালে কাঁটা ছিল অনক। সজাগ হয়েছে মন। মা চারপাশের পরিবেশ, জীবন সম্পর্কে কিছু কিছু বিষয়ে শেখাতো।কোনোটা শুনতাম ,কোনোটা ভালো করে শুনতাম না। বড়ো হয়ে বুঝতে পেরেছি ঐ বয়সে মায়ের কথাগুলো কতটা মূল্যবান ছিল। আমার পিরিয়ড হবার পরে মা বলেছিল মেয়ে হিসেবে সতর্ক থাকতে হয় জীবনে।ছেলেদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা মা পছন্দ করতো না। তবে ছেলে বা মেয়ে সব বন্ধুর সঙ্গে একটা স্বচ্ছ সাবলীল সম্পর্ক থাকা দরকার একথা মা-ই আমাকে বলেছিল। আমি সাইকেল চালতে খুব ভালোবাসতাম। পিরিয়ডের সময় বেশ কয়েক দিন সাইকেল চালাতে দিতো না বলে রাগ করতাম মায়ের উপরে।
ক্রমশ চারপাশের মানুষ,পরিবেশ আত্মীয় স্বজন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভাবে ধরা দিয়েছে আমার মনে।ছোট থেকেই সবকিছু অবজার্ভ করতে ভালো লাগত আমার।আমাদের বাড়িতে মা সবসময় একটা মার্জিত রুচিশীল পরিবেশ বজায় রাখতো। তবে কাজের লোকের বিষয়ে খুব খুঁতখুঁতে ছিল। বাবার সঙ্গে মতের অমিল হতো সাংসারিক অনেক বিষয়ে। কাজ কর্মে ব্যস্ত মা রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ যেমন পড়তো তেমনি ভালোবাসতো রবীন্দ্রনাথের গান। সঞ্চয়িতা আর সঞ্চিতা থেকে আমি আর বোন খুব কবিতা পড়তাম, আর মা শুনতে ভালোবাসতো। ছোটদের সিনেমা দেখা মা মোটেই পছন্দ করতো না। আমাদের ওখানে তখন ছায়াবাণী একটি মাত্র সিনেমা হল।ঠাকুমার সঙ্গে সম্পূর্ণ রামায়ণ আর মহাভারত এই দুটো ছাড়া আর কোনো সিনেমা আমি ছোটবেলায় দেখি নি।বড়ো হয়ে প্রথম ভালো সিনেমা বলতেদেখেছিলাম বাবা মায়ের সঙ্গে 'হংসরাজ' বহরমপুরে কল্পনা হলে।
আমাদের পাড়ায় সব ঠিকঠাক হলেও একটা জিনিস সব মাটি করে দিয়েছিল বলে মনে হতো। সেটি হলো একটি দেশি মদের দোকান। বড়ো হবার পরে মা বেশি বাড়ি থেকে বেরোতে দিত না এই দোকানটির জন্য। যদিও আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ছিল দোকানটি। গঙ্গাস্নানের যাতায়াতের পথে ছিল সেই দোকান। অনেকটা দূর থেকেই ঐ দ্রব্যের মদির গন্ধ বাতাসে ভাসত। আমাদের বাড়িতে বাবাকে জীবনে মদ্যপান করতে দেখি নি, কিন্তু ঐ বস্তুর গন্ধের সঙ্গে খুব ছোটবেলা থেকেই পরিচিত হয়েছিলাম। ঐ দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা আড়চোখে দেখতাম কাচের খালি শিশি স্তূপাকারে পড়ে থাকতে। আর অনেককেই নেশা করে রাস্তায় ধুলোর মধ্যে পড়ে থাকতে দেখতাম। পাড়ার মধ্যে সেই দোকানটি নিয়ে কারো তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। আজও ঐ দোকানটি পুরোনো নেমপ্লেট নিয়েই বহাল তবিয়তে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন