ঐতিহ্যবাহী গাজন উৎসব
নরসিংহ দাস
'আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই, ঠাকমা গেছে গয়া কাশি ডুগডুগি বাজাই।'- ছড়ার গানে রয়েছে শিবের গাজন। পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের এক ঐতিহ্যবাহী হিন্দু লোকউৎসব গাজন। শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রীক উৎসব এই গাজন। বাংলা গাজন শব্দটি 'গর্জন' শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচন্ড গর্জন করেন বলেই এমন নাম। অন্যদিকে গাজন শব্দটি দুটি শব্দের মিলন। 'গা' শব্দটি 'গাঁ' অর্থাৎ গ্রাম এবং 'জন' শব্দটি জনসাধারণকে বোঝায়। অর্থাৎ গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এমন নাম। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী- দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয় এই দিনে। সন্ন্যাসীরা এই উৎসবে বরযাত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। অন্যমতে ধর্মঠাকুরের গাজন হল- ধর্মঠাকুর ও দেবী কামিনী-কামাখ্যার (বাঁকুড়া জেলা) বিবাহ উৎসব। রাঢ়বঙ্গের শৈবসংস্কৃতির এক বিশেষ অঙ্গ হল এই গাজন উৎসব।
গাজন বিভিন্ন নামে পরিচিত- শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন। আবার জেলায় জেলায় এর ভিন্ন নাম। মালদহ জেলায় 'গম্ভীরা', জলপাইগুড়ি তে 'গমীরা' নামে পরিচিত। বাংলা বর্ষপঞ্জির চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে এই উৎসব পালিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। ধর্মের গাজন বৈশাখ, জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালিত হয়। চৈত্র মাস ছাড়া বছরের অন্য সময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলে, তাকে 'হুজুগে গাজন' বলা হয়।
গাজন উৎসবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গাজন মেলা। নদীয়া জেলার নবদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে শিবলিঙ্গগুলি বৌদ্ধ প্রভাবিত। নদীয়ার দুই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও গিরিশচন্দ্র রায় - অলকনাথ ও ভবতারণ নামে শিবের প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও অন্যান্য শিবমন্দির জুড়ে গাজনের এই পাঁচদিন উৎসবে মেতে ওঠেন এলাকাবাসী। আবার বর্ধমানের মন্তেশ্বর গ্রামে গাজন উৎসবে কালীর আরাধনা করা হয়। প্রায় চারশো বছর ধরে এই ব্যতিক্রমী নিয়মে মানুষই কালীর বেশে পূজিতা হন। হুগলী জেলার তারকেশ্বরে তারকনাথ শিব, পূর্ব বর্ধমান জেলার কুড়মুনের ঈশানেশ্বর শিব, বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর শিবের গাজন উৎসব উপলক্ষে মেলা হয়। জৈষ্ঠ মাসের দশহরাতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের অযোধ্যা গ্রামের মনসার গাজন এবং আষাঢ়ি পূর্ণিমায় ঐ জেলার বেলিয়াতোড়ের ধর্মরাজ ঠাকুর, ছাতনা থানার ঝাঁটিপাহাড়ি এলাকায় জ্যৈষ্ঠ মাসের ২৫/২৬ তারিখে শিবকেন্দ্রিক 'হুজুগে গাজন' বিখ্যাত। এখানকার মেলায় আদিবাসী নৃত্য বিশেষ আকর্ষণ। এককালে কলকাতার কাঁসারিপাড়া ও জেলেপাড়ার সঙ বিখ্যাত ছিল।
বর্তমানে আধুনিক মেলা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে গাজন উপলক্ষে তেমন উন্মাদনা আর নেই বললেই চলে। তবে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে এখনও বহু এলাকায় গাজন উৎসব উপলক্ষে জনসমাগম হয়। গাজনের সঙ্গে চড়ক পূজা উপলক্ষ্যে কুমিরের পূজা, জলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির উপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পুজো করা হয়। এককথায় ঐতিহ্যবাহী গাজন উৎসব উপলক্ষে এই কদিন গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা থাকে চরমে।
নরসিংহ দাস।
রবীন্দ্রনগর। পশ্চিম মেদিনীপুর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন