২০৮৪
ভাস্কর ঠাকুরীয়া
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই থাকে,তাই আমাদের অতীতের দিকে ঘুরে তাকানোর দরকার।প্রতিটি ক্লাসেই নয় কি?’বিদায় বেলায় প্রফেসর বিপ্লব ফুকন ছাত্র-ছাত্রীদের সে কথাই বললেন।ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গৃহযুদ্ধ,প্রাকৃ্তিক দুর্যোগ,দুর্ভিক্ষে জর্জরিত স্বদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা তাঁর মতো অবস্থানে থাকা যে কোনো লোকের জন্যই আবেগ চালিত চরম মূর্খামি।কিন্তু প্রফেসার ফুকন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল,কোনো কিছুই তার মনকে টলাতে পারে না।
‘শহিদ হওয়ার এতই যদি সখ এখানেই বন্দুক তুলে নাও,ইউরোপেতো গণশত্রুর অভাব নেই।’এনী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল।তাঁর অধীনে গবেষণা করার সময়ই ওদের দুজনের মধ্যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জলপানিতে দুজন অখ্যাত গণশত্রু লালুকসোলা এবং বদন বরফুকনের বংশগাঁথনি সম্পর্কে এনী গবেষণা করছিল।গত কয়েকদশকের ঘটনারাজি সৃষ্টি করা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সচেতনতা এবং বিপ্লব ফুকনের অহরহ যত্ন এবং জনপ্রিয়তার জন্য আজকাল ইউরোপের ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে পূর্ব হিমালয়ের যে কোনো বিষয়েই অধ্যয়ন করাটা ফ্যাশন হয়ে উঠেছে।হবে নাই বা কেন।ভূবিজ্ঞান,পরিবেশ বিজ্ঞান,গোলকীয় উষ্ণতা,সমাজবিজ্ঞান,চিকিৎসাবিজ্ঞান-প্রতিটি গবেষণার জন্য এই জায়গাটা উর্বরভূমি।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হয়তো শেষবারের জন্য স্বদেশ বলে উড়োজাহাজে বসলেন বিপ্লব ফুকন।আবহাওয়া যদি ঠিক থাকে প্রায় ছয় ঘণ্টার যাত্রাপথ।বসে পড়েই স্বভাবগত ভাবে কম্পিউটারটা খুলে বসলেন বিপ্লব ফুকন।স্মৃতিচারণার জন্য খুলে নিলেন শহিদ নামের ফাইলটা।তিনি ইতিহাসের মানুষ,তার মধ্যে এই অঞ্চল নিয়ে বিশেষজ্ঞ,এই সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় একটি টিভি চ্যানেলের জন্য একটা ছোট ছবি করেছিলেন।তারই প্রারম্ভিক স্থিরচিত্র,ভিডিও-অডিও সাক্ষাৎকার এবং শুটিঙের রাশ ফুটেজগুলো পুনরাবিষ্কার করে তার ভালো লাগল। প্রজেক্টটার অনেক বছর হয়ে গেছে।আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অঞ্চল্টির সমস্যাগুলো তুলে ধরায় বেশ সহায়ক হয়েছিল এই ছোট ছবিটা। প্রথমে তিনি স্থিরচিত্রগুলো খুলে নিলেন—কোনোটা উঁচু,কোনোটা বেঁটে,কোনোটা ভগ্ন-রাজ্যটির চারপাশে কেবল শহিদ বেদী।
নোঙরা বেদী,গোলাকার বেদী,পরিত্যক্ত বেদী-যেদিকেই তাকান না কেন,যেদিকেই না যান না কেন-চারপাশে কেবল শহিদ বেদী।রাজ্যের প্রতিটি অংশেই একটা নয় অন্য একটি বেদী দৃষ্টিগোচর হবেই। মাতৃভূমি যেন শহিদের কারখানা।
তখনই ভেসে উঠল তার আপন শহরের পুরোনো চৌরাস্তাটা।এখন জায়গাটা বসতি এলাকা।তার মাঝখানে আগে বীরদর্পে দাঁড়িয়েছিল সেই সুউচ্চ শহিদ বেদীটা।এখন সেটা ভাঙণের জন্য ভেঙ্গে যাওয়া রিফিউজিদের প্রস্রাবস্থল। হাতে অগ্নিশিখা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বিপ্লবীর ভাস্কর্যের নিচে লেখা কবিতাগুলো আজকাল প্রস্রাবকারীর লক্ষ্যবিন্দু। যেন কোনো লক্ষ্যভেদী প্রতিযোগিতায় সোনার পদক পাওয়া যাবে কবিতাগুলোতে আঘাত করতে পারলে-এরকম একটি মনোভাব প্রতিজন প্রস্রাবকারীর মুখে।
আপনি জানেন কি আপনি এইমাত্র প্রস্রাব করা খুঁটিটা একটা একশো বছরের স্মৃতিফলক?’
‘ও আপনি আবার কোথা থেকে এসে হাজির হলেন? আমরা তো সে কথা জানতাম না।‘মানুষটা লজ্জা পেয়ে উত্তর দিয়েছিল।
‘১৯৮৩ সনে কী ঘটেছিল সেটা আপনি জানেন কি?’
‘সেটাতো একশো বছর আগের কথা,আমরা কীভাবে জানব?’
‘মৃত্যুও তো একটা শিল্প—এই কবিতাটা আপনি কোথায় পড়েছেন?’
লোকটি ইতস্তত করল।কিছুক্ষণ আগে তিনি সেই বাক্যের ওপরেই…
লোকটির অবস্থা দেখে ফুকনের রাগও হচ্ছিল,হাসিও পাচ্ছিল।ওদের সমগ্র জেলাটা ভাঙনে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে,তারপরে সাঁতরে-টাঁতরে পথে নানা স্বয়ম্ভু উগ্রপন্থী সরকারের নির্যাতন পার হয়ে এতখানি পথ অতিক্রম করে শরনার্থী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।ওরা কী জানবে এই শহরের ইতিহাস,এখানে যাদের জন্ম হয়েছে তারাই দেখছি ভুলতে শুরু করেছে।স্থানীয় সরকার শুয়োরের খোঁয়ারের মতো থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঠিক,কিন্তু অন্য কোনো ব্যবহার্য সুবিধা নেই,কী কদর্য জীবন।আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে যদি কোনো সাহায্যের বন্দোবস্থ না হয় যে কোনো মুহূর্তেই মহামারী আরম্ভ হতে পারে। এই সংস্থাগুলি কী করে বিপ্লব তাই ভাবে। সে ব্যক্তিগতভাবে,সরকারের হয়ে,এমনকি দুটো উগ্রপন্থী দল থেকেও নির্ভয় দান করে কতবার সাহায্যের আবেদন করল,কিন্ত এখনও আবেদনগুলি তাদের লালফিতার মারপ্যাঁচেই আটকে আছে।একসময়ের সবুজ অরণ্যে এখন খরা এবং সংঘর্ষ মরুভূমি সদৃশ করে তুলেছে। গ্লেসিয়ার গলে অঞ্চলটা একটি ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ করে তুলেছে,তার ওপরে এই গোষ্ঠী সংঘর্ষ,দুর্ভিক্ষ মহামারীর দিনে হাজার হাজার মানুষ মরতে শুরু করেছে।কিন্তু এখনও এখানে কাজ করার জন্য ওদের চাই সরকার এবং উগ্রপন্থী দুদিক থেকেই সুরক্ষার পূর্ব শর্ত।তাহলেই তারা পুনরায় আরম্ভ করবে জনসেবার অভিযান। পাঁচ বছর আগে দুজন ইউক্রেনের চিকিৎসক হত্যারই পরিণাম এটি। অবশ্য এর ফলে লাভবান হয়েছে সরকার এবং অগণন সশস্ত্র দুটি দলই। সমস্ত জনহিতকরতার জন্য আসা সমস্ত টাকা পয়সা এখন খরচ হচ্ছে ওদের উচ্চস্তরের মানুষগুলির হাতে।
আসলে এর বিরুদ্ধে কথা বলার নীতিগত অধিকার বিপ্লবেরও নেই।কারণ এই ধরনের উপার্জিত পয়সায় সে কেমব্রিজের স্নাতক,সুইজারল্যাণ্ডের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার,অনেক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই অঞ্চলটির নীতি গঠনের সহায়ক পরামর্শদাতা।সেরকম এক অনুন্নত জায়গা থেকে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এসে পৌছানোর আড়ালে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার চেয়েও বিপ্লব ফুকনের পিতার প্রতিপত্তি এবং অগাধ সম্পত্তির কর্তৃ্ত্ব হয়তো বেশি। সেকথাটা তিনি স্বীকার করেন। বিপ্লব ফুকনের পিতা বদন ফুকন একজন অভিজাত রাজনীতিবিদ। এত বছর রাজ্যে আসা সমস্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সাহায্য পুঁজি তিনিই তদারক করতেন।অনেকের মতে অন্য ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদকে হাতের মুঠোতে রাখার জন্য তিনিই দুটো উগ্রপন্থী দল সৃষ্টি করেছেন। বড়ফুকন তাই সমগ্র অঞ্চলেই সর্বজনের দ্বারা ঘৃণিত,কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস কারও নেই।পিতার সাহায্যেই বিপ্লব ফুকন নিজের জীবন বানিয়েছে সেই গ্লানির জন্যই নাকি তিনি এই অঞ্চলটির ইতিহাস,স্থাপত্য এবং সাহিত্যকেই নিজের কেরিয়ার হিসেবে গড়ে তোলেন।এই ছোট ছবিটার আড়ালের উদ্দেশ্য ছিল আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই অঞ্চলটির সমস্যা গুলির ওপরে আলোকপাত করা।
ঠিক তখনই মনিটরে ভেসে ঊঠল দাদুর স্মৃতিসৌধের ছবিটা।আকারে প্রকারে সেটাও একটা শহিদ বেদীই। কোনো সময়েই বাবার সঙ্গে সহজ হতে না পারার জন্য নাকি দাদু শৈশবে তাঁর একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল।এই অঞ্চল,তার ইতিহাসের আদিপাঠের প্রথম শিক্ষক ছিলেন দাদু।এই বিপ্লব নামটাও দাদুরই দেওয়া।দাদুর যৌবনের দিনের দুঃসাহসিকতার কাহিনি বিপ্লব ফুকনকে আজও চমকিত করে আসছে।একশো সতেরো বছরের পরিপূর্ণ জীবনের পরে বার্ধক্যজনিত কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর স্মৃতিসৌধটা যেন শহিদ বেদীর আকারে হয়।
‘কিন্তু শহিদ বেদীই কেন ?’বিপ্লব ফুকন জিজ্ঞেস করেছিলেন।
‘কারণ আমরা শহিদের যুগের মানুষ’,দাদু গৌ্রবের সঙ্গে বলেছিলেন—‘আমার জ্যাঠা ১৯৪২ সনের শহিদ,আমার কাকা ১৯৬২ সনের শহিদ এবং আমার বেশ কিছু সহযোগী ১৯৮০ থেকে ২০০০ সনের মধ্যে নানা বিষয়ের শহিদ।এর পরেও অনেক আপনজন শহিদের স্মৃতি আমাকে আজ পর্যন্ত তাড়িত করে।
‘কিন্তু আপনিও তো অনেককে শহিদ করেছিলেন ?’নিজের যৌবনে দাদু প্রথমে একজন বিখ্যাত উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।কমরেডের হত্যার প্রতিশোধের জন্য তিনি নিঁখুত নিশানায় অনেককে নিহত করেছিলেন।মানুষের মনে আর সরকারি দস্তাবেজে তাঁরাও শহিদ।
‘সমগ্র রাজ্য শহিদে ভরে গেছে ,আপনি যাকে শহিদ বলেন অন্যেরা তাকে দেশদ্রোহী বলে।আপনার সংগঠন যাকে সুবিধাভোগী,বিশ্বাসঘাতক ভেবে হত্যা করেছিলেন,অন্য সংগঠন গুলি তাকে দেশপ্রেমী হিসেবে মরণোত্তর শহিদের সম্মান জানিয়েছিল।আমি এই কথাটাই বুঝতে পারি না—আসলে কে শহিদ?’
সেই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজেই বিপ্লব ফুকন ছোট ছবিটা আরম্ভ করেছিলেন।ফোল্ডারটা অঞ্চলটির ভিন্ন অংশের শহিদ বেদীর ছবি এবং ভিডিওতে পরিপূর্ণ হয়েছিল। বেশিরভাগ বেদীর অবস্থাই অত্যন্ত শোচনীয়।কোনোটা ডাস্টবিন,কোনোটার উপরে এখন মণিহারী দোকান,বেশিরভাগই ক্রিকেট খেলার স্টাম্প হিসেবে ব্যবহার হয় আর রাতের বেলা সুরা পান অথবা যৌন অভিসারের আসর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।১৯৪২,১৯৬২,১৯৭৯,১৯৮৩,১৯৯২…ভিন্ন ভিন্ন পন্থী স্থাপন করা বেদীগুলির আকার প্রায় একই ধরনের।যদিও খসে যেতে শুরু করেছে, কয়েকটিতে এখনও মৃতের নাম পড়ার অবস্থায় রয়েছে।কয়েকটিতে শহিদের এবং শহিদটি যে পন্থীরই হোকনা কেন ,আশ্চর্য জনক ভাবে প্রায় বেশিরভাগ শহিদ বেদীতেই ক্ষোদিত রয়েছে সেই বিখ্যাত কবিতাটা । বিখ্যাত বলেই বলতে হবে,কারণ সেই অর্ধ শতকের বেশিরভাগ ফলকেই ক্ষোদিত আছে সেই কবিতার স্তবকটা। কিন্তু সেই কবির কোনো চিহ্ন নেই।
‘আমরা বড় আবেগিক জাতি,ঠিক আছে তাতে কোনো আপত্তি নেই।কিন্তু সমস্যাটা হল আমাদের ভুলে যাবার প্রবণতাটা তার চেয়ে বেশি।’ কবিটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় দাদু বলেছিলেন।‘আর তার জন্যই আমরা নাকি একই ভুল বারবার করে থাকি।’
অভিজ্ঞতা পুষ্ট জীবনের অধিকারী দাদু সম্পূর্ণ সত্যি কথা বলেছিলেন।তিনি নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন দেখে এসেছিলেন। একজন বিপ্লবী,সংগ্রামী থেকে উগ্রপন্থীতে,তারপর সফল ব্যবসায়ী এবং নির্বাচিত জননেতায় –সমস্ত অভিজ্ঞতাই তার জীবনে আছে।মৃত্যু তাকে অনেকবার কাছ থেকে ছুঁয়ে গেলেও প্রতিবারই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।তাঁর অমেক সহযোগী কিন্তু এত ভাগ্যবান ছিলেন না,এমনকি দাদুর খোঁজে চালানো এক সামরিক অভিযানে তাঁর বৃ্দ্ধ পিতামাতা সহ কবি পরিবারের পাঁচজন মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করেছিল।তারা প্রত্যেকেই আজ শহিদ।অন্যদিকে তিনি নিজের হাতে কখনও জীবন রক্ষার জন্য ,কখনও সময়ভেদে পরিবর্তিত হওয়া আদর্শের জন্য এবং অনেকবার সরকারি গুপ্তনীতির আদেশে অনেক মানুষের ওপরে গুলি চালিয়েছেন,সেই মৃতরাও আজ শহিদ।কিন্ত একজনের নামও আজ জনগণের মনে নেই।পরবর্তীকালে দাদুও বেশিরভাগ নাম,মৃত্যুর কারণ ভুলে গিয়েছিলেন।হয়তো সময়ের গতিতে তাঁদের সেই সমস্যাটির,সেই মৃত্যুর মূল্যও নাই হয়ে গিয়েছিল।সেজন্যই হয়তো কোনো চিহ্নই নেই সেই শহিদের,তাদের কারও মনে নেই।
আর মনে রাখার জন্য সময়ই বা কোথায়?প্রকৃতি প্রলয় সদৃশ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গের গ্লেসিয়ার গলে সাগরগুলি ফুলে উঠেছে,এদিকে নদীগুলিতে জল নেই। বারবার ইউরোপীয় প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে হওয়া বড় ধরনের ভূমিকম্প,সাগরের ক্ষয় এবং বনাঞ্চলের ওপরে নির্বিচার আক্রমণের ফলে অঞ্চলটি এখন একটি অনুর্বর গৃহযুদ্ধ চলতে থাকা দ্বীপ। এতদিনে প্রবহমান নদী উপনদী গুলিতে এক ফোঁটাও জল নেই। দুর্ভিক্ষ মহামারীতে মানুষ মরতে শুরু করেছে। তথাপি সরকারি হোক বা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদিই হোক কোনোটারই বিন্দুমাত্র অহংকার কমেনি।এখনও অস্তিত্ব রক্ষা, সাত পুরুষের সংস্কৃতি ইত্যাদি শব্দকে নির্লজ্জ ভাবে ব্যবহার করে নিজের নিজের ব্যভিচার চালিয়ে যাচ্ছে। খোকনের পিতা একজন অন্যতম ব্যভিচারী নেতা। কিন্তু এতদিন তার কোনো বিচার হয়নি। গত বারের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে বিচারের ভয়ে ইরাবতী উপকূলে স্বেচ্ছাচারী সামরিক নেতার সুরক্ষায় আত্মগোপন করে নিজের সেনাবাহিনী চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লব হল এই প্রান্তের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি এবং তার পিতা সেই দেশেরই পলাতক অপরাধী। প্রত্যেকেই জানে বিপ্লব দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দি হবে। এবং তিনি যতই যত্ন করুক না কেন তাদের পরিবারের প্রধান শত্রু এই নতুন সামরিক প্রধান তাকে দোষী প্রমাণিত করবে। বিশ্বজুড়ে জনপ্রতিক্রিয়ার জন্য তা যদি সম্ভব না হয় তখন হয়তো কোনো বিচার না করেই অঘটিত সংঘর্ষ একটা ঘটিয়ে বিপ্লবকে শেষ করে দেবে। তাই প্রত্যেকেই তার স্বদেশের সামরিক আদালতের সাক্ষী হওয়ার জন্য ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিল। পিতা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে পিতার বিরুদ্ধে থাকা অনেক অভিযোগের সহযোগী হিসেবে বিপ্লব ফুকনেরও নাম ছিল।ইউরোপের সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক সুরক্ষার অধিকারী প্রফেসর অবশেষে দেশের জনগণের আবেদনকেই বেশি গুরুত্ব দিলেন।অন্তত তার আগমনে সংবাদ মাধ্যম সৃষ্টি করা আলোকপাত আন্তরাষ্ট্রীয় সংগঠন গুলিকে এখানে কাজ পুনরায় আরম্ভ করতে বাধ্য করবে। দেশে ফিরে আসার আগে করা সংবাদ মেলে সে সেই অনুরোধই করেছিল। 'এটা আত্মহত্যার বাইরে কিছু নয়' প্রেমিকা এনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল। 'কি করবে দেশপ্রেম এবং দেশদ্রোহ আমাদের বংশের কোষে কোষে' বিপ্লব বলেছিল। ইতিহাস খুললে দেখতে পাবে প্রতি ১০০ বছর পর পর একই ধরনের কারণগুলির জন্য বারবার এই অঞ্চলটিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই চলেছে, যতই চেষ্টা করনা কেন তুমি তাকে রোধ করতে পারবে না।
'কিন্তু তোমার যাবার কী প্রয়োজন?'
'আমিও বোধহয় ইতিহাসের পাপ এবং প্রায়শ্চিত্তের একটি অঙ্গ হয়ে পড়েছি। এটাই তো তোমার গবেষণার বিষয়।'
'শহিদ হওয়ার এত সখ?'
‘না। শহিদ কে তা বোঝানোর আমার দুর্বার আগ্রহ।’
এই প্রশ্নটির উত্তর বিপ্লব ফুকনের জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। তার উত্তরে একজন তাকে উল্টে জিজ্ঞেস করেছিল হাড়ে হিমজুরে আমরা এই মাটিরই মানুষ এবং এখন আমাদেরই অন্নজলের দুরবস্থা।তার বিরুদ্ধে কথা বললে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে ওদের গুলি করা হয়েছিল। ওরা শহিদ না হলে শহিদ কে হবে? সত্যি কথা।
একের পর এক ভিডিওগুলি বিপ্লব ফুকন দেখে গেল।
আমরা পেটের জ্বালায় এখানে এসেছিলাম এবং তোমরা সবাই মিলে আমাদের গ্রাম গুলি জ্বালিয়ে দিলে। আসলে শহিদ বেদী গুলি হল সেই মৃতদেরই স্মৃতি সৌধ।': সেই মানুষের উত্তর বিপ্লবকে হুলের মতো বিঁধেছিল। তথাপি বিপ্লব ফুকন কোনো ধরনের সম্পাদনা না করেই কথাগুলি ডকুমেন্টারিটিতে ব্যবহার করেছিল।
' না হলে কি করব, বন্দুকটার জন্য আজ দুমুঠো খেতে তো পারছি। একজন জীবন্ত শহিদ বলেছিল।
সাক্ষাৎকারটির কয়েকদিন পরে ছেলেটির অন্তর্দলীয় সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছিল। আর আজ সাক্ষাৎ গ্রহণকারীও একজন জীবন্ত শহিদই।
যে কয়েকজন তাকে মেরেছে তারা নিশ্চয়ই মারা যাবে এটা নিশ্চিত।আমাদের এই নরককুণ্ডে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, আসলে আমরাই শহিদ, যারা মরার তারা তো মরেই গেল। শহিদের মা কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিল। বিপ্লব সেই অংশটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। মহিলা হয়তো সত্যি কথাই বলছেন।
উড়োজাহাজটা হিমালয় অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে তার মাতৃভূমিতে ফিরে আসছিল। দূরে কুয়াশার আড়ালে আড়ালে দৃশ্যমান হয়েছিল তার অত্যন্ত আপনজন দ্বীপটা,বিপ্লব ফুকন নিচের দিকে তাকালেন,সাগরের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহের রাজ্যটি একটা শহিদ বেদীর মতোই মনে হল তার কাছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন