বিদেহ নন্দিনী
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
।।এক।।
এই কয়েকদিন আমার মনের একেবারেই স্থিরতা নেই।আশ্রমের নির্জন পরিবেশ আমার মনটাকে আরও ভারী করে তুলেছে।আমি এক পা দু পা করে আশ্রম থেকে বেরিয়ে এসে একেবারে নদীর তীরে উপস্থিত হলাম।পলাশ গাছের নিচে বসে আমি নদীর দিকে তাকালাম।মনটা বড় ফাঁকা ফাঁকা মনে হল।প্রথমবারের জন্য আমার দুই পুত্র লব-কুশকে দূরে পাঠিয়েছি।ওরা ঋষি বাল্মীকির সঙ্গে নৈ্মিষক্ষেত্রে গিয়েছে।নৈমিষক্ষেত্রে আমার এককালের স্বামী অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র তাঁর ভাইদের সঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞে্র আয়োজন করেছে।সেখানে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন ঋষি বাল্মীকি এবং তাঁর শিষ্যরা।লব-কুশকে ঋষির সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বড় চিন্তিত হয়েছি।আমার অন্তরের আত্মা বলছে এই বিদায় মনে হয় চিরবিদায় হবে।ওরা যেন আমার জীবন থেকে একেবারে হারিয়ে যাবে।তাই আমি কোথাও শান্তিতে থাকতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে আমি বড় অস্থির হয়ে উঠেছি।
ঋষি বাল্মীকি আমার ত্রাণকর্তা।আমার গুরু।আমার পিতা।সুদীর্ঘ বারো বছর আমি তাঁর তত্ত্বাবধানেই রয়েছি।সমস্ত জগত আরাধনা করা আমার স্বামী রঘুবংশের রামচন্দ্রের দ্বারা আমি নির্বাসিত হয়েছিলাম আজ থেকে বারো বছর আগে।তখন আমার গর্ভে পাঁচ মাসের সন্তান ছিল।এইরকম একজন পুরুষকে আমার স্বামী বলে ভাবার অধিকার আছে কিনা জানি না।অধিকার থাকলেও আমার মন তাঁকে স্বামী বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে।নির্বাসিতা হওয়ার দিন থেকে আমি দাম্পত্য জীবনের মধুর স্মৃতিগুলির কথা কোনোদিন রোমন্থন করিনি। স্বামী বারবার করা অপমান আমাকে একজন সম্পূর্ণ পৃ্থক মানুষে রূপান্তরিত করেছে।গত বারো বছর আমার মনে অনবরত তিনটে প্রশ্ন উদয় হয়ে আসছিল।আমাকে কেন নির্বাসন দেওয়া হল?আমার দোষ কোথায়?আমার জন্ম দেওয়া সন্তানের ভবিষ্যৎ কী?
রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত করার কথা ঋষি আমাকে বলার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না।রামচন্দ্রের যজ্ঞের ঘোড়া লবই ধরে রেখেছিল।অশ্ব রক্ষার জন্য সঙ্গে আসা ভরত শত্রুঘ্ন আদি অযোধ্যার সমস্ত বীরদের লব-কুশ একাই পরাস্ত করার কথা আমি পরে শুনেছিলাম।ঋষি বাল্মীকি রামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া বলে জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে লব-কুশ বন্দি করে রাখা অযোধ্যার বীরদেরও মুক্ত করে দেয়।তিনি এখনও সময় হয়নি বলে বিবেচনা করে লব-কুশের প্রকৃ্ত পরিচয় গোপন রাখেন।
আমি ঋষি বাল্মীকির মনের শঙ্কা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম।আর সেজন্যই ঋষিকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম লব-কুশকে অশ্বমেধ যজ্ঞে না নিয়ে যেতে।আমার অপমান হোক।কিন্তু ওদের অপমান হওয়াটা আমি সহ্য করব না।নির্বাসনের আগে পর্যন্ত রামচন্দ্রের সঙ্গে্ সংসার করে আমি বুঝেছিলাম তিনি কী প্রবৃত্তির লোক। নিজের যশকে ম্লান করতে পারে এমন কোনো কথাই তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত নন।দোষী হলেও জগত প্রভু রামচন্দ্র একজন গর্ভবতী মহিলাকে জঙ্গলের মধ্যে নির্বাসন দেওয়াটা উচিত হয়েছে কি?যদি নির্বাসনের কথাই ভাবছিলেন তাহলে আমাকে মিথিলায় পাঠিয়ে দিলেন না কেন?আমার ও পিতৃগৃহ ছিল।আমি জানি আমাকে চিরদিনের জন্য পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিলে বিখ্যাত ইক্ষাকু বংশের মর্যাদার হানি হবে।কারণ কন্যা সম্প্রদান হয়ে যাবার পরে ভরণ-পোষণের জন্য পিতৃগৃহে পাঠালে স্বামীর অপযশ হবে।যেদিন আমাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল সেই দিনটির কথা মনে পড়লে আজও আমার শরীর শিউরে উঠে। আমরা ১৪ বছর বনবাসে বাস করে অযোধ্যায় ফিরে আসার পরের কথা। দেওর ভরতের একান্ত অনুরোধ এবং প্রজাদের আগ্ৰহের প্রতি সম্মান জানিয়ে স্বামী রামচন্দ্র রাজ সিংহাসনে বসেন। স্বামী রাঘবের সংকল্প ছিল অযোধ্যাকে এরকম একটি রাজ্যে পরিণত করা যেখানে কোনো প্রজার দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগ, জরা- মৃত্যু, রোগ-ব্যাধি কিছুই থাকবে না।অযোধ্যাকে স্বর্গের মতো সৃষ্টি করার জন্য স্বামী যে পরিকল্পনা করেছিলেন তাতে তিনি সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন। সেই রাম রাজ্যে স্বামীর জয় গুণগান এবং গুণকীর্তনের বাইরে অন্য কিছু জায়গা পাচ্ছিল না। সেই আনন্দের দিনগুলোর মধ্যে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলাম। স্বামী রামচন্দ্র আমার খাওয়া দাওয়া, ঘোরাফেরা, সমস্ত কিছুতে চোখ রাখা ছাড়াও সব সময় আমার মন প্রফুল্ল করে রাখার চেষ্টা করেছেন। একদিন বিকেলে আমরা দুজনেই প্রমোদ উদ্যানে বিচরণ করে থাকার সময় রাঘব আমাকে বলেছিলেন --'সীতা, তোমার দেহে মাতৃত্বের লক্ষণ সম্পূর্ণরূপে ফুটে উঠেছে। তোমার যে কোনো ইচ্ছা বা বাসনা আমি পূর্ণ করব। তাই তোমার যা ইচ্ছা আমাকে বলতে পার। এই সময় তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করাটা সন্তান এবং আমাদের দুজনের জন্য মঙ্গল।'
আমি সন্তোষের হাসি হেসে বললাম-- 'হে নাথ, আমি একবার গঙ্গার তীরে যে কোনো একটি আশ্রমে এক রাত থেকে তার দৃশ্য উপভোগ করে ফলমূল খেয়ে একটা রাত কাটাতে চাই। আমার বাকি সমস্ত মনোবাঞ্ছা আপনি তো পূরণ করেছেনই ।'
সঙ্গে সঙ্গে স্বামী রঘুনাথ বললেন--' কোনো চিন্তা নাই বৈদেহী, আমরা আগামী কালকেই তপোবনে যাব।'
পরের দিন সকালে দেওর লক্ষ্ণণ আমার কাছে এল। আমাকে প্রণাম জানিয়ে সে বলল --'বৌদি রাজা রামচন্দ্র আপনাকে গঙ্গার তীরে ঋষির আশ্রমে বেড়াতে নিয়ে যাবার আদেশ দিয়েছেন। আমাদের জন্য রথ এবং নৌকা নির্দিষ্ট স্থানে ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে আছে। অনুগ্রহ করে আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন।'
আমি সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করলাম --'লক্ষ্ণণ তোমার দাদাও তো আমার সঙ্গে যাবার কথা বলেছিলেন।' ‘তিনি কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আমাকে ঘুরিয়ে আনতে বলে দিয়েছেন’- লক্ষ্ণণ অত্যন্ত সাধারণ ভাবে কথাটা বলল। আমি ঋষি এবং আশ্রমের তপস্বীদের জন্য কাপড় এবং উপহারের পুঁটুলি বেঁধে রথে উঠলাম।রথ চালাচ্ছিল আমার শ্বশুরের বিশ্বাসী সারথি সুমন্ত্র। সেদিন রাতটা গোমতী নদীর তীরে একটি আশ্রমে থেকে পরদিন সকালে নৌকায় উঠে গঙ্গার ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
আমার কেন জানি মনে হয়েছিল লক্ষ্ণণের মুখমন্ডলে এক ধরনের বিষণ্ণতা বিরাজ করছে। সে যেন আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল না। এদিকে আমার মনও বারবার যেন বলছিল যেন কিছু একটা অমঙ্গল ঘটবে। তাই আমি মনে মনে ভগবানকে প্রার্থনা জানিয়ে বললাম -’হে প্রভু, আমার স্বামী পরিবার এবং অযোধ্যা বাসীকে কুশলে রেখ।’
ফাল্গুন মাসের ফুরফুরে বাতাসে নৌকা বনভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনও আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে আমাকে নির্বাসন দেবার জন্য এখানে আনা হয়েছে। ভেবেছিলাম স্বামী রঘুনন্দন গর্ভবতী পত্নীর মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য নিজে কাজে ব্যস্ত থাকায় দায়িত্বশীল ভাই লক্ষ্ণণের সঙ্গে তপোবনে পাঠিয়েছে। তিনি নিজে আসতে পারেননি।
ইতিমধ্যে নৌকা এসে তীরে পৌঁছেছে। লক্ষ্ণণ কঠিন কন্ঠে মাঝিকে বলল- 'নৌকা সাবধানে পারে লাগাবে।নৌকা যেন টলমল না করে। আমার বৌদি, অযোধ্যার রানি এখন গর্ভবতী। তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলে এই তরোয়াল তোমার বক্ষ ভেদ করবে।'
আমি লক্ষ্ণণকে বলেছিলাম-- 'এভাবে বলতে নেই লক্ষ্ণণ,তোমরা অনার্যদের প্রতি কেন এত বিরাগ?' ওদের প্রতি অন্যায় বা হিংসা অমঙ্গল ডেকে আনে।'
লক্ষ্মণ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল--'এই অনার্যরাই হল আপনার দুঃখের কারণ। অনার্য রাবণের জন্যই আপনার জীবন দুঃখের হয়ে পড়েছিল।' এভাবে বলে লক্ষ্মণ আমাকে সাবধানে হাতে ধরে নৌকা থেকে নামিয়ে এনেছিল। কাদায় ঢুকে পড়া আমার পা দুটির দিকে তাকিয়ে লক্ষণ বলেছিল মা আমার দোষ নেবেন না, আমাকে আপনাকে কোলে করে পারে নিয়ে আসতে হবে।এই বলে লক্ষ্ণণ আমাকে সাবধানে তুলে নিয়ে পারে পৌঁছে ছিল। পলাশ গাছের নিচে বসিয়ে জল এনে আমার পা দুটি ধুয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম লক্ষ্ণণ যন্ত্রের মতো কাজ গুলি করে যাচ্ছ। তার মুখ ছিল নিরানন্দ।
লক্ষ্ণণের বিষন্নতায় ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘লক্ষ্ণণ আমাকে বলতো তোমার মুখমন্ডলে কেন এত বিষণ্নতা বিরাজ করছে? আমার স্বামী কৌশল্যা নন্দনের কুশল তো? তিনি বিদায়ের সময় আমাকে কিছু বললেন না কেন? তার কি কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে?’
এই কথাগুলি আমাকে এইজন্য জিজ্ঞেস করতে হয়েছিল আমার পাঁচ মাস হওয়ার পরে স্বামী আমার কক্ষে প্রবেশ করছেন না। পঞ্চামৃত দিয়ে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হওয়ার পরে শাশুড়ি কৌশল্যা আমার গর্ভের সন্তানের কথা ভেবে রাতে স্বামীর সঙ্গে একই শয্যায় ঘুমোতে বারণ করেছিলেন। এত বছর পরে আমি সন্তানের জন্মদান করব তাই শাশুড়ির উৎসাহ আর যত্নের সীমা ছিল না।
লক্ষ্ণণ সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছিল-‘সমস্ত কিছুই কুশলে আছে। তারপরে লক্ষ্ণণ আমার কোলে মাথা গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- ‘লক্ষ্ণণ তোমার কি হয়েছে? আমার শপথ তোমার কি হয়েছে আমাকে বল।’ লক্ষ্ণণ চোখের জল মুছে বলেছিল- ‘বৌদি আমি আপনাকে এই জঙ্গলে রেখে যেতে এসেছি। আপনি শ্রীরামচন্দ্রের আদেশে নির্বাসিতা হয়েছেন।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম-‘কী কারনে আমি নির্বাসিতা?’ উত্তরে লক্ষ্ণণ বলেছিল প্রজার সন্তুষ্টির জন্য। আপনি জানেন যে তিনি প্রজার সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন। গতকাল বিকেলে আপনাকে প্রমোদ উদ্যানে বেড়াতে নিয়ে যাবার পরে তিনি কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারেন যে রাজরাণী হিসেবে রাক্ষসপুরীতে সীতার এক বছর কাটিয়ে আসাটাকে প্রজারা মেনে নিতে পারছে না।
লক্ষ্ণণের কথা সম্পূর্ণ শেষ হতে না দিয়ে বিস্ফারিত নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম-‘এই ক্ষেত্রে আমি কিভাবে দোষী হলাম? আমাকে একদিনের মধ্যে উদ্ধার করতে না পারাটা তোমাদের অসমর্থতা ব্যর্থতা নয় কি? তোমাদের অক্ষমতার জন্যই আমাকে এক বছর রাবণের রাজ্যে থাকতে হল না কি? তোমরা দুই দাদাভাই সুপর্ণখাকে খেপিয়ে তার নাক কান কেটে নিজেরাই শত্রুতা শুরু করে বিপদ ডেকে আন নি কি? খর দূষণ আদি রাক্ষসকে বধ না করলে এরকম ঘটনা ঘটত কি? আর শোনো, রাবণের সঙ্গে আমি পালিয়ে যাই নি। আমাকে হরণ করেছিল। তোমার বড় দাদা এই কথাগুলো ভুলে আমাকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা কীভাবে ভাবতে পারল?’
লক্ষ্ণণ একইভাবে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলছিল-‘বৌদি আমি আর ভরত দাদাকে অনেক বুঝিয়েছি।আপনি তো জানেনই তিনি কখনও ভাইদের সিদ্ধান্তে খুব বেশি গুরুত্ব দেন না।’
মুহূর্তের মধ্যে আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে রামচন্দ্র একজন অতি স্বার্থপর রাজা। তার প্রয়োজন কেবল জগৎপতি হওয়া। এরকম একটি রাষ্ট্র তিনি নির্মাণ করতে চাইছেন যেখানে প্রজারা তার কেবলই গুণগান গাইবে। কথাগুলো ভেবে আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলাম। তারপরে মনটা শক্ত করে লক্ষ্ণণকে স্পষ্ট কন্ঠে বলেছিলাম-‘হে সুমিত্রানন্দন, আমার হয়ে তিনটি কথা তোমার দাদাকে জিজ্ঞেস করবে। প্রথমটি হল নারী কি দেশের প্রজা নয়? নারীকে সুরক্ষা দেওয়াটা কি রাজার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? দ্বিতীয়ত আমি নির্বাসিতা। আমার গর্ভের সন্তানকে তিনি গ্রহণ করবেন কিনা? নাকি পত্নীর সঙ্গে ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানকে তিনি নির্বাসনে দিয়েছেন? তৃতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস কর- আমি জন্ম দেওয়া সন্তানদের বনে জঙ্গলে তোমরা নিধন করা রাক্ষসের মতো লালন পালন করব না ভিক্ষা করে ব্রাহ্মণের মতো বেঁচে থাকতে শেখাব?’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আমি পুনরায় একটা কথা স্পষ্ট করে জেনে নেওয়া ভালো হবে ভেবে বলেছিলাম- ‘লক্ষ্ণণ আমাকে একটি সত্য কথা বলবে কি? আমার এই নির্বাসন কতদিনের জন্য?’
লক্ষ্ণণ হয়তো আমার প্রশ্নটি শুনে অপ্রস্তুত হয়েছিল।তাই, আমি যাতে তাকে আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করি তার জন্য সে আমাকে এভাবে বলেছিল-‘হে মাতা,হে দেবী,আমাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না। আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। লোক অপবাদের ভয়ে দাদা রামচন্দ্র আপনাকে তার জীবন থেকে পরিত্যাগ করেছেন।আপনার অথবা গর্ভস্থ বা ভূমিষ্ঠ সন্তান সমস্ত কিছুর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। পঞ্চবটির সেই সর্বনাশা দিনটিতে আপনি আমার দেওয়া লক্ষ্ণণ রেখা অতিক্রম করা উচিত হয়নি মাতা।’ কথাটা বলে লক্ষ্ণণ দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছিল।
আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। রাগ দুঃখ এবং মন খারাপ আমার মুখের কথা হরণ করেছিল। চোখের সামনে ধোঁয়া দেখছিলাম। নিমেষের মধ্যে পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে যখন আমি প্রকৃতিস্থ হয়েছিলাম তখন লক্ষ্ণণ আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল।
লক্ষ্ণণ চলে যাবার পরে আমি নির্জনে প্রাণভরে কেঁদেছিলাম। আমার কান্না শুনে সেই জঙ্গলের কিছু দূরে অবস্থিত ঋষি বাল্মীকির আশ্রমের কয়েকজন শিষ্য আমাকে ঘিরে ধরল। তারা আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে ঋষি বাল্মীকি এসে উপস্থিত হলেন। ঋষি আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। আগেরবার স্বামী এবং দেবর লক্ষ্ণণের সঙ্গে বনবাসে আসার সময় বাল্মীকির আশ্রমে ছিলাম। ঋষিকে আমার বিশেষ কিছুই বলতে হল না। আমার হৃদয় ভাঙ্গা কান্নার ধ্বনি এবং তার যোগ শক্তির বলে সমস্ত কিছু জানতে পেরেছিলেন।ঋষি আমাকে তার আশ্রমে জায়গা দিলেন। বাল্মীকির তত্ত্বাবধান এবং আশ্রমের ধরিত্রী, আত্রেয়ী নামের মাতৃসমা দুজন নারীর শুশ্রূষায় আমি লালিত-পালিত হতে লাগলাম। আমি কিছু বেশি বয়সে সন্তান সম্ভবা হওয়ার ফলে তারা আবশ্যকের চেয়ে বেশি যত্ন নিয়েছিলেন। যাতে প্রসবের সময় আমাকে খুব বেশি কষ্ট পেতে না হয়। আমি কীভাবে ঘুমোব, কীভাবে উঠব,গর্ভের সন্তানকে কোনো রকম আঘাত না দিয়ে কীভাবে বসতে হয় কীভাবে খেতে হয় ইত্যাদি সমস্ত কিছু শিখিয়েছিলেন।
আমার মন প্রফুল্ল রাখার জন্য বাল্মিকী তপোবনের মধ্যে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। নানা গল্প কাহিনি বলে আমাকে জ্ঞান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার গর্ভস্থ সন্তানকে ও জীবনের আদিপাঠ প্রদান করেছিলেন। আশ্রমের পশুপাখি গাছ লতার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার অশান্ত মন,বেদনার সৃষ্টি করা ঘটনাগুলি তাকে বলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।ঋষির মতে মন তোলপাড় করতে থাকা কথাগুলি অন্য কাউকে বললে কিছুটা শান্তি পাওয়া যায়। আমি কোনোদিন কাউকে কিছু না বলা কিছু কথা পিতৃসম বাল্মিকীকে বলে অন্তরের দুঃখ কিছুটা লাঘব করেছিলাম। সমস্ত জগতে ভগবানের অবতার বলে পূজিত রামচন্দ্রের কিছু কার্যকলাপ আমি ঋষির কাছে ব্যক্ত করেছিলাম।
স্বামী অনেক সময় আমার প্রতি ব্যবহার করা বাক্যবাণ আমি কোনোদিন ভুলে যেতে পারব না। আমি অবাক হয়েছিলাম তার মত একজন পুরুষ কীভাবে এত নিচু স্তরের কথা বলতে পারেন। যে দিন মাসি শাশুড়ি কৈকেয়ী ভরতের জন্য সিংহাসন ছেড়ে বনে যেতে হবে বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেদিন তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ না করে মাসি শাশুড়ি কে বলেছিলেন-‘কেবল সিংহাসন কেন আমি হাসিমুখে সীতাকে ও ভরতের হাতে তুলে দিতে পারি।’
এই কথাটা তার মুখ থেকে কীভাবে বের হতে পারল সে কথা ভেবে আমি অবাক হয়েছিলাম। অন্তরে কিছু সন্দেহ পুঞ্জীভূত হয়ে না থাকলে সহজে মানুষের মুখে এই ধরনের কথা বের হয় না। কেবল মাসি শাশুড়িকে নয় আমাকেও ভরতকে পতিহিসেবে মেনে নিয়ে রাজভোগ করার কথা বলেছিলেন। তার এই ধরনের মানসিকতায় আমি বারবার হোঁচট খেয়েছিলাম। তবু মনকে এভাবেই প্রবোধ দিয়েছিলাম যে ক্রোধ,দুঃখ মন খারাপ কখনও মানুষকে না বলা কথা বলতে বাধ্য করে। কিন্তু বনবাসে একদিন তার মুখে একটা কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। তিনি লক্ষ্ণণের সামনে আমাকে বলেছিলেন যে আমি স্বামী রামচন্দ্রের বিষয়ে প্রশংসাসূচক কথা বললে ভরতের চোখে নাকি হিংসার ছবি ফুটে ওঠা তিনি ভালোভাবে দেখতে পেয়েছিলেন। এই ধরনের কথা তাঁর মনে গোপন করে রাখার জন্য আমি অবাক হওয়ার সঙ্গে তার মনের পরিচয় বেশ ভালোভাবে পেয়েছিলাম। তাই কখনও কখনও আমার জানতে ইচ্ছে করে কেবল আমার স্বামীই এই ধরনের না জগতের সমস্ত নারীর স্বামী একই ধরনের? কখনও মনে হয় তারা যেন কঠোরের চেয়ে কঠোর কার্য সম্পন্ন করে স্ত্রীকে লাভ করাটা এক ধরনের গৌরব এবং যশের ব্যাপার বলে বিবেচনা করে থাকেন। পত্নীকে লাভ করে উপভোগ করার পরে সেই পত্নীর প্রতি ধীরে ধীরে আন্তরিকতা কমে আসে। না হলে কি জগৎপতি রামচন্দ্র লোকের কথা শুনে আমাকে নির্বাসনে পাঠায়? তাই আমার কখনও মনে হয় জীবনের মধ্যভাগে সাক্ষাৎ লাভ করা একজন সঙ্গীর সঙ্গে পুরুষের অন্তরের টান না থাকতেও পারে। তেমনি ননদ দেবরদের মাতৃসমা নতুন বৌদিও কখনও কখনও কোথাও কারও হয়ে পড়তে পারে। না হলে আমার আদরের দেবর শত্রুঘ্ন আমি লব কুশের জন্ম দেওয়ার দিন মাত্র দুটো বেড়ার ওপারে থেকেও ভাইপোদের দেখতে এল না? সেই দিনটির কথা ভাবলে আজও আমার বুক যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে। শত্রুঘ্নকে দাদা রামচন্দ্র নিযুক্ত করেছিল অত্যাচারী লবণ অসুরকে বধ করে মধুবনের ঋষিদের রক্ষা করার সঙ্গে কোশল রাজ্যের সীমা বিস্তার করার কার্যকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য। শত্রুঘ্নর যাত্রাপথে পড়েছিল বাল্মীকির আশ্রম। আমি যেদিন দুটি যমজ সন্তান জন্ম দেবার জন্য প্রসব বেদনায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম সেদিন শত্রুঘ্ন ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে অতিথি হয়ে এসেছিল। আমার শরীর খারাপের কথা জানতে পেরেছিল। ঘনঘন অসহ্য ব্যথার মধ্যে ভেবেছিলাম সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে শত্রুঘ্ন নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে আসবে। বংশের গৌরব বলে ভাইপোদের হাতে তুলে নেবে।
কিন্তু কী নিষ্ঠুর। সে আমাকে বা নবজাতককে দেখতে আসা তো দূরের কথা এমনকি আমি এবং সন্তান কী রকম আছি তাও জিজ্ঞেস করল না। আমি দেবর শত্রুঘ্নের এই ধরনের আচরণে ঋষি বাল্মীকি,মাতৃসমা ধরিত্রী,আত্রেয়ী,ধাই এবং আশ্রমের অন্যান্য মহিলাদের সামনে খুব লজ্জা অনুভব করছিলাম। সবাই আশা করেছিল যে কাকা শত্রুঘ্ন উপঢৌকন নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। অশুচি বিছানায় শুয়ে মনে মনে চিন্তা করছিলাম- শত্রুঘ্ন এভাবে বদলে গেল? আমার সঙ্গে দেখা না করতে আসাটা শত্রুঘ্নের নিজের সিদ্ধান্ত না দাদার আদেশ। আদেশ হলেও শত্রুঘ্নের নিজের বিচার বুদ্ধি এতটাই লোপ পেয়েছে কি? সে তো আমার দেবর হিসেবে না হলেও বোনের জামাই হিসেবে একটাখবর করতে পারত?এভাবে নানা কথা চিন্তা করে থাকার সময়ে অন্তর্যামী বাল্মীকি বলেছিলেন-‘দুঃখ কর না মা। তোমার দেবর তোমার স্বামীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সকালে অযোধ্যানন্দনকে আমি নিজের মুখে এই শুভ সংবাদটা দিয়েছিলাম। তিনি আমার মাধ্যমেই সন্তান দুজনকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। তাই তোমার দুঃখ করা অনুচিত। মাত্র একটা কথা জেনে রাখ যে মানুষের চরিত্র বোঝা কঠিন।
আমি পিতৃতুল্য ঋষি বাল্মীকির কথাগুলি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলাম। জীবনের মধ্যভাগে সাক্ষাৎ হওয়া শত্রুঘ্নের চরিত্র কীভাবে বুঝতে পারব। স্বয়ং রাজা জনকের পালিতা কন্যা হয়েও তার মনই আমি বুঝতে পারলাম না। তাই বাকিদের কথা আর কি বলব?
একটা সময় আমি ভেবেছিলাম যে আমাকে বনে নির্বাসনে পাঠানোর চেয়ে মিথিলাতে কেন পাঠিয়ে দিল না? কিন্তু পরে আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে আমাকে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিলেই যে আমি সুখে বসবাস করতাম তা নয়। বরঞ্চ পিতৃসম বাল্মীকির তত্ত্বাবধানে আমি বেশি শান্তি এবং স্বাধীনভাবে আছি। পিতৃগৃহে স্বামী পরিত্যক্তা কন্যার কোনো আদর নেই। তা সে রাজার বাড়িই হোক বা গরিবের ঘরই হোক। এই কথাটা আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যেদিন আমি জানতে পেরেছিলাম যে আমার পিতা রাজা জনক অযোধ্যায় গিয়েছিলেন জামাই রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তার দুঃখের সমভাগী হওয়ার জন্য। পিতার এই কাজে আমি বড় আঘাত পেয়ে ছিলাম। কারণ তিনি একই ভাবে আমাকেও দুঃখের দিনে একবার দেখা করতে আসতে পারতেন। আমি তার জামাইকে নিজ ইচ্ছায় পরিত্যাগ করে রাবণ বা তার সাগরেদদের খোঁজে বনে আসিনি।আমাকে তার জামাই নির্বাসনে পাঠিয়েছে। আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম যে অনেক মানুষ স্বার্থের খাতিরে আত্মীয়তা গড়ে তোলে। রামচন্দ্র জগৎপতি না হয়ে একজন সাধারন মানুষ হলে আমার পিতা হয়তো তার খবর নিতেন না। অবশ্য মাতা মহারানী সুনয়না এবং আমার বান্ধবীরা রামচন্দ্রের এই কার্যকে ধিক্কার জানিয়েছিল।
খুব খুব খুব সুন্দর।
উত্তরমুছুন