রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০২১

মানি অর্ডারের টাকা || সৈয়দ আব্দুল মালিক || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

 মানি অর্ডারের টাকা

 সৈয়দ আব্দুল মালিক 

 মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস

       


   

সঙ্গের মেয়েরা মলয়াকে এক প্রকার জোর করেই ক্যন্টিনে নিয়ে গেল।মলয়া বাধা দিল না।এক ধরনের আনন্দই পেল।

ক্যান্টিনে তখন এক দল ছেলেমেয়ে বসে চা খাচ্ছিল।তারা হেসে হেসে বেশ স্ফুর্তির সঙ্গেই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল।ম্যানেজারের পেছনে থাকা রেডিওতে বিবিধ ভারতীর ‘মনের মতো’অনুষ্ঠানে গান বাজছিল।লাউড স্পীকার লাগিয়ে দেবার জন্য গানগুলি বহু দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। 

মলয়ারা খালি থাকা চেয়ারটাতে বসল।দীপা,পার্বতী,জাহানারা,মীনা এবং অলকা এক প্রকার জো্র করেই ওদের মধ্যে বসিয়ে রাখল।ছেলেরা এবং অন্যান্য মেয়েরা ওদের দিকে তাকাল।কেউ আস্তে করে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল।

আরও কয়েকটি ছেলে ভেতরে চলে এল।দুয়েকজন পয়সা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দীপারা ছেলেটিকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিল।চা,চপ,পটেটো ফ্রাই এবং পুডিং।

অর্ডারের কথা শুনে পাশের চেয়ারটাতে বসা ছেলেগুলির একজন জিজ্ঞেস করল,‘আজ স্পেশিয়াল কিছু আছে নাকি?আজ কে খাওয়াবে?’

‘মলয়া।মলয়ার আজ দুটো ভালো খবর আছে জান?’

‘সত্যি?কী খবর?ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থাকবে না নাকি?’

মলয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

জাহানারা বলল,‘সেকথা বলতে পারি না।কিন্তু সত্যি সত্যিই মলয়ার আজ দুটো ভালো খবর আছে।’

ছেলেরা মলয়ার দিকে তাকাল।মলয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে।গ্রামের মধ্যে কিছুদিন আগে তৈ্রি হওয়া কলেজটি থেকে ইউনিভার্সিটির মধ্যে ডিস্টিংশনে প্রথম হয়ে বি.এ পাশ করে এসে ইউনিভার্সিটিতে নাম লিখিয়েছে।মলয়া মেয়েটি দেখতে শুনতে ভালো,সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী।কথাবার্তায় খুব ভদ্র এবং অমায়িক।ইউনিভার্সিটির প্রায় সমস্ত ছেলেমেয়ের সহজ মেলামেশা আছে,এমনকি সঙ্গের ছেলেরা হাসি ঠাট্টা করলেও শান্তভাবে হাসা ছাড়া অন্য কিছু করে না।

‘ভালো খবরের ভাগ আমাদের ও দেবে না কি?’একটি ছেলে বলল।

‘এমন কিছুই না বুঝেছ-’মলয়া বলল।

‘কিছুই নয় কেন।মলয়া ন্যাশনেল স্কলারশিপ পেয়েছে সেটা একটি ভালো খবর এবং আজ ভাইয়ের কাছ থেকে দেড়শো টাকার একটি এম.ও এসেছে।আজ কি মলয়া এমনিতেই আমাদের খাওয়াতে নিয়ে এসেছে নাকি?’

‘কনগ্রাচুলেশন’-ছেলেটি বলল,‘আমাদেরও খাওয়াতে হবে কিন্তু-’

মলয়া শান্তভাবে হাসল।অলকা বলল,‘মলয়া খুবই ভাগ্যবান ভাই,সরকারও টাকা দেয়,ভাইও টাকা দেয়।অথচ আমরা যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি সরকার সে খবরই রাখে না।বাবা টাকা কয়টি না পাঠালে এতদিনে মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে কারও বাড়িতে রাঁধুনি হতাম গিয়ে।’

অলকা স্ফুর্তিবাজ মেয়ে।খোলামেলা কথাবার্তা।সেজন্য সবাই ভালোবাসে ভয়ও করে।

পটেটো ফ্রাই চপ এল।

‘চা নিয়ে এসো-’

‘আনছি দিদি’-রোগা ছেলেটি আবার ভেতরে দৌড়ে গেল।

পাশের টেবিলে বসা ছেলেদের একজন চিৎকার করল,‘এই যে আমরা কেবল বসেই থাকব নাকি?সেই কখন থেকে বসে আছি।আমাদের দেখছেই না।নিয়ে আয়।’

‘আসছি’-ছেলেটি ভেতর থেকেই চিৎকার করে বলল।

কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি একটা ট্রেতে করে পুডিং আর চা এনে মলয়ার টেবিলে রাখল।

পাশের টেবিলের ছেলেগুলি সেদিকে তাকাল।

‘ও আমাদের দেখেই নি বোধহয়-’একটি ছেলে বলল।

‘আনছি দাদা,আজ আবার বাপুকণ আসেনি,আমাকেই সবজায়গায় দিতে হচ্ছে।’

‘যা যা এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না,চা নিয়ে আয়—’

দীপারা হাসতে হাসতে চপ,পটেটো ফ্রাই খেতে লাগল। চা যে ভালো হয়নি সে কথা নিজেদের মধ্যে চুপিচুপি আলোচনা করল।‘ইউনিভার্সিটি ক্যাণ্টিনের চা আর কত ভালো হবে?’পার্বতী মন্তব্য করল।

রেডিওতে দ্রুত তালের একটা গান বাজছিল।গানের সুরে পরিবেশটাকে জীবন্ত করে তুলছিল।

হঠাৎ একটা কর্কশ স্বর ভেসে এল—‘এই বয়,নিয়ে আসছিস না কেন?এখানে এভাবে বসে থাকব আমাদের আর অন্য কোনো কাজ নেই নাকি?’

অবশ্য তারা বসার খুব একটা দেরি হয়নি। তবু মেয়েরা খাচ্ছে আর পাশের টেবিলেই ছেলেরা খাবারের জন্য বসে রয়েছে,অস্বস্তি হওয়ারই কথা।

পটেটো ফ্রাই শেষ করে মেয়েরা ছোট চামচ দিয়ে পুডিং খেতে শুরু করেছিল। মলয়া চামচে করে কিছুটা পুডিং মুখের সামনে নিয়েছে,হঠাৎ একটা গণ্ডগোল শুনে সবাই সেদিকে ঘুরে তাকাল।

‘স্টপড,শুধু দুকাপ চা নিয়ে আসতে দুইঘন্টা লাগে,নবাবের বেটা আর এত কেয়ারলেস স্কাউন্ড্রেল মজা পেয়েছিস গরম চা এনে কাপড় চোপড়ে ফেলে দিলি’-বলার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং চা নিয়ে আসা ছেলেটিকে সজোরে দুটো চড় কষিয়ে দিল। ছেলেটি পড়তে পড়তে নিজেকে কোনো ভাবে সামলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো ভাবে কোনো রকমে জানাল-‘আপনি চট করে ঘুরে গেলেন বলেই তো,আমি কী করব।’

ম্যানেজার উঠে এল। প্রথমেই বয়কে একটা থাপ্পড় মেরে ছেলেটির কাছে এগিয়ে এল এবং কোথায় কতটুকু চা পড়েছে দেখে নিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না।একে,তাড়াতেই হবে।দুঃখী ঘরের ছেলে দেখে রেখেছিলাম।কিন্তু এদের দায়িত্বজ্ঞান নেই।এই,এদের সবাইকে একটা করে চপ দে।’

চড় খেয়ে ছেলেটি মেয়েদের সামনে লজ্জা পেল,মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো মুখে সে ভেতরে চলে গেল।

জাহানারারা চা পুডিং সবকিছু তৃপ্তি করে খেল।মলয়া পুডিং খেল না,মুখের কাছে নিয়ে চামচটা রেখে দিল।এক নিশ্বাসে ঠাণ্ডা জলের গ্লাসটা শেষ করে মলয়া মাথা নিচু করে বসে রইল।

দীপা চায়ের পেয়ালাটা শেষ করে মন্তব্য করার মতো বলল,‘জানিস এই হোটেল বয়গুলি একেবারে ওয়র্থলেস।এক কাপ চা দিতেও এক ঘণ্টা সময় নেয়।–ছেলেটার পেন্টটা নষ্ট করে দিল-’

মলয়া কোনোকিছু বলল না।পয়সা দিয়ে সবাই ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এল।

মলয়ার একটা ক্লাস ছিল।কিন্তু মলয়া আর ক্লাসে গেল না,ব্যাগ আর খাতা বই নিয়ে মলয়া বাসস্থানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল,সিটিবাসের জন্য অপেক্ষা করল না।

মলয়া গ্রামের খুব দুঃখী পরিবারের সন্তান।বাড়ির সামনেই হাইস্কুল থাকায় বৃত্তির টাকায় হাইস্কুলে পড়াশোনা করল,সেখান থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করে বৃত্তি পেল,বাড়ি থেকে দেড় মেইল দূরে নতুন করে স্থাপিত কলেজটিতে পড়ে মলয়া ভালোভাবে বিএ পাশ করল।গ্রামে কলেজটা না থাকলে তার আর কলেজে পড়া হত না।ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত মলয়া তাঁতে গামছা,কাপড় বুনে নিজের পড়ার খরচ বের করেছিল।গ্রামের কয়েকটি ছেলে মেয়েকে বাড়িতে পড়িয়ে কিছু টাকা পেত।চাষের সময়ে জমিতে কঠিয়া চারা লাগাত।মলয়ার বাবা নেই।

দাদা টাকা পয়সার অভাবে পড়াশোনা করতে না পেরে চাষবাসে লেগে রইল।খুব বেশি জমি নেই।নিজে চাষ করা ফসলে বছরের খাবার জোটে না।

অনেক কষ্ট অনেক অভাব।

এই অভাবের জন্যই মলয়ার ছোটভাই কেশব ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে চলে গেল।–কোথাও চাকরি করার জন্য।কয়েকবছর সে বাড়ি আসেনি।চিঠি পত্র দেয়।ছোট থাকতেই চলে গেছে,এতদিনে হয়তো যুবক হয়ে গেছে।কে জানে দেখতে কী রকম হয়েছে—

মলয়া আস্তে আস্তে নিজের বাসস্থানে এসে পৌছাল।ডাক্তার বিভূতি দুয়ারার বাড়ির ভেতরে দীর্ঘ ভাড়া ঘরের এক কোণে ছোট একটা ঘর নিয়ে মলয়া থাকে।সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন ছাত্রী থাকে।একসঙ্গে মেস করে খায়।

মলয়া নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।প্রায় এক মাইল পথ পায়ে হেঁটে আসার জন্য মলয়ার ক্লান্ত মনে হতে লাগল।চোখ দুটিও কেমন যেন জ্বলছে বলে মনে হল।

মলয়া উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে রইল।উপরের সাদা সিলিংটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইল।তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা চিঠি বের চোখের সামনে মেলে ধরল।

আদরের দিদি,

তোর চিঠি পেয়েছি বেশ কয়েকদিন হল।আমার উত্তর দিতে দেরি হল।কিছু মনে করিস না।তুই এখনও কেন বৃত্তির টাকা পাসনি বুঝতে পারলাম না।হাতে টাকা না থাকার জন্য তোর বোধহয় অনেক অসুবিধা হচ্ছে।আমার হাতেও খুব বেশি টাকা ছিল না।কোনো ভাবে ৯০ টাকা জোগাড় করে রেখেছিলাম।তবে তোর টাকার দরকার বলে ম্যানেজারের কাছ থেকে ৩০ টাকা অগ্রিম নিলাম।আমার সঙ্গে কাজ করা লোকনাথ নামে ছেলেটির কাছ থেকেও টাকা ধার করেছি।আজ তোকে দেড়শো টাকা মানি অর্ডার করে পাঠিয়েছি।

দিদি,টাকার জন্য কোনো চিন্তা করিস না,আমি যেভাবেই হোক তোকে টাকা পাঠাতে থাকব।হোটেলের চাকরি খারাপ নয়।আমাদের খাওয়াটা এমনিতেই হয়ে যায়।খাটুনিটাই বড় বেশি-ভোরবেলা থেকে শুরু করে রাত দুপুর পর্যন্ত খাটতে হয়।রাতে ভীষণ ক্লান্ত লাগে।আমাদের হোটেলের মালিক একজন পাঞ্জাবি।মানুষটা খারাপ নয়।আমাদের ধমক ধামক দেয় যদিও ভালোবাসে।কিন্তু কিছু খদ্দের বড় খারাপ।বলা মাত্র চা ভাত সব কিছু টেবিলে এনে হাজির করতে হয়।নাহলেই গালি গালাজ।কখনও কখনও চড় থাপ্পড়ও জোটে।

তবে হোটেলে চাকরি করতে গেলে এসব সহ্য করতে হবেই।তুই কোনো চিন্তা করিস না।আমি কি আর সব সময় এভাবে এখানে চাকরি করব?তুই পাশ করে বের হ।তখন কি তুই আর বড় চাকরি পাবি না?আমি প্রয়োজনে তোর ওখানে রান্না করব।

আমি বিড়ি সিগারেট কিছুই খাই না,সিনেমাও দেখি না।এসব অভ্যাস থাকলে তোর কাছে টাকা পাঠাব কীভাবে।আগামী মাসে কত টাকা পাঠাতে হবে জানাবি।আমি যেভাবেই হোক পাঠাব।তুই ভালোভাবে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় ভালো ফল কর।আমার জন্য চিন্তা করিস না।

আমি ভালো আছি।একটু শরীর খারাপ হলেও কাজ কামাই করি না।কামাই করলে বেতন থেকে পয়সা কেটে নেয়।

আশা করি তুই ভালো আছিস।

আমার স্নেহ ভালোবাস নিস।

                  ইতি 

তোর আদরের ভাই কেশব 

পুনঃ আমার হাতের লেখা খারাপ,অনেক ভুল থাকতে পারে,তুই হাসিস না।

–কেশব।

ভাইয়ের চিঠিটা পড়া শেষ করে মলয়া একদৃষ্টে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বিছানাতেই পড়ে রইল।মলয়াকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর জন্য কেশব হোটেলে-কোথাকার সুদূর পাঞ্জাবি হোটেলে বয়ের কাজ করছে।হয়তো দেড়শো টাকা জোগাড় করার জন্য অনেক গ্রাহকের কাছে প্রতিদিন আজেবাজে কথা শুনতে হচ্ছে,চড় চাপড় ও খেতে হচ্ছে।

আজ ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে সেই ছেলেটির হাতে চড় খাওয়া বয়টি এবং কেশবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।এই ছেলেটিও হয়তো হোটেলে বয়ের কাজ করে কোনো কলেজে বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দিদিকে পড়াচ্ছে। 

মলয়ার দুচোখ জলে ভরে উঠল।একটা মূক বেদনায় মলয়া বালিশে মাথা গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।

ঘরের দরজা বন্ধ ছিল।বাইরের সঙ্গীরা মলয়ার চোখের জল দেখতে পেল না। 

------

লেখক পরিচিতি-অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন।যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি কলেজে অধ্যাপনা করেন।লেখকের গল্প সঙ্কলন গুলির মধ্যে ‘পরশমণি’,শিখরে শিখরে’,শুকনো পাপড়ি’বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।‘অঘরী আত্মার কাহিনী’উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।                                                                      


1 টি মন্তব্য:

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...