একজন বুড়ো মানুষ-১৮,
নিরুপমা বরগোহাঞি,
অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস,
(শেষ অধ্যায়)
কমলারা বাড়ি তৈরি করার তিন বছর পরে বিজয় ভরালী আধুনিক রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। এই রোগ তার কলজেয় বাসা বেঁধেছিল। শেষের দিকে তিনি কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু অসুস্থতার শুরুতে যখন তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতেন,তখন সঞ্জয় কে বলে রেখেছিলেন যে তার যেন কোনো চিকিৎসা করা না হয়। 'এই অসুখে মৃত্যু যখন অবধারিত, যন্ত্রণার দিনগুলি দীর্ঘায়িত করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে শান্তিতে মরতে দে পোনা।' বিজয় ভরালী বলে রেখেছিলেন।
কিন্তু তবু ডাক্তার না এনে সঞ্জয় থাকতে পারেনি। বাবাকে সে বলছিল-' মৃত্যুর ওপরে ডাক্তারের হাত নেই সত্যি, কিন্তু ডাক্তার রোগির যন্ত্রনা কিছুটা হলেও তো উপশম করতে পারে।'
তাই ডাক্তার এসেছিল। শহরের নামকরা বিদেশি ডিগ্রিতে বিভূষিত ডাক্তার। বিজয় ভরালী আর কোনো আপত্তি করেননি। সঞ্জয়ের কথা ভেবেই আপত্তি করতে ইচ্ছা করে নি, একেবারে বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু হলে সঞ্জয়ের সান্ত্বনা কোথায় থাকে।
কিন্তু শেষের দিকে ডাক্তার যখন তাকে ভেলোরে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিল, তখন বিজয় ভরালী সঞ্জয়ের সামনে আর ও একবার আপত্তি করলেন।' আমাকে শান্তিতে মরতে দে পোনা। এই বুড়ো বেমারি শরীরটাকে আর টানা হেঁচড়া করে কষ্ট দিস না।' বিজয় ভরালী হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকটি সেন্টিমেন্টাল কথাও সেদিন ছেলেকে বলে ফেলেছিলেন- জীবনের প্রথম এবং শেষ বারের জন্যঃ ‘আমার জন্য দুঃখ করিস না পোনা। তোর মাকে ছেড়ে অনেক দিন আছি। সৌভাগ্য যে তোর মা কেনা মাটিতেই আমি মরতে চলেছি। এই জমিটা তোর মা বাড়ি তৈরি করব বলে অনেক আশায় ,কষ্টে সঞ্চিত টাকা দিয়ে কিনেছিল।'
বাবার সেই ইচ্ছাকে সঞ্জয় মেনে নিয়েছিল। বাড়িতে রেখেই সে বাবার চিকিৎসা করতে লাগল। সারাদিন বাবার দেখাশুনা করার জন্য সে একজন নার্স রেখে দিয়েছিল।
প্রথম অবস্থায় বিজয় ভরালী নিজে নিজে চলাফেরা করতেন। ধীরে ধীরে তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। এখন দিনরাত তাকে কেবল শুয়ে থাকতে হয়। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকা ছাড়া আর কিছু করার সামর্থ্য রইল না। ভাবনাগুলিও যেন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট ধূসর হয়ে আসতে লাগল। বই পত্রের সঙ্গে বহুদিন থেকেই সম্পর্ক নাই হয়ে গেছে। শুয়ে থেকে এখন সময়গুলি পার হয়ে যেতে লাগল। ভোর হয়, তিনি শুয়ে থাকেন, দুপুর হয় তখনও তিনি শুয়ে থাকেন, সন্ধ্যে নামে আর তারপর রাত আসে, তিনি কিন্তু শুয়েই থাকেন- কখনও চোখদুটি খুলে, কখও চোখ দুটি বুজে। রোগের যন্ত্রণায় কিন্তু বেশিরভাগই ঘুম আসেনা, কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব ওকে ঘিরে থাকে। মাঝে মাঝে তার সময়ের খবর নিতে ইচ্ছা করে, সামনের বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকা রাজপথের জ্বলন্ত জগতটার খবর জানতে ইচ্ছা করে, কয়টা বা বাজে এখন …বাড়ির সামনের পথ দিয়ে ছেলেমেয়েদের হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে দলবেঁধে স্কুলে যাবার সময় হয়েছে কিনা বা বোধহয় এতক্ষণে রূপুককে খাইয়ে-দাইয়ে সামনের বারান্দায় এনে আয়া তার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করছে, রুপুর মুখে এখন কথা ফুটেছে, বড় কথা বলে সে, বড় আদুরে কথা তার, হয়তো এখন সে আয়ার সঙ্গে বাইরে খেলতে খেলতে নানা কথা বলে চলেছে। কিন্তু সেই কথাগুলির একটা শব্দও এখানে এই বিছানা থেকে তিনি শুনতে পান না। কিন্তু এখন তার মানুষের কথা শুনতে খুব ইচ্ছা করে- দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, শুয়ে শুয়ে কাটানো তার এই ঘরটা এত নির্জন।এক প্রান্তের এই নিঃসঙ্গ ঘরটাতে মনে হয় বাইরের জগতের কোনো শব্দ ভেসে আসে না।
ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নেন বিজয় ভরালী। চোখদুটো মেলে ঘরের একই জিনিসগুলিকে দিনের পর দিন আর কত দেখা যায়।অনেকদিন ধরে শয্যাশায়ী হয়ে থাকা রোগিরা বা কী করে…বিয়ের আগে নাকি ইলার একবার একটা পায়ের হাড় ভেঙ্গেছিল,পুরো দুমাস নাকি সে শয্যাশায়ী ছিল,পা-টা প্লাস্টার করা ছিল।শুয়ে শুয়ে ইলার নাকি অসম্ভব বিরক্ত লাগছিল। একজন কেউ তার কাছে না থাকলে ইলা নাকি চেঁচামিচি করত-কিন্তু তবুও মাঝে মধ্যে তাকে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে হত। তখন নাকি ইলা তার বিছানার কাছে থাকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় কাটিয়ে দিত। জানালার দিকেই নাকি ওদের একটা প্রকাণ্ড সজনে গাছ ছিল।গাছটা তার ডালপাতাগুলি মেলে জানালা দিয়ে দেখা আকাশটা একেবারে ঢেকে ফেলেছিল। ইলার নাকি শুয়ে শুয়ে সেই গাছটা,তার ডালে বসে থাকা দুই একটি পাখি ,তার শাখা প্রশাখার মধ্য দিয়ে দেখা নীল আকাশের আভাস দেখে দেখে খুব ভালো লাগত।
বিজয় ভরালীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে-তার কাছে অনবরত কেউ একজন যেন বসে থাকে-বড় ইচ্ছা করে তার-কিন্তু ইলার মতো বাড়ির কার কাছে বা সে আবদার করে? তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চোখ জুড়োনোর জন্য জানালার ওপাশেই একটা প্রকান্ড পাকা দোতলা ঘর,তাকাতে তাকাতে তার চোখজোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়ত। জানালার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশের কিছুটা আভাস দেখা গেলেও ! আকাশ! একসময়ে ‘ব্লেসেড ডেমোজেল’কবিতাটা তার বড় প্রিয় ছিল,কলেজ জীবনে সেই কবিতাটা পড়ে তার গায়ে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গিয়েছিল,ইলাকেও একদিন তিনি খুব আবেগের সঙ্গে সেই কবিতাটা পড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল আর ইলা সশব্দে কেঁদে ফেলেছিল। বুজে থাকা চোখজোড়া আপনা থেকেই খুলে যায় বিজয় ভরালীর আর ব্যর্থ আশার দৃষ্টি জানালার কাছ থেকে ফিরে আসে।আশা-কে জানে একটু আকাশ হয়তো দেখা যাবে-সেই আকাশ,যার সোনার রেলিঙে ভর দিয়ে ইলা হয়তো ‘ব্লেসেড ডেমোজেলর’মতোই তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে…কাঁদতে পারলে বোধহয় মনটা হাল্কা হয়ে যায়,কিন্তু তিন আজ পর্যন্ত কাঁদতে পারেন নি। আচ্ছা পোনা বড় হওয়ার পরে কখনও কেঁদেছে কি?শৈশবে তো সে ইলার কাছে কথায় কথায় বায়না ধরে কাঁদত…। আচ্ছা ,তার মৃত্যুতে পোনা কাঁদবে কি? কাঁদলেও কাঁদতে পারে।কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে পোনা আসলে দুঃখ করে কাঁদার মতো কিছু নেই। তাঁর কাছে মৃত্যু মানে এই পৃথিবী থেকে মুক্তি,যে পৃথিবীকে ইলা প্রাণভরে ভালোবাসত।কিন্তু যে পৃথিবী তার কাছে চিরকাল নিষ্ঠুর এবং উদাসীন হয়ে রইল-নাহলে জীবনে তিনি তো কারও কোনো অপকার করার কথা মনে পড়ে না,একটা সত্যনিষ্ঠ সাধুর জীবন কাটিয়েছেন তিনি,কিন্তু তার বিনিময়ে তাকে কেন এত দুঃখ কষ্ট পেতে হল? ইলাকে তার কাছ থেকে অকালে কেড়ে নিয়েই তো ক্ষান্ত রইল না জীবন,তাঁর একমাত্র পুত্রের জীবনেও কেন সুখ আহ্লাদ দেখা থেকে তাকে বঞ্চিত করে রাখল? তাই তার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো শারিতে আজ তিনি পৃথিবীর কাছে শেষ বিদায় চাইতে চান-‘হে উদাসীন পৃথিবী,আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে,তোমার নির্মম পদপ্রান্তে আজ রেখে যাই আমার প্রণতি-’ …পুনরায় চোখদুটো বুজে নেয় বিজয় ভরালী-’ইস, এই মাছিদের এত অত্যাচার,নার্স যে সারাটা দিন কোথায় থাকে,সময়মতো ওষুধটুকু খাইয়ে যাওয়া ছাড়া তার কাছে আসতেই চায় না,কিন্তু তারই বা দোষ কোথায়,নার্সের শুশ্রূষা তো পয়সার বিনিময়ে,অন্তরের তাগিদায় তো নয়। পোনা তো ছুটি নিয়ে আমার কাছে থাকতে চেয়েছিল,আমিইতো প্রবল প্রতিবাদ করেছিলাম এখন প্রয়োজন নেই বলে’-বিজয় ভরালী ভাবলেন এবং তাঁর শীর্ণ মুখে একটা ম্লান হাসির ঢেউ খেলে গেল-‘এখনই দরকার নেই-অর্থাৎ আমার মৃত্যুর সময় হয়নি।’কার কখন মৃত্যু হবে তা কি মানুষ আগে থেকে কখনও জানতে পারে,ইলার যে হঠাৎ মৃত্যু হবে তা কি ইলা নিজেই কোনোদিন বুঝতে পেরেছিল বা আভাস পেয়েছিল? অথচ পোনার জন্মের সময় দেখছি দুজনেই বিভীষিকা দেখে দেখে মৃত্যুর জন্য পথ চেয়ে থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু তো এল না? … ইস মাছির কী অত্যাচার,নার্স কোথায় যে গেল।’দুর্বল মাথাটাকে খুব ধীরে ধীরে নাড়িয়ে বিজয় ভরালী মুখ থেকে মাছিগুলিকে তাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে।…
খুব ধীরে ধীরে এবং নিঃশব্দে সঞ্জয় বাবার ঘরে প্রবেশ করে।দূর থেকে বাবার বুজে থাকা চোখজোড়া দেখে তার মনে হল যে যন্ত্রণার মধ্যেও বাবার হয়তো তন্দ্রার ভাব এসেছে। সেই ঘুমের ব্যাঘাত না করে সে যথাসম্ভব নিঃশব্দে বাবার বিছানার কাছে চলে এল।
বিজয় ভরালী চোখদুটি বন্ধ করে অসারভাবে পড়েছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে সঞ্জয় দেখল –অনেকদিন না কামানো আধা-পাকা কাঁচা দাড়ির আড়ালে বাবার ঢুকে যাওয়া গাল দুটির গর্ত প্রকট হয়ে পড়েছে,বুজে থাকা চোখদুটির কোণে কিছুটা পিঁচুটি জমে আছে,মুখটা বড় অসহায়ভাবে হা করে আছে,কয়েকটা মাছি মুখের আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। হাড়-চামড়া সর্বস্ব একটা শীর্ণ হাত কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে বিছানার পাশে ঝুলে আছে-একহাতে বাবার মুখের মাছিগুলি তাড়াতে শুরু করে উদ্গত দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা যেন বাবার ঘুমের কোনোরকম ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে তার জন্য সাবধান হয়ে মুখটা ঘোরানোর সময় সঞ্জয়ের চোখদুটি বাবার বিছানার ওপাশে থাকা বুক সেলফের ওপর পড়ল -বই সর্বস্ব জীবন কাটানো বাবার বইগুলি অনাদৃতভাবে সেলফের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে,সেগুলির ওপরে ধুলোর আস্তরণ।অনেকদিন থেকেই বাবা এই বইগুলি ছূঁতে পারেন নি-আর-আর এই জীবনে কোনোদিন পারবেন না।
হঠাৎ সঞ্জয়ের চোখের কোণে দুফোঁটা জল জমা হল। ধীরে ধীরে বিজয় ভরালী ঘোলা চোখদুটি মেলে তাকালেন।
‘কে?’ …
‘পোনা-’ বিজয় ভরালী প্রায় অস্পষ্ট কন্ঠে বললেন। আর তারপরে বিজয় ভরালী দেখলেন –শৈশবে কথায় কথায় মায়ের কাছে কান্নাকাটি করা ছেলেটি এখন বড় হয়ে বাবার কাছে দুইহাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদছে।
---------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন