স্মৃতিকথা ৮
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
( গতমাসের পর)
দেখতে দেখতে স্কুলের সঙ্গে পরিচিতি এলো, সেই সঙ্গে এলো বেশ কিছু সহপাঠী বন্ধু । কো-এডুকেশন প্রাইমারি স্কুলে কি মজায় দিন কাটছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। পড়াশোনার সাথে সাথে খেলাধুলা, শনিবার শনিবার প্রেয়ারে আমার আলাদা করে গান গাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিল । গনেশ দাদুনের বাড়ি ধীরে ধীরে বসবাস করার অযোগ্য হয়ে যাচ্ছিল । বাবা ঘর খুঁজছিল , কিছুদিনের মধ্যে এই শহরের বল্লভপুর এলাকায় প্রায় নতুন একটি বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল । বাড়ির মালিকের নাম নকুল কারক । তারা এ বাড়িতে থাকতেন না। একানে বাড়ি । আমরাই সব । ঘর ছিল পাঁচটি । মাত্র পন্ঞ্চাশ টাকা ভাড়াতে এই বাড়ি ষাটের দশকে ঈর্ষণীয় । দুটি টয়লেট থাকার সুবাদে বাবা দুটো ঘরে সাবটেনেন্ট বসিয়েছিল পঁচিশ টাকা ভাড়াতে । ফলে আমাদের আর্থিক দিক দিয়ে কিছু সুবিধে হয়েছিল । বাড়ির নাম বেলা ভবন । টাউন স্কুলের উল্টোদিকের গলির ভেতরে ছিল বাড়িটা । সামনে ছিল বেশ বড় একটা পুকুর । পাশে সরস্বতী মন্দির । এই মন্দিরটির একটা ইতিহাস আছে । মন্দিরে সারা বছর পুজো হত না। মাঘী পন্ঞ্চমীতে তিন দিন ধরে পুজো হত । আসলে এটি জেলে পাড়ার মন্দির । এই মন্দিরটি বৃত্ত করে জেলে পাড়ার বসতি । এই সরস্বতীর নাম নীল সরস্বতী । এটি বৌদ্ধধর্মের একটি দেবী মূর্তি । দেবীর রঙ সাদা , তার দুই সখী অবস্থান করতো । বড় বয়সে এই মন্দিরটি নিয়ে দৈনিক বিপ্লবী সব্যসাচী পত্রিকায় লেখার জন্য খোঁজ নিতে গিয়ে জেনেছি এই সরস্বতী জলের দেবী । তাই মৎসজীবীরা এই পুজো করতেন । সরস্বতী কথার অর্থ এখানে জল অর্থাৎ সরসবতী । আর তার বাহন রাজহাঁস অর্থাৎ যার সঙ্গে জলের সম্পর্ক আছে ।
এই বেলা ভবন ভাড়া নেবার সময় বাবা আমাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল । আমি ওখানে প্রথম ইলেকট্রিক লাইট দেখেছিলাম । বাবা আমাকে সুইচ টিপে দেখালো, তারপর আমাকে টিপতে বললো । আমি টিপতেই আলো জ্বলতে আমার কি আনন্দ! গনেশ দাদুনের বাড়ি থেকে বল্লভপুরে উঠে আসার পরেও বহু বহুদিন দাদুনের বাড়ির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল । মাঝেমধ্যে মা আমাকে নিয়ে ওদের বাড়ি যেত । দাদুন তখন বেঁচে নেই । দিদিমা কি খুশি হতেন আমাকে দেখে!
ন্যাড়া ছাদের একতলা এই বেলা ভবন বাড়িটি কোনদিন বাড়িওলা দেখতে ও ভাড়া নিতে আসেন নি । আসলে এই নকুল বাবু বাবার কাছে কোন কারণে কৃতজ্ঞ ছিলেন সে কারণে বদান্যতা দেখাতেন বাবার প্রতি । আমি ও দিদিরা গোটা বাড়িতে প্রচুর জায়গা পেয়ে খেলাধুলাতে মন দিলাম । তবে সন্ধ্যাতে পড়তে বসতেই হত । কিন্তু এই সময়টা আমার বড়ই কষ্টের সময় । খেলে আবার পর পড়তে বসলেই দুচোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসতো । সমানে ঘুমে ঢুলে পড়তাম আর ছোড়দি সমানে বকা দিয়ে যেত । শেষ রাত নটাতে খেয়ে দেয়ে সেই যে ঘুম, উঠতাম একদম সকাল ।
আমার স্কুল ছিল সকালে । স্কুল বল্লভপুর থেকে বেশ অনেকটা দূর বলে মা আমাকে সামনের রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাইমারিতে ভরতি করতে চেয়েছিলো । কিন্তু বাদ সাধলো আমার স্কুলের ছোড়দিমনি তরুলতা ঘোষ । তাঁর বাড়ি ছিল বল্লভপুর থেকে পায়ে হাঁটা দূরে । আমাদের সঙ্গে ছোড়দিমনির বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছিল । উনি আমাকে নাতির চোখে দেখতেন । মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে গল্প করতে আসতেন । সে সময় মা অন্য স্কুলে ভর্তির কথাটা পেড়েছিলেন ওঁনাকে । উনি বাধা দিয়ে বলেছিলেন, সকালে আমার কাছে ওকে পাঠিয়ে দেবেন, আমি ওকে স্কুলে নিয়ে যাব । তারপর থেকে দিদিমনির কাছে আমার দিদি আমাকে ওঁনার বাড়ি ছেড়ে আসতো তারপর আমি যেতাম ওঁর সঙ্গে স্কুলে আবার ওঁনার সঙ্গে ফিরে আসতাম ।
এভাবে দিন কাটছিল । ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছিলাম । জিজ্ঞাসা গড়ে উঠছিল, বিস্ময় নিয়ে সারাক্ষণ থাকতাম । বাড়িতে মায়ের গানবাজনার চর্চা, বাবার নাটকের চর্চা সব মিলিয়ে জীবন সুন্দর আর সুন্দর । স্কুলের পড়াশোনার প্রতি সামান্য মনোযোগ থাকলেও কিন্তু অন্য পড়াশোনা অর্থাৎ খবরের কাগজ, দেশ, অমৃত, ঘরোয়া ইত্যাদি এলে তার ওপর হামলে পড়া আমার বিশেষ অভ্যাস ছিল । বাড়ির কাছাকাছি মাইকে বেশির ভাগ সময় বাংলা হিন্দি গান বাজতো । আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল হরি সিনেমা । সে সিনেমায় বিকেলে আকর্ষণের জন্য বাজতো সিনেমার গান । নিয়মিত এক গান বাজতে বাজতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল গানগুলো । দাদা ও বড়দির সঙ্গে বয়সের তারতম্যের কারণে তাদের সঙ্গে দুরত্ব ছিল আমার । মাঝেমধ্যে তারা স্নেহচ্ছলে আমার সঙ্গে খুনসুটি করতো, ওই পর্যন্ত ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন