কিছু বই কিছু কথা- ২৯২ || চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা : দেবযানী বসু || আলোচক: অলোক বিশ্বাস
চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা :
দেবযানী বসু
আলোচক : অলোক বিশ্বাস
অ্যান্টি-ন্যারেটিভ কবিতা লেখেন শূন্য দশকের কবি দেবযানী বসু। একটি স্থির বা অস্থির ছবিতে নিজের ভাবনা ইম্পোজ কোরে নির্ধারণ করেন নতুন নতুন অদ্ভুত সব মনস্তাত্বিক বাক্য। একটি ফ্রেমে ধরে রাখা যায় না ওঁর কবিতা। হয়তো একটি ফ্রেমে ধরার ইচ্ছায় সামগ্রিক অর্থবোধক স্থানগুলি চিহ্নিত করার আগেই ফ্রেম থেকে ছিটকে পড়ে পাঠকের চিন্তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় কোরে দেবে এই গ্রন্থের চার পংক্তিতে রচিত ৯৮ টি কবিতা। কবি প্রতিটি কবিতাকে আয়তক্ষেত্রকার অবয়বে লিখেও নাম দিয়েছেন চৌরেখাবতী পিরামিড। নামটি স্ত্রীলিঙ্গাকার। পিরামিড ত্রিভুজাকৃতির। বোঝা যাচ্ছে মানুষের চিন্তার আদলের রূপটি বস্তুর দিত্ব ত্রিত্ব অবস্থাকে আশ্রয় দেয় কখনো। চিন্তক কোনো গতি রেখায় বহুক্ষণ আটকে থাকেন না। তাঁর চিন্তন প্রক্রিয়া এলোমেলো হলে শাশ্বত দর্শন বলতে যা যা আমাদের আক্রান্ত কোরে রেখেছে এখনো, তাঁর সকল শৃঙ্খলা নিয়ে উপর্যুপরি মস্করা করা যেতে পারে। কোনো কবিতার পৃথক শিরোনাম নেই। ৫৭ সংখ্যক কবিতায় তিনি লিখছেন--- "বোতলে সমগ্র গঙ্গা ধরেছি।" গঙ্গাকে প্রবহমান পৌরাণিক দার্শনিক রূপ দেওয়া হয়েছে এর নৈসর্গিকতার প্রধান সত্যটিকে অগ্রাহ্য কোরে। কবি সম্ভবত এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই বিদ্রূপাত্মক ভাবে লিখছেন, "বোতলে সমগ্র গঙ্গা ধরেছি।" তার আগেই লিখেছেন--- "বিশাল রথের হাজার কেন্নো-পা। " তারপর লিখছেন, "কাগজের শতাব্দী জমানো আর্তি মেঝে থেকে ছাদ।" প্রতিটি ছবিতে কবির চিন্তার কারিকুরি সন্নিবদ্ধ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে স্থা-ব্যবস্থাকে মক করছেন। সমগ্র গঙ্গাকে একটি বোতলে ধরার ব্যাপারটি পৌরাণিক দর্শনকে নিগেট করা, তেমনি মাইক্রো-স্ট্রাকচারালিজমকে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখানো। কবিতার আয়তক্ষেত্রকার গঠনকে ত্রিভুজ নাম দিয়ে তিনি পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের ছেতরে যাওয়া চেহারাটি সামনে আনছেন, বোঝা যাচ্ছে। ভাবা যাক একটি বম্ব ব্লাস্টের ঘটনা। ঘটনাটি ঘটার পর আমরা কোন চিত্র দেখি ? পাঠক, মনে করুন, দক্ষিণ ভারতে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী একটি মঞ্চে বক্তৃতা দেবার সময় রিমোট কন্ট্রোলে ব্লাস্টটেড হয়ে গেছিলো রাজীব গান্ধীর সম্মুখে এসে পড়া আত্মঘাতী এক নারী। পরের দৃশ্যটি স্বাভাবিকভাবে সম্পূর্ণ ভয়ংকররূপে স্ক্যাটার্ড অবস্থার চিত্র। মঞ্চটি যদি হয় কেন্দ্রীয় ভাবনার স্মারক, তাহলে ব্লাস্টিং-এর ঘটনা সেই স্মারককে চুরমার কোরে দিয়ে বিকেন্দ্রিকতার পোস্ট- স্ট্রাকচারাল প্রক্রিয়াকে নিরূপণ কোরছে। যদিও 'নিরূপণ' শব্দটি আধুনিকতার দোসর। তবু সাযুজ্য বোঝানোর জন্য ব্যবহার করলাম। দেবযানীর কবিতা এভাবেই ছেতরে যাবার প্রক্রিয়ায় নির্মিত, আমার মনে হয়েছে। প্রথম বাক্যটির সঙ্গে দ্বিতীয় বাক্যের আপাত সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় বাক্যের সঙ্গে তৃতীয় বাক্যের বা চতুর্থ বাক্যের আপাত সম্পর্ক খুঁজতে না গিয়ে পাঠক হিসেবে আমি আগে কবিতা থেকেই কবির জীবন যাপনকে পর্যবেক্ষণ করছি। আর কবির চিন্তার চলন প্রক্রিয়াটিকেও অনুধাবন করার চেষ্টা করতে করতে দেবযানীর কবিতার স্ক্যাটার্ড রূপের সৌন্দর্যকে উপভোগ করছি। আসলে, সামগ্রিকতা বা মর্মকথা বা মর্মমূল বা মৌলিক দর্শন বা সংহত বা সঙ্গবদ্ধচিন্তা--- এইসব ব্যাপারগুলো দেবযানী বসুর কবিতার ক্ষেত্রে খাটে না। যেমন, ওঁর কবিতার আলোচনায় চেতনা, পরাচেতনা, অবচেতনা, অতিচেতনা ইত্যাদি টার্ম ধরে এগোলে বিভ্রান্তির শিকার হতে হবে। পড়া যাক আলোচিত গ্রন্থের ৬৩ সংখ্যক কবিতাটি--- "নেকড়েরা প্রহরে প্রহরে জ্যোৎস্না বমি করছে। রাশিচক্রের/প্রাণীরা নতুন চারণভূমির খোঁজে মহাকাশে পাড়ি দেয়।/মধ্যযুগের ঈগল হার্ডডিস্কে পশুশালা খুলেছে। তার সাম্রাজ্য/বেহাত হবে না আর। চোখের জল দ্রুত ছোটে, আলোর মতো"। আবার পড়া যাক--- "ইদানিং ভড়কে যাচ্ছে কাঁচের গ্লাস। নানানানা কোরে/একস্ট্রা লাগেজ সেজে থাকছি। আমার ঘরের চাইতে বেশি/বারান্দা পিছল। উত্তরমালা দেখে অংক সাজায় মহানিম।/গঙ্গার নাভিশ্বাস স্পর্শ কোরে তর্পণ করি। ড্রিম ড্রিম সন্ধ্যা।" অর্থাৎ কোনো রৈখিক সিকোয়েন্স নেই এইসব কবিতার। শুধু দেখা, পর্যবেক্ষণ আছে অদ্ভুত কল্পনা আর জীবন বাস্তবতার টুকরোকে অধিবস্তবতায় মিশিয়ে প্র্যাকটিকাল প্রয়োগ। ওঁর কবিতায় শুরু এবং শেষকেও প্রচল ছকে পাওয়া যাবে না। কোনো দর্শন চেতনায় লেখা হয় না ওঁর কবিতা। খালি অভূতপূর্ব কল্পনার আনন্দে যাবতীয় ঘটনার সংমিশ্রণ ঘটাতে থাকেন তিনি সিদ্ধান্তহীনভাবে। এই বইয়ের ভূমিকায় বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক আনন্দ ঘোষ হাজরা দেবযানীর কবিতার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে ননসেন্সিক্যাল ভার্সের উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন লুইস ক্যারোলের লেখার কথা। হ্যাঁ, আমি একমত অগ্রজ কবির সঙ্গে। লুইস ক্যারোলের "Through the Looking Glass and What Alice Found There" এই উপন্যাসটিতে অনেক ননসেন্সিক্যাল পরিস্থিতি, চরিত্র ও ঘটনার প্রবাহ আছে। আছে ননসেন্স শব্দের ব্যবহার, এমনকি ননসেন্স কবিতার সংযোজন। দেবযানী বসুর কবিতায় এমত কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাই আমি। 'পান' শব্দ ব্যবহার ব্যবহার করেছেন। নতুন শব্দের ছড়াছড়ি ওঁর কবিতায়। যেমন, মধুলিঙ, নিত্যকল্যাণী, লবঙ্গবতী, কানুলোভ, পুতুলমেধযজ্ঞে, ধর্ষণসুন্দর, ফোয়ারাভঙ্গিমা, গানমঙ্গল, পুতুলমঙ্গলম, তুমিত্ব, থিমথামানো, ইনানোবিনানো, রঙিনপনা, ত্বমসিকদম্বম ইত্যাদি। বাক্যের গঠন এতোই অচেনা যে প্রচলিত কবিতার পাঠক ধাক্কা তো খাবেই, এমনকি যাঁরা নিয়মিত কবিতা পড়লেও কবিতার পোস্টমডার্ন রিসার্চ ওয়ার্কের সঙ্গে তেমন পরিচিত নন, তাঁরাও ব্যাপক ধাক্কা খাবেন। দেবযানীর কবিতা পড়তে হবে ধীরে, পড়তে পড়তে ভাবতে হবে এবং আবার পড়তে হবে কোনো সিদ্ধান্তচিন্তা কবিতায় পাওয়ায় আশা না করেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন