স্মৃতিকথা - ৭
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
(গত মাসের পর )
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
(গত মাসের পর )
পরের বছর আমার শুরু হল প্রকৃত স্কুলে যাওয়া অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান । নতুন সহপাঠী বন্ধু বান্ধবী ।
কো-এডুকেশন স্কুল হওয়ার সুবাদে ছেলে মেয়েদের শিশুভিত্তিক মেলামেশা সবমিলিয়ে বেশ বেশ বেশ ভালো সময় । অলিগন্ঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে স্কুল ড্রেস ছিল
সাদা জামা কালো হাফ প্যান্ট । ছোড়দি মনি যাকে বলতাম তিনি ছিলেন হেড মিস্ট্রেস, আসল নাম তরুলতা ঘোষ, এছাড়া সুরমা দিদিমনি, আবাসা দিদিমনি ( আসল নামে কেউ ডাকতেন না, মেদিনীপুর শহরের আবাস অন্ঞ্চলে থাকতেন বলে ওই নামে সকলে ডাকতো) , বীনা হালদার এরা ক্লাস নিতেন । তাঁরা ছিলেন দারুণ স্নেহভাজন । আমার গানের গলা ভালো হওয়ার কারণে ওঁরা একটু বেশি ভালোবাসা দিতেন । প্রতি শনিবার প্রেয়ারে আমায় গান গাইতে হত । কখনো সখনো টিচার্স কমনরুমে গান শোনাতে ডাকা হত । গাইতাম সে সময়ের জনপ্রিয় সলিল চৌধুরীর গানে সবিতা চৌধুরীর গাওয়া ' ঝিলমিল ঝাউএর বনে ঝিকিমিকি ' , কখনো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ' হরে কৃষ্ণ নাম দিল প্রিয় বলরাম ' আবার কখনো মায়ের শুনে শুনে শেখা কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত । দিদিমনিরা দারুণ আশীর্বাদ করতেন ।
এভাবে শুরু স্কুল জীবন । বাবা অফিসে থেকে এসে সন্ধ্যায় পড়াতে বসতেন । তাতে পড়া বেশ রপ্ত হয়ে যেত । তাছাড়া দিদিমনিরা দারুণ পড়াতেন । পড়ার প্রতি ঝোঁক হয়তো এই কারণে হয়েছে। ফিজিক্যাল ট্রেনিং পিরিয়ডে আমাদের লেফট রাইট করাতে করাতে দিদিমনিরা গাইতেন কুচকাওয়াজের সুরে : ' চলে মশ্ মশ্ মশ্ মশ্/ বাঁ ডান মশ্ মশ্/ সবচেয়ে বড় পা গাড়ি/ ট্রামে বাসে চড়ি না লাগে মারামারি/ রেলগাড়ি চড়া সে যে বড় ঝকমারি । ' এ গানের সুর এখনো আমার ভেতরে অম্লান । আগেই বলেছি বাবা নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিল । মেদিনীপুরে নাটকের নতুন নতুন কলাকৌশল আনার বিষয়ে প্রধান হিসেবে বাবাকে ধরা হয়। বাবা ষাটের দশকের প্রথমে মীর বাজারের ' সান্ধ্যবাসর ' , তারপর আরো কয়েকটি শৌখিন থিয়েটার ঘুরে বাবা শেষে কর্ণেলগোলাতে ' নাট্যরূপা 'য় মুখ্য অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক হিসেবে যোগ দেয় । নাট্যরূপাতে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নির্মল দাশগুপ্ত যিনি বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্তর ছোট ভাই ছিলেন । কর্ণেলগোলাতে নির্মল কাকুর বাড়িতে হত মহড়া । উনি ছিলেন রেশন ডিলার ও মেদিনীপুর পৌরসভার কমিশনার ও পরে চেয়ারম্যান হন। বাবাকে বিশেষ মান্যতা দিতে দেখেছি তাঁকে । নাটকের বিষয়ে মনে এলো , একবার ' সান্ধ্য বাসর ' - এর হয়ে আমি পার্ট করেছিলাম । নাটকের নাম ছিল স্ট্রিট বেগার । বাবা মুখ্য অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক । বাবা হয়েছিল ছেলেধরা যে আমায় ধরে নিয়ে যাবে । ছাপানো প্রোগ্রামে আমার নাম দেওয়া হয়েছিল মাস্টার টোটন । ওই নাটকের একটি সিনে আমার দুই দিদি ও দাদাকে বাবা অভিনয় করিয়েছিল । নাটকের এক একটা সিন শেষ হচ্ছে আর উদ্যোক্তারা দিয়ে যাচ্ছে আমার হাতে বিস্কুট । তবে শেষ সিনে স্টেজে যাব না বলে বেঁকে বসেছিলাম । অনেক বুঝিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হয় ও সাকসেসফুল ভাবে উতরে দিয়েছিলাম । এরপরে অন্য একটি দল থেকে আমার অফার এসেছিল । কিন্তু বাবা অনুমতি দেয়নি । এই নাটকে যিনি আমার মা হয়েছিলেন , তার সঙ্গে আমার সামান্য সখ্যতা হয়েছিল । মনে আছে মা আমাকে কোন কারণে বকাবকি করলে আমি বলতাম , ওই মায়ের কাছে চলে যাব । মা হাসতো আর বলতো, 'সে কি আর তোকে দেখবে, সেতো অভিনয়ের জন্য বাইরে বাইরে ঘুরবে ।' তখন আমি চুপ করে যেতাম ।
নাটক নিয়ে আর একটা কথা না বললেই নয় তা হল , মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর হলে বাবা সিরাজদৌল্লা নাটকে সিরাজের অভিনয় করছে , আমি মায়ের কোলে বসে দেখছি ।শেষ দৃশ্যে যখন মহম্মদী বেগ ধারী অভিনেতা সিরাজ রূপি বাবাকে মিথ্যে মিথ্যে হত্যা করলো তখন আমি তাকে সত্যি ভেবে চিল চিৎকার করে উঠেছিলাম 'আমার বাবাকে মেরে ফেললো গো '। সে কি চিৎকার! অডিটোরিয়ামের বাইরে নিয়ে গিয়েও আমায় থামানো যাচ্ছে না । শেষমেশ আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হল আর বাবাকে জ্যান্ত দেখে তবে শান্তি! এভাবেই কাটতো আমার নাটক যাত্রা সিনেমা গান নিয়ে । বাবা মা- র সঙ্গে কত সিনেমা দেখেছি, তার ভেতরে মনে আছে উত্তমকুমারের ' শিউলি বাড়ি 'আর ' রাজদ্রোহী' সিনেমার প্রথম সিন । বাকি সময় মায়ের কোলে ঘুমিয়েছিলাম ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন