যাত্রা
নব জিৎ চেলেং
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস
আজ মা কে বড় মনে পড়ছে।
আমার জন্মদাত্রী মাকে। যে মা একদিন নিজের শরীরে খালি করে দিয়েছিল একটুখানি কোমল জায়গা। যার পেটের সুকোমল জরায়ু ভেঙ্গে ভেঙ্গে একদিন আমি জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। যে মা টক খেলে গর্ভের ভেতরে আমি টক এর স্বাদ অনুভব করেছিলাম।
যে মা আমার জন্য… কী করেনি। সমস্ত দুঃখ জীর্ণ করে আমাকে সূর্যের আলো দেখিয়েছিল। তারপরে স্তনামৃত,জল,আগুন, আহার… আরও কত কী!
যে মায়ের তর্জনী আঙ্গুলে ধরে আমি আমার জীবনের প্রথম পদক্ষেপ দিয়েছিলাম। সম্পর্কের অভিধান থেকে উচ্চারিত হয়েছিল, পৃথিবীর প্রথমটি শব্দ- মা। তারপর বা…বা…। তুলে নিয়েছিলাম আরও অনেক শব্দ খুঁজে হাতে শ্লেট এবং বই।
আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। কীসের জন্য একটা অভাব।
আমাকে সন্তুষ্টি দান করার জন্য পুনরায় একবার মা নিজের জীবনটাকে নিয়ে বাজি ধরেছিল। যুদ্ধ এবং জীবন- একই মুদ্রার যেন দুটি পিঠ মা। আর জয় হয়েছিল মায়ের যন্ত্রণার একমাত্র উপহার।
মা একবার পুনরায় জননী হয়েছিল। আমি আরও একটি নতুন শব্দকে বুকে জায়গা দিয়েছিলাম- ভাই। ধীরে ধীরে আমার তদারকি করা মায়ের পরিবর্তন হয়েছিল। ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি কিছু নতুন পদক্ষেপের আখড়া করেছিলাম। কঠিন ছিল কিন্তু প্রতিটি কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপেই আত্মিক ছিল।
ধীরে ধীরে তার মুখ থেকে খসে পড়া মুক্তার মতো একটি শব্দ আমার জীবন অভিধানে বাড়িয়ে দিয়েছিল শব্দের সংখ্যা- দিদি।
হাতে হাত ধরে আমরা দুজনেই গ্রামের অন্যপ্রান্তের আনুষ্ঠানিক পাঠশালায় গিয়েছিলাম। তার পিঠে ঝুলে থাকা বইয়ের ব্যাগটা যেন সে বহন করতে পারছিল না। নিজের পিঠের বোঝাকে গুরুত্ব না দিয়ে আমি হাতে তুলে নিয়েছিলাম তার বোঝা।
ধীরে ধীরে আমরা অন্য একটি অনানুষ্ঠানিক পাঠশালার ছাত্র হয়ে পড়েছিলাম। যেখানে অ-আ-ক-খ এর পাঠ ছিল না।ছিল আবেগ-অনুভূতি,হাসি-কান্না,আত্মীয়-স্বজনের কথা।
একদিনের কথা-
ভাইয়ের পায়ের নিচে রক্তের নদী। কুল কুড়োতে গিয়ে কাঁচের দ্বারা ছিন্নভিন্ন পায়ের তলা।
ইস! বড় অসহ্যকর একটা যন্ত্রণা আমার দেহেও ক্ষণিকের জন্য বাসা বেঁধেছিল।
কী নাম সেই পীড়ার! সেই পীড়ার অর্থের খোঁজে আমি পুনরায় একবার শাব্দিক অভিধান খুলেছিলাম।
আত্মজ- পৃথিবীর আকুল শব্দগুলির ভেতরের অন্যতম শব্দ।
রক্তে রক্তে, শিরায় ধমনীতে বিস্তারিত এক নাম। এক সুকোমল গভীর সম্পর্ক।
হয়তো সেই জন্যই আমি অভিমান করলে সে বীরদর্পে খুলে দিতে পেরেছিল আমার বাঁধা চুল। সেই জন্যই হয়তো আমি তাকে অকথ্য ভাষায় শাসন করতে পেরেছিলাম। পেরেছিলাম পুনরায় বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। হয়তো সেই জন্যই সে দুহাত মেলে দিতে পেরেছিল ভালোবাসার যন্ত্রণা।
… আর একদিন মাঝরাতে সেই দুটি হাতেই কোলার খৈ হাতে তুলে ঘিয়ের আগুনে ঢেলে কর্তব্যের দায়ে আমাকে বিদায় দিয়েছিল। এয়োতিরা গাইছিল-‘আখৈ আখৈ দিয়া আদরের ভাই…’
পরেরটুকু আজ এত বছর পরে মনে পড়লেও উষ্ণ চোখের জলে দুই চোখ ঘোলা হয়ে পড়ে।
আশ্চর্য এই যন্ত্রণাযুক্ত ভালোবাসা!
যন্ত্রণা। অথচ সেই যন্ত্রণার খোঁজেই আজ আমি বসে আছি। ভাই আসবে।মা ভাইয়ের হাতে পাঠাবে কিছু ভাজা চাল অথবা সন্দেশ এবং বাগানের কয়েক ধরনের শাক-পাতা। আমাকে বিয়ে দিয়ে বের করে দেবার পরে বাৎসরিক বিহুতে সে ওভাবেই এসেছিল। তাকে আদর করে ঘরে পাতা দই খাইয়েছিলাম। তার প্রিয় খাদ্য মাষ কলাইর খার এবং আলু ভাজা।
সে চলে গিয়েছিল। তাকে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী দুই একটি জিনিস দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। তার ফেরার পথে ছড়িয়েছিল আমার যন্ত্রণার ধূলি। আমি আলগোছে সেই যন্ত্রণা বুকে বেঁধে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমার ব্যক্তিগত সংসারে।
একদিন আমি মা হয়েছিলাম।
সে মামা হয়েছিল।
আবার এক নতুন শব্দ। নতুন আবেগ,নতুন সম্পর্ক। ভাগ্নীর নাম সেই রেখেছিল-কুঁহি। সত্যিই যেন এই কচি পাতা আমাদের উত্তর প্রজন্মের,যে আমাদের যুগে যুগে বয়ে নিয়ে বেড়াবে।
কুঁহি হয়ে উঠেছিল মামা ভক্ত ভাগ্নী।
আর তার মামা?কুঁহিকে পেয়ে সে ভুলে গিয়েছিল তার একজন দিদি রয়েছে। যার জন্য সে কুঁহিকে পেয়েছে। কখনও অভিমানে আমার মুখ ভার হয়ে উঠে। অথচ সে আমার চুলের ঝুঁটি খুলে দেয়নি।
সেই দিনগুলিতে সে তার পত্নীর ঘন চুলের অন্ধকারে স্বপ্নবিভোর হয়ে নতুন জীবন আরম্ভ করেছিল।
মাঝখানে সে মাকে আমার কাছে কিছুদিনের জন্য রেখে গিয়েছিল।
মা বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল।
আমি সুযোগ বুঝে মাকে রেখে এসেছিলাম। মাত্র দুদিনের জন্য গিয়ে আমার চার দিন পার হয়ে গিয়েছিল। আমি ফিরে আসার জন্য ছটফট করছিলাম। কুঁহিকে নিয়ে আমি বাড়িতে চলে এসেছিলাম। আর আমার সেই আপন ঘরটা?
পেছনে চাল ছিটিয়ে কখন যে সেই ঘর ছেড়ে ছলে এসেছিলাম,যেখান থেকে আমি আরম্ভ করে ছিলাম জীবনের যাত্রা।
কুঁহি যৌবনে পা রাখার পরে মায়ের সঞ্চিত মুগা রিহাটা তাকে দিয়ে দিয়েছিল। আর ডুগডুগিটা ভাইটির সম্ভাব্য সন্তানের জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আমার ছেলে গুদু কোনো কিছু না পেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছিল।
ভাইয়ের প্রথম সন্তানটি ছেলে যদিও শেষ মেয়ে সন্তানটি মায়ের সঞ্চিত সম্পত্তির সম্মান রক্ষা করেছিল। সোনা এবং গুণকে পেয়ে মায়ের কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। কখনও অনেক চেষ্টা চ্রিত্র করে মা আমার বাড়িতে আসত। যাবার বেলা প্রত্যেকবারই বলে যেত - এইবার একেবারে কুঁহির বিয়েতে আসব। কুঁহির বিয়ে ঠিক হল। ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। গুদু বিয়েতে ভিডিও ক্যাসেট করল। সকলের মুখে হাসি ছিল।
সবাই ছিল ভিডিও রোলে। ছিল না কেবল মা। বইয়ের এক বছর আগে মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। কাঠ কয়লা এবং ছাইয়ে পরিণত হয়েছিল একটি জীবন। একটি জীবন যাত্রা। আমার বুক শূন্য করে কুঁহি চলে গেল। কথাটা যখনই ভাবি আমার বুকটা কেমন যেন ভেঙে পড়ে। আমি আমার পেটে হাত দিয়ে দেখি। নেই, নেই সেখানে কুঁহি নেই। আছে মাত্র বয়সের অবদান মেদ। কুঁহির বিয়ের পরে এটাই তার প্রথম বিহু। বিহুর দিন শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আসতে পারবে না বলে আমি গুদুকে কিছুক্ষণ আগে তার বাড়িতে পাঠিয়েছি। কয়েকটি মালপোয়া এবং পিঠে দিয়ে পাঠিয়েছি।
সে বেরিয়ে যাবার পর থেকেই ছটফট করছি। এতটা একাত্মতা সহ্য হয় না।
পথের দিকে বারবার তাকাচ্ছি। কে জানে হয়তো বাড়ির সামনের শোভাবর্ধন করে সেই বিশেষ গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে,যে গাড়িটা ভাই বিহু উপলক্ষে কিনেছে।
একবার ভেতরে একবার বাইরে । মাঝে মধ্যে কিছুটা প্রস্তুতি। ওরা এলে কী খাওয়াব।
ওরা কী আনবে। সন্দেশ, ভাজা পিঠে… ইস! বুকটা হুলে বেঁধার মতো বিঁধে।
মা!
বাইরে পেঁ পেঁ একটা শব্দ শুনে আমি দৌড়ে এলাম। ওরা গাড়ি নিয়ে এসে গেছে বোধ হয়।
ইস!
দরজার সামনে হোঁচট খেয়ে আমার একটা নখ উড়ে গেল। তবুও আমি বাইরে গেলাম। না, কাউকে দেখছি না। বিষন্ন মনে ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতেই পুনরায় শুনলাম সেই পেঁ পেঁ শব্দ। ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রতিবেশীর উঠোনে একটি ছোট ছেলে তার পেঁপা বাজিয়ে তার দিদিকে নাচাচ্ছে। মেয়েটিও নেচে চলেছে।
সত্যহীন যন্ত্রনায় আমার বুকটা ব্যথা করে উঠল। কিছুক্ষণ বিছানায় না শুলে সেই ব্যথার উপশম হবে না।চোখের জলে বালিশের ওয়াড় না ভেজা পর্যন্ত মুক্তি নেই। আমি দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলাম।
আমার ফেরার পথে হোঁচট খেয়ে রক্তাক্ত নখের রক্তের ফোঁটা কিছু ছাপ রেখে গেল।
ইস!
ফিরে না তাকালে আমি সেই রক্তের দাগ দেখতে পেতাম না। কিন্তু আমি তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষের থেকে ভিন্ন নয়। আসলে ফিরে তাকালে যাত্রার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় যাত্রার আসল স্বাদ।
লেখক পরিচিতি-১৯৮২ সনে অসমের লক্ষ্ণীমপুরে গল্পকার নবজিৎ চেলেং এর জন্ম হয়। লেখকের দুটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।‘এজোপা গছর আত্মকথা’২০১২ সনে এবং ‘নন ডিজিটেল গল্পবোর’২০১৯ সনে প্রকাশিত হয়। অসমের প্রতিষ্ঠিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রকাশ’,এবং ‘সাতসরী’তে নিয়মিত গল্প লিখে থাকেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন