সৌমিত্র রায় -এর জন্য গদ্য
প্রভাত চৌধুরী
২১৮.
আমরা একটা নতুন ভাষা যুক্ত করেছিলাম বাংলা কবিতায়। নতুন লেখনশৈলী। যা নতুন কবিদের আকর্ষিত করেছিল । আর একটা কথা আমি দীর্ঘ-দিন ধরে বলে আসছি। কথাটি আমার নিজের নয়। অগ্রজ কবি বিনয় মজুমদার -এর কথা। বিনয়দাই প্রথম বলেছিলেন কথাটা। কথাটি হল :
একটা শতাব্দীতে পাঁচ জনের বেশি কবি হয় না।
আমিও হিসেব করে দেখেছি । বিনয়দা একদল নবীন কবিকে উনবিংশ শতকের পাঁচজন কবির নাম জিগ্যেস করেছিলেন। নবীন দলের একজনও উনবিংশ শতকের পাঁচজন কবির নাম বলতে পারেনি। বিনয়দা তারপর বলেছিলেন : আজ থেকে একশো বছর পর যখন তোমাদের বয়সের সেই সময়ের নবীন কবিদলকে বিংশ শতকের পাঁচজন কবির নাম জিগ্যেস করা হবে তখন তারাও পাঁচজনের নাম বলতে দশ মিনিট ভাববে।এই কথা বলে বিনয়দা তাঁর নিজস্ব অট্টহাসি হেসেছিলেন ।তারপর আমিও অনেক তরুণতমদের কাছে উনবিংশ শতকের পাঁচজন কবির নাম বলতে চেয়েছিলাম। তাদের একজনও পাঁচজনের নাম বলতে পারেনি। অনেকে আবার উনবিংশ শতকের কবি হিসেবে সাম্প্রতিক জনপ্রিয় কবিদের নাম বলেছেন । তারা যে কবিতার লোক নয় , এটা বলার জন্য দুবার ভাবতে যাবো কেন !
আবার গত বেশ কয়েক বছর বইমেলার স্টলে বই বিক্রি করার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি বহু ক্রেতা আমাদের স্টলে এসে জনপ্রিয় এক কবির কবিতার বই দেখাতে বলেছেন। আমি বই-এর নাম জানতে চেয়েছি। একজনও একটি বই-এর নাম বলতে পারেনি !
বাস্তব চিত্রটা এতটাই ভয়ংকর। ভয়াবহ।
আমি এই পরিস্থিতিতে খুব জোরের সঙ্গে বলি : একটা শতাব্দীতে মোট পাঁচজন কবি হবে।
এজন্য অনেকে আমার সঙ্গ ত্যাগ করেন যেমন , আবার কয়েকজন চেষ্টা করেন পাঁচজন হবার। আমি ইতিহাসের কথা , উত্তর-ইতিহাস দেখতে পাই।
এবার বিষয়ান্তরে যাই । কবিতা সম্পর্কিত কিছু আদিকথা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই আমন্ত্রণ করি : ' কল্পনালতা ' শব্দটিকে। অর্থাৎ ' কবিতা কল্পনালতা ' এই শব্দবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে জানাতে চাই : প্রত্যেক কবির নিজস্ব একটি করে লতা আছে , কল্পনার লতা।
হুইটম্যানের লতাটি যেমন খোলামেলাবাতাসের খবর দ্যায় , রবীন্দ্রনাথের লতাটি পৌঁছে দ্যায় ঝরনাতলার নির্জনে।
শুধুমাত্র এই একটি মাত্র বাক্য -কে নিয়ে একটা
PHD পেপার তৈরি করা যায়। কিন্তু আমার তো PHD করার কথা নয়। কী কাজে লাগবে এই PHD !
আমার কাজ নতুন কবিদের পথ দ্যাখানো। দেখতে যারা আগ্রহী কেবলমাত্র তাদের জন্যই এইসব লেখা।আমি মনে করি এক একজন কবির পারিপাশ্বিকতা থেকেই তাঁর কল্পনালতাটি বেড়ে ওঠে। পরিমণ্ডল একটি জরুরি শব্দ।
যেমন ধরুন আমার শৈশবের একটা অংশ বাঁকুড়ার জঙ্গলের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে। কাজেই আমার কল্পনালতাটি থেকে মাঝেমধ্যে মাদলের বোল শোনা যাবে। আবার যিনি নদীতীরে বেড়ে উঠেছেন তাঁর লতায় বেজে উঠবে ভাটিয়ালি।
এটা হল শ্রবণপর্ব ।এখন দ্যাখা প্রসঙ্গ এলে বলতে হবে আমার কল্পনালতা দেখাতে চাইবে একটা হরীতকীগাছ এবং মহুয়া-র গন্ধ।আর নদীতীর দ্যাখাতে চাইবে স্রোতের বিপরীতে মাছেদের সাঁতার।
বিশ্বসাহিত্য বা বিশ্বকবিতায় এমন নজিরও দেখতে পাওয়া যায় , দুজনের কল্পনালতা-র গতিপথ একই রকম। এই পরজীবী কবিরা বেশ শক্তিশালী । যেমন একটা পাম জাতীয় গাছকে আশ্রয় করে যে মানিপ্লান্টটি বেড়ে ওঠে সেটি বাড়ির টবে পালিত মানিপ্লান্ট থেকে অনেকগুণ শক্তিশালী মনে হয়। এখানেই পরজীবীদের নামে জয়ধ্বনি অনেক বেশি শোনা যায়।
এসব আমাদের জানাকথা , শোনাকথা। এতে আমি বিব্রত হই না। এই পরজীবীরা ততদিন জীবিত থাকবে যতদিন ওই পামগাছটি টিকে থাকবে।
অথবা যখন অনেকেই জেনে যাবেন পরজীবীর প্রকৃত পরিচয়। আমরা কি ততদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবো ?
না। আমরা আমাদের নিজস্ব লেখা চালিয়ে যাবো।
' নিজস্ব' মূল্যবান বিশেষ্যটির প্রতি মুগ্ধ থাকবো।কারণ আমাদেরমূল্যবান অজানা নয় ' নিজ 'থেকেই নিজস্ব ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন