মিথ্যা কথা
সৈয়দ আব্দুল মালিক
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ –বাসুদেব দাস
আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল সাড়ে চার মাইল।
হেঁটে আসা যাওয়া করি।আমাদের গ্রামের-আমাদের শ্রেণির ছেলে আমাদের
স্কুলে আমিই।অন্য ক্লাসের ছেলে আছে।আমি আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনের পথটা দিয়ে এক মাইল
গিয়ে-বড় রাস্তায় উঠি এবং অন্য ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে যাই।
ক্লাস সিক্সে পড়তাম।অভ্যাস ছাড়া আমার মতো ছোট একটি ছেলে দিনে
নয়মাইল হাঁটতে পারতাম না।তবে পড়াশোনা না করলে নয়,সাইকেল কেনার মতো পয়সা নেই,বাড়ির
আশেপাশে কোনো স্কুল নেই।
পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
ক্লাস এইটের পবন নেওগ আমাদের অঞ্চল থেকেই সাইকেলে করে স্কুলে
যায়।কখনও দেরি হতে দেখলে পবন আমাকে তার সাইকেলে তুলে নেয়।
কখনও নেয় না।
বড় রাস্তা দিয়ে পবনদের ঘরের ওদিকে তোষেশ্বর স্যার যায়।তার একটা
বহুদিনের পুরোনো শব্দ করা সাইকেল আছে।বেল না বাজালেও পুরো
সাইকেলটাই দূর থেকে বাজতে থাকে।তোষেশ্বর স্যার যে আসছে তা আমরা ঘুরে না তাকিয়েও
বুঝতে পারি এবং সঙ্গে সঙ্গে একপাশে সরে দাঁড়াই।কেবল তোষেশ্বর স্যারই নয় অন্য
শিক্ষকদের ও আমি খুব ভয় করতাম।তোষেশ্বর স্যার আমাদের ভূগোল পড়ায় এবং ইংরেজি
ট্রানশ্লেষণ করায়।ভূগোলে আমি খারাপ।এত বড় একটা পৃথিবী,তাতে এতগুলো দেশ,মহাদেশ,কত
নদী-পর্বত,নগর-সাগর মনেই থাকে না।তার মধ্যে আমার ভূগোলের জ্ঞান যোরহাট,গোলাঘাট এবং
আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল-এর মধ্যেই আবদ্ধ।আমার ম্যাপগুলো বড় দীর্ঘ হয়ে যায়।একবার
লঙ্কা দ্বীপ আঁকার সময় একেবারে তোষেশ্বর স্যারের মুখের মতো হয়েছিল।এই জিনিসটা
আবিষ্কার করে আমি উঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে হেসেছিলাম এবং বড় আমোদ এবং রহস্য বলে মনে
হয়েছিল।কোনোভাবে তোষেশ্বর স্যার যেন দেখতে না পায় সেজন্য লুকিয়ে রেখেছিলাম।
একদিন আমরা পুরো ক্লাসটা একটা বড় অপরাধ করে ফেললাম।আমাদের একটা
ম্যাপ বাড়ি থেকে এঁকে নিয়ে যেতে বলেছিল-আমরা তা পারলাম না।কয়েকজন এঁকে
এনেছিল।ওদেরকেও আনেনি বলতে বলে দিলাম।কারণ দুয়েকজন নিলে আর বাকিরা
না নিলে ,যারা নেয়নি তাদের শাস্তি বেশি হবে।মিথ্যা কথা বলারও কোনো উপায় নেই।
প্রত্যেকেই আনেনি বলল।
‘ম্যাপ এঁকে আনলি না কেন?’স্যার রাগের সঙ্গে বললেন।
আমরা চুপ।
উত্তরটা আগে থেকে ভেবে রাখা হল না।স্যার সবার মুখের দিকে একবার
রাগত চোখে তাকালেন।তারপরে গম্ভীরভাবে বললেন-‘ভালোই হয়েছে হোমটাস্ক করে আনিসনি।এক
ঘণ্টা ডিটেইন।’
আমাদের সবার শুকনো মুখ এবং শুকনো গলা আরও শুকিয়ে গেল।
‘এখন এঁকে দেব স্যার’।কে একজন দুঃসাহস করে বলল।
‘তুই বেঞ্চের উপরই দাঁড়িয়ে থাক-’একই গম্ভীর এবং কড়া সুরে স্যার বলে
উঠলেন।
আর কারও কিছু বলার সাহস হল না।তোষেশ্বর স্যারের রাগ সম্পর্কে আমরা
সবাই সচেতন।
তারপর সেদিন ভূগোল পড়িয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বললেন,‘পুরো
এক ঘণ্টা।কেউ পালাতে পারবি না।কেউ ছুটি নিয়েও যেতে পারবি
না।’
অসহায় ভাবে আমরা প্রথমে একবার স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু
করলাম।স্যারের কথার নড়চড় হয় না।
এমনিতে কখনও কোনো ছাত্রের পরের ক্লাসগুলোতে উপস্থিত থাকতে ইচ্ছা না
করলে কোনো ছাত্র পেট কামড়াচ্ছে বা মাথা ব্যথা করছে বলে ছুটি নিয়ে যায়।কিন্তু
তোষেশ্বর স্যার ডিটেইন করেছেন,ছুটি নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।
সেদিন জৈষ্ঠ্য মাসের বড় কড়া রোদ।আমাদের ক্ষুধাও পেয়েছিল,তৃষ্ণাও
পেয়েছিল।আমরা গ্লাসের পর গ্লাস জল খাচ্ছিলাম।কিন্তু পুরো ক্লাসের ছেলেরা চুপ করে
বসে রইল।কেউ নড়াচড়া করার সাহস করল না।তোষেশ্বর স্যার চেয়ারটাতে যে বসলেন,বসেই
রইলেন,নড়াচড়া করার নামগন্ধ নেই।স্যারকে এভাবে দেখে আমাদের
আরও বেশি ভয় করতে লাগল।স্কুলের অন্য ক্লাসের সমস্ত শিক্ষক এবং ছাত্ররা বাড়ি চলে
গেল।চারপাশটা বেশ নীরব নিস্তব্ধ।
আমাকে আবার পায়ে হেঁটে সাড়ে চার মাইল যেতে হবে।ছুটি দিতে বলার জন্য
কয়েকবার উশখুশ করলাম,সাহসে কুলোল না।তখনকার দিনে আজকালকার মতো মাস্টার ছাত্রদের ভয়
করত না।কারণ ছাত্ররা মাস্টারদের ঘেরাও-টেরাও করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না।
কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা হওয়ার পরে আমাদের ছুটি দিল।আমরা সুরসুর করে
স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ে দ্রুতপায়ে বাড়িমুখো হলাম,বাড়ি পৌছাতে আজ রাত হবে।
একমাইলের মতো হাঁটার পরে আমি একা হয়ে গেলাম।সঙ্গের ছেলেরা সবাই যে
যার দিকে চলে গেল।আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল।
একাই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলাম।পেছনে তোষেশ্বর স্যারের সাইকেলের ঘর্ঘর
আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম।পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি,হ্যাঁ তোষেশ্বর স্যার স্কুল থেকে
বাজার হয়ে ফিরছেন।
কিছু জিজ্ঞেস করবেন বলে ভয় হল।পথের একপাশ ধরে দ্রুত এগিয়ে যেতে
চাইলাম।
আমার কাছে এসে স্যার ধীরে ধীরে সাইকেল চালালেন এবং জিজ্ঞেস
করলেন,‘একা যে-সঙ্গে্র ছেলেরা কোথায় গেল?’
ভয়ে ভয়ে বললাম,‘ওরা চলে গেছে স্যার।’
তোষেশ্বর স্যার সাইকেল থেকে নামলেন এবং কড়া ভাবে বললেন,‘দেখি এদিকে
আয়।’
ভয়ে আমার তালু শুকিয়ে গেল।
তবু সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘উঠ,সাইকেলে উঠতে পারবি?পেছনে বসলে আমি চালাতে পারব না।এখানে আগে
বস।’-বলে আমার বগলের নিচে হাত দিয়ে সাইকেলে তুলে নিলেন এবং নিজেও সাইকেলে উঠে
চালাতে লাগলেন।আমি স্যারের দুটো হাত আর বুকের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
আমাদের গ্রামে প্রবেশ করার রাস্তাটায় এসে তিনি আমাকে বললেন,‘ওদিকে
আমার একটু কাজ আছে।চল’।
স্যার আমাকে আমার বাড়ির দরজার সামনে নামিয়ে দিলেন।কিছুই বললেন না
এবং সোজাসুজি না গিয়ে আবার যে পথে এসেছিলেন সেইপথে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন।
আমি বুঝতে পারলাম এদিকে স্যারের কাজ ছিল না।আমাকে বাড়িতে রেখে
যাবার জন্যই এতটা পথ এগিয়ে এলেন।
স্যার ও একটা মিথ্যা কথা বললেন।
--------
লেখক
পরিচিতিঃ অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের
শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন।যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে
গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ করেন।পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি
কলেজে অধ্যাপনা করেন।লেখকের গল্প সঙ্কলন গুলির মধ্যে ‘পরশমণি’,শিখরে শিখরে’,শুকনো
পাপড়ি’বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।‘অঘরী আত্মার কাহিনী’উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি
পুরস্কার লাভ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন