একজন বুড়ো মানুষ,
নিরুপমা বরগোহাঞি,
অসমীয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস,
(৬)
কিন্তু স্বল্প শিক্ষিতা ইলা বাড়িতে বসে বসে কত বই পড়ত!কীভাবে বইয়ের কথাগুলি জীবনের
সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিতে পেরেছিল।আর তারজন্যই বোধহয় তার জীবনটা ইলা এত
বর্ণাঢ্য,এত সজীব করে রাখতে পেরেছিল।
ইলার সেই বৈশিষ্ট্যের জন্যই বোধহয় একটা ঘর বাঁধার স্বপ্নে একদিন ওরা দুজনেই এত
বেশি মশগুল হয়ে থাকতে পেরেছিল।
বিয়ের চার মাস পরে ইলা একদিন বিজয়কে খুব অবাক করে দিল।
‘এই ১০০ টাকা নিন।’ অফিসে যাবার সময় বিজয়ের দিকে খুচরো ১০০ টাকা এগিয়ে দিয়ে ইলা
বলেছিল। তারচোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল- বিজয়কে অবাক করে দিতে পারার মধুর আনন্দের গোপন
হাসিতে।
‘টাকা? কিসের টাকা?’ ইলা ভাবা মতোই বিজয় অবাক হয়েছিল।
‘এতদিন যে আমার সঙ্গে একটা ঘর বাঁধার এত জল্পনা-কল্পনা করলে,মাটির না হলে সেই ঘর কোথায়
বাঁধবে? সেই জন্য এক টুকরো মাটির জন্য এই টাকাটা আমি একটু একটু করে সঞ্চয় করেছিলাম।
একবার কোথাও একটা গল্পে একটা চোরের কাহিনি পড়েছিলাম- সে কিছু একটা ভালো কাজ করে এসে
স্ত্রীকে বলেছিল যে সে সেদিন নিজের বিষয়ে একটা কথা আবিষ্কার করেছেঃ কথাটা হল যে চুরি করার মতো
জঘন্য কাজ করা একটা খারাপ মানুষ হলেও আসলে সে ততটা খারাপ নয়। আজ এই জমানো ১০০ টাকা বাক্স
থেকে বের করে সেই চোরের মতোই আমি নিজের বিষয়ে একটা অভাবনীয় সত্য আবিষ্কার করলাম,সেটা কী
জানেন?’
‘কি?’ প্রথম দিন থেকে সেদিন পর্যন্ত স্ত্রী বিজয়কে কেবল অবাকই করে এসেছে।
‘ যে আমি মানুষটা আপনি সব সময় বলার মতো বেহিসাবি অসাংসারিক হলেও কিছুটা অত্যন্ত হিসেবি-’
এইবার বিজয় হেসে ফেলেছিল। তারপর স্ত্রীর দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল –‘তোমাকে
আমি কিসের জন্য বেহিসেবি বলি তুমি তো তা জান। নিজের জন্য তুমি কিছুই নিতে চাও না। অন্য মহিলাদের
মধ্যে নিজের কাপড়চোপড় কেনার একটা আগ্রহ থাকে কিন্তু তোমার মধ্যে দেখেছি সে সবের জন্য কোনো
আগ্রহ নেই। তুমি কেবল ব্যস্ত অতিথি অভ্যাগতদের সেবা যত্ম করায়। আমার বন্ধুবান্ধবদের তুমি জোর
করে খাওয়াতে ভালোবাস। সেই টাকা বাঁচিয়ে তুমি যদি নিজের জন্য কিছু কিনতে। আমার বন্ধুদের তুমি আদর
যত্ন করলে আমি খুশি হই। বিয়ের আগে বেচারাদের এক কাপ চা খাওয়াতে পারতাম না। কিন্তু তুমি এখন ওদের
শুধু চা-ই নয়,সঙ্গে অন্য অনেক কিছু খাওয়াও বলে আমার বন্ধুর সংখ্যা এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
সেই খরচ যদি কিছু পরিমাণ কমিয়ে তুমি নিজের জন্য কিছু একটা যদি চেয়ে নিতে, আমি নিজে না দিলে কোনোদিন
কোনো জিনিস তুমি আমার কাছ থেকে চেয়ে নাও না-’
এইবার ইলা বিজয়ের কথার মধ্যে বাধা দিয়ে বলে উঠল যে –‘আপনি সবসময় এই কথাটা কেন বলেন?
আমি কিসের অভাবে আছি যে প্রয়োজন না হলেও একগাদা কাপড়চোপড় গহনা চেয়ে নেব ? আর দেখুন আপনি
নিজে মনে মনে যে কথাটা ভালোবাসেন, কেবল আমার কথা ভেবে তা খারাপ পেতে নিজেকে বাধ্য করেছেন।এতদিন
আপনার একটা বাড়ি ছিল না, যেখানে বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারেন। সত্যি-মিথ্যা এখন
আমাদের ছোট্ট একটা বাড়ি হয়েছে, সেই বাড়িতে লোকজন আসছে- আপনি তাতে মনে মনে খুশি হলেও নিজের
মনকে অস্বীকার করতে চাইছেন। আর দেখুন নিজেকে সাজানোর মতো এত সস্তা অথচ মূল্যবান জিনিস
থাকতে মিছামিছি কেন টাকা খরচ করতে যাব?
‘সস্তা অথচ মূল্যবান? কী অদ্ভুত জিনিস সেটা?’বিজয় পুনরায় অবাক হয়েছিল।
‘এই যে-’কপাল এবং সিঁথির সিঁদূরের ফোঁটার দিকে ইলা অঙ্গুলি নির্দেশ করল। পবিত্র রহস্যময়
হাসিতে মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে বিজয় ইলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ধীরে ধীরে তাঁর চোখ দু'টি মুগ্ধ আবেশে কোমল হয়ে এল। সত্যি । এই সিঁদুরের ফোঁটা ইলাকে এতটা মানায়, অন্য
কোনো মহিলাকে বোধহয় এত সুন্দর দেখায় না-অন্তত এটাই বিজয়ের ধারণা।
তবু বিজয় পুনরায় একই কথা বলল – ‘ভেবেছিলাম- ‘শাড়ি গহনা গাড়ির কামনা সমস্ত মেয়েদেরই কম
বেশি পরিমাণে থাকে কিন্তু তুমি যে কেন এর ব্যতিক্রম হলে-’ এর বেশি আর কিছু বিজয় বলতে পারল না, কিন্তু
মনে মনে ভাবল, ইলার কাপড় গয়নার প্রতি আগ্রহ নেই নাকি অন্য দিকে বেশি খরচ করে বলেই এইসব
জিনিসের নাম নিতে চায় না?’ ওদের দুটি প্রাণীর ঘরে ইলা কত মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইলা
পাড়ার কারও বৌদি, কারও দিদি, কারও মামি, কারও বা ছোট বোন হয়ে উঠেছে।ওদের ছোট্ট বাড়িটা একটি
একান্নবর্তি পরিবারের বাড়ির মতোই যেন বৃহৎ হয়ে পড়েছে। ফলে আজ কারও ছেলে জন্ম হয়েছে, সঙ্গে
সঙ্গে অফিসে যাওয়ার সময় এসে বলবে ছেলেটিকে আজ দেখতে যেতে হবে, অফিস থেকে আসার সময় যেন
বিজয় উপহার দেওয়ার জন্য এক টুকরো কাপড়,বেবি পাউডারের প্যাকেট কিনে নিয়ে আসে। আবার একদিন
হয়তো মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বিজয় বাদলকে না পাঠিয়ে নিজেই ভালো করে বাজার করে আনতে হবে কারণ
মেয়েটিকে তার স্বামীর সঙ্গে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হবে। কখনও আবার ইলার পাতানো কোনো মাসি
অসুস্থ হয়ে পড়বে তখনও বিজয়কে বাজার থেকে ফলমূল কিনে এনে দিতে হবে। শুধু হাতে কখনও ইলা রোগীর
খবর নিতে যায় না। আর যদি কারও বিয়ে অন্নপ্রাশন বা জন্মদিনের নিমন্ত্রণ থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
সবচেয়ে ভালো উপহারটা দিতে হবে। সঙ্গে কৈফিয়ত হিসাবে বিজয়কে বলবে- বিয়ে বা অন্নপ্রাশন এসব তো আর
প্রতিদিনের ঘটনা নয়, তাই কৃপণতা করে সাধারণ জিনিস কিনে দেওয়া উচিত নয়। সঙ্গে বাবা বলা কথাটা বলবে-‘
মানুষ তো কখনও ধনে বড় হয় না, মনে প্রকৃত বড় হয়।’
এই সমস্ত কিছুই নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে দেখছে বিজয়। ইলার কোনো ইচ্ছাতে কোনো দিন সে
বাধানিষেধ আরোপ করেনি। বরং এসবের মধ্যে একটি বড় সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছে। সে যে বাড়ির লোকজনের কাছ
থেকে ইলাকে বঞ্চিত করে রেখেছে, সেই বাড়ির অনাস্বাদিত আত্মীয়তার ভালোবাসা এরকম কিছু কৃত্রিম
সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে ইলা যেন পেতে এবং দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু তবুও মাঝে মধ্যে বিজয় না ভেবে পারেনা
যে এতগুলি পাতানো মানুষকে ভালোবাসা বিলিয়ে ইলা যেন নিজের সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন হয়ে রয়েছেন।
অবশ্য একটা কথায় ইলা খুব সচেতন। বিজয়ের সমস্ত ধরনের সুখ-সুবিধার প্রতি তার সব সময়ই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
এতগুলি নকল দেবর, ননদ, ভাই-বোন, মাসি-পিসির প্রতি কর্তব্য করতে গিয়েও সে কখনও বিজয়কে দেখাশোনা
করার ক্ষেত্রে কোনোরকম ত্রুটি হতে দেয়নি। বাদল থাকলেও ইলা বেশিরভাগ দিন নিজের হাতে চা করে ভাত
রেঁধে বিজয় কে খাওয়ায়। বাড়িতে বোধহয় ইলা কোনোদিন রান্নাবান্না করোনি। মা বাবার একমাত্র মেয়ে তাই
হয়তো কোনো কাজ করতে দেয়নি। তাই ইলার রান্নায় পটুতা একেবারে ছিল না। এমনকি বাদলও ইলার চেয়ে বেশি
ভালো করে রান্না করত। কিন্তু ইলার নিজেই রান্না বান্না করে খাওয়ানোয় উৎসাহ দেখে একদিনও সে খাবার
সময় রান্না খারাপ হয়েছে বলেনি। খাবার সময় ইলা সামনে বসে দেখাশোনা করে।তার মুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে
উঠতে দেখে সে কোনোদিন রান্নার ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে পারেনি। সেই অভ্যাসটা সব সময়ের জন্য থেকে গেল।
কোনোদিন সে কারও রান্না নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেনি।
কিন্তু এতগুলি টাকা কীভাবে ইলা সঞ্চয় করতে পারল?
‘আমার কিন্তু খুব অবাক লাগছে এতগুলি টাকা তুমি এই কয়েকদিনের মধ্যে কীভাবে জমাতে পারলে
ইলা?’
একটা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল ইলা। ‘আপনি আমার বিষয়ে যে একটা ভুল ধারণা নিয়ে এতদিন
রয়েছেন সেটা বুঝতে পারলেন? কাপড় বা গাড়ির প্রতি আগ্রহ আমারও রয়েছে। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড়
আগ্রহ হল নিজের একটা বাড়ির প্রতি। দিনের মধ্যে কতবার যে আমি নিজের একটা বাড়ির কল্পনা করি, বিশেষ
করে শাকসব্জি এবং ফুল গাছ দেখাশোনা করার সময় সেই কল্পনা খুব বেশি ভাবে করি। আমাদের বাড়ির বাগানে
আমরা কী কী ফুল লাগাব, বাগানের পেছনে কী কী ফলের গাছ লাগাব এই সমস্ত নানাকথা। তাছাড়া আমরা থাকা
বাড়িতে অসুবিধা গুলির জন্যও আমাদের নিজের বাড়ির কথা মনে ভাবতে ভালো লাগে। নিজে বাড়ি তৈরি করলে
সমস্ত সুবিধা দেখে শুনে নিতে হবে।’
ইলার কথা শোনার মতো বিজয়ের সময় ছিল না। অফিসের সময় প্রায় পার হয়ে যাচ্ছিল,তাই দ্রুত ইলার
হাত থেকে ১০০ টাকা নিয়ে সে অফিসের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলল।
পথে বেরিয়ে বিজয় নিজেকে একা পেল। তখন ইলার জমানো টাকার কথা ভাবার মতো অবকাশ পেল। ভেবে
ভেবে ইলার প্রতি তার ভালোবাসা এবং সহানুভূতিতে মনটা কোমল হয়ে এল। বাড়ি একটার প্রতি এতটা আকুলতা
থাকা মেয়েটি নিজের বাড়ি থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। জীবনের কোনো একটি পরিহাস যেন এর মধ্যে মধ্যে নিহিত
রয়েছে। দুই হাতে টাকা পয়সা খরচ করার অভ্যাস থাকা মেয়েটির এই একশো টাকা জমানোর মূলে একটা বাড়ির
প্রতি থাকা উদগ্র বাসনার পরিচয় পেয়ে বিজয় অভিভূত হয়ে গেল। পকেটে থাকা একশো টাকার উপরে সে
একবার আদর করে হাত বুলালো। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের আবেগের প্রকাশে নিজের মুখে মুচকি হাসি খেলে
গেল।
ছয় মাসে একশো টাকা জমানোর পর ইলা কিন্তু এক বছরে আশি টাকার বেশি জমাতে পারল না। কারণ
ইতিমধ্যে ওদের মধ্যে পোনা এসেছে। সেই জন্য বেশ ভালো পরিমাণ টাকা খরচ হয়ে গেল। সেই টাকা খরচ হল শুধু
মাত্র পোনাকে এই পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য নয়,তার জন্মের সময় তার মায়ের জীবনের আলো চিরদিনের
জন্য ঘুচে যাচ্ছিল।বিজয় প্রায় পাগলের মতো দুই হাতে টাকা-পয়সা ছড়িয়ে ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়ে সেবার
ইলাকে বাঁচিয়ে তুলল। মাটির জন্য জমানো টাকা থেকে কিছু খরচ হয়ে গেল। ভালো হয়ে উঠার পরেই ইলা যেদিন
জানতে পারল যে তার এত কষ্ট করে মাটির জন্য সঞ্চিত করে রাখা টাকায় হাত পড়েছে, তার চোখ ছলছল হয়ে
এল। জমানো টাকা কোথায় বাড়বে এতো দেখছি কমে গেল। ইলার দুঃখ দেখে বিজয়ের নিজেকে অপরাধী বলে মনে
হচ্ছিল। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে ইলাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিল-‘মাটির জমানো টাকা খরচ করার জন্য
তোমার দুঃখ হচ্ছে, কিন্তু আমার সেই সময়ের অবস্থা ভেবে দেখতো,পোনার জন্মের সময় খরচ করার জন্য
সঞ্চিত টাকাগুলো খরচ হয়ে গেল। দুই একজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করলাম। তোমার বাবা
নানা জিনিসপত্র পাঠিয়ে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করলেন। পোনাকেও সোনার হার দিলেন। আমি তো কখনও
তোমার বাবার কাছে এত পাওয়ার পরে আবার টাকার কথা বলতে পারতাম না। এমনকি তিনি নিজেই আমাকে
জিজ্ঞেস করেছিলেন টাকা পয়সার দরকার হবে কিনা বলে। আমি সত্যি কথাই বলেছিলাম যে লাগবেনা, তোমার
জমানো কিছু টাকা আছে। তারপর বিজয় রসিকতা করার চেষ্টা করে বলল-‘বাড়ি ঘর দিয়ে কী হবে ইলা যদি সেই
ঘরের ঘরনী আমাকে ছেড়ে চলে যেত?’
কথাগুলি বলেই কিন্তু বিজয় সেদিন অনুতাপ করেছিল। মাঝে মধ্যে তার মুখে কী সব অশালীন রসিকতা
চলে আসে? ইলার মৃত্যুকে নিয়ে পর্যন্ত রসিকতা করতে পারল সে। অথচ এই মৃত্যুর ছায়া দেখে সে এবং ইলা
পোনার জন্মের আগের কয়েকটি দিন কত রাত দুশ্চিন্তার মধ্যে ঘুমের ক্ষতি করে কি সাংঘাতিক ভাবেই না
সময় কাটিয়ে ছিল। অন্য অনেক দম্পতির মতো তাদেরকে অনাগত শিশু ছেলে হবে না মেয়ে হবে, ছেলে হলে কী
নাম রাখবে মেয়ে হলে কী নাম রাখবে এই সব জল্পনা-কল্পনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয়েছিল
কারণ ওদের মধ্যে পোনা আসবে বলে জানতে পারার দিন থেকে ইলা নানা অসুখে ভুগতে শুরু করেছিল। সবার চেয়ে
বড় যে কথাটা ডাক্তার এবং নিজেদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল তা হল ইলার ক্রমশ বেড়ে চলা রক্তশূন্যতা। অনেক
ওষুধপত্র খাইয়ে শেষ পর্যন্ত ইলাকে বাঁচানো গিয়েছিল। মা ইলাকে নিজের সঙ্গে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু ইলা
রাজি হয়নি। সেই অসম্মতি প্রকাশ করে সে মায়ের কাছে মনে মনে লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু বিজয়ের কথা ভেবেই
বাপের বাড়িতে যেতে রাজি হয়নি। সে দূরে থাকলে প্রতিটি রাত বিজয় কতটা অস্থির হয়ে উঠবে এই ভয়ঙ্কর
সত্যটা সে জানত। তাই মায়ের কাছে থাকলে তার অনেক সুবিধা হবে জেনেও সে যায়নি। এমনকি বিজয়ও জোর
করেছিল মায়ের কাছে রেখে আসার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইলা নিজের মতে অচল অটল হয়ে রইল।শেষ
পর্যন্ত পোনার জন্মের কিছুদিন আগে থেকে মা এসে তাদের সঙ্গে থাকতে লাগল।
মৃত্যুর সঙ্গে বিজয়ের তখনও পর্যন্ত কোনো পরিচয় ছিল না। সে যখন খুবই ছোট তখন তার এক
দিদির মৃত্যু হয়েছিল। সে কথা তার মনে পড়ে না। তারপরে তাদের বাড়িতে কারও মৃত্যু হয়নি। এদিকে কিছুটা বড়
হওয়ার পরে তার স্বভাব অনুসারে বইপত্রের মধ্যে ডুবে থেকে এরকম একটি জগত গড়ে তুলল যে তখনকার
গ্রামের সমাজের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ রইল না। গ্রামের সামাজিক কোনো কাজে সে কোনোদিন যোগ
দেয়নি। তার স্বভাব কে স্বীকার করে নিয়ে গ্রামের কোনো মানুষ তাকে কোনো কাজে ডাকত না। সেজন্য গ্রামে
কেউ মারা গেলে শ্মশানে নিয়ে যাবার জন্য তাকে কেউ কোনোদিন অনুরোধ করেনি। সেই সব কাজে সবসময় তার
দাদারাই অংশগ্রহণ করত।এভাবেই সে স্কুলের জীবনটা পার করে দিল। কলেজ জীবনে তাকে কোনোদিন কোনো
বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় পরিজনের মৃত্যুর খবর শোনার মত দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হতে হয় নি। মৃত্যুর সঙ্গে
তার পরিচয় একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে। কিন্তু সেই পরিচয় ছিল ভাসা ভাসা। বহু চিন্তাশীল মানুষের চিন্তা রাজ্যে
মৃত্যু একটি বিশেষ স্থান জুড়ে থাকে। জীবনের সঙ্গে একটা এড়াতে না পারার সঙ্গী হয়ে বাস করে সেই
মৃত্যুচেতনা। কিন্তু বিজয় অন্য অনেক মানুষের চেয়ে গভীর চিন্তার মানুষ হলেও মৃত্যুকে নিয়ে কোনোদিন বিশেষ
কিছু ভাবনা চিন্তা করেনি। জীবনে প্রথমবারের জন্য ইলাই তাকে মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন করে তুলল। পোনার
জন্মের আগের দিনগুলিতে ইলা তাকে প্রায়ই বলত যে সে আর বেশি দিন বেঁচে থাকবে না। সংসারের মায়ার বন্ধন
দৃঢ় করতে গিয়ে সে মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে চলেছে। সত্যি ইলা অনেক অসুখে ভুগল। কত রাত যে সে ছটফট
করে উজাগরে কাটিয়েছে। প্রথমদিকে গরমের দিন ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে গরম পড়ে এল। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে
ইলার ঘুম ও কমে এসেছিল।ছটফটানি বেড়ে গিয়েছিল। সেই সমস্ত রাতে ইলা কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শেষে
সামনের বারান্দায় কিছুটা শান্তির আশায় বেরিয়ে যেত। ইলার সঙ্গে বিজয়েরও ঘুম আসছিল না। ইলার ঘোর
প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেও সামনের বারান্দায় বেরিয়ে যেত হাতপাখা নিয়ে। দুটো বেতের চেয়ারে দুজনে অনেক সময়
বসে থাকত। কখনও নীরবে কখনও দুই একটা কথা বলত। নীরব মুহূর্তগুলি কিন্তু বিজয়ের কাছে শান্ত ছিল না।
ইলার জন্যও নিশ্চয়। ওদের সামনে বিশাল অন্ধকারে,আকাশের বিনিদ্র অগণন তারা, চারপাশের সুপ্তির নিবিড়-
নিস্তব্ধতা, তার মাঝে মধ্যে হঠাৎ যেন কোনো নামহীন অজানা দেশ থেকে বয়ে আসা একঝাঁক হালকা বাতাস
ওদের মনে এক অপার্থিব বিষ্ময় এবং ভয়ে গা শিরশির করে উঠা অনুভূতি মন গুলিকে ভাব গম্ভীর স্তব্ধতায়
ভরে ফেলত। সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে মাঝেমধ্যে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যেত এবং অন্ধকারে রহস্যময়
ছায়ামূর্তির মতো মনে হওয়া ইলার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের প্রাণ আকুলি বিকুলি করে উঠল- ইলা যেন ইতিমধ্যেই
জগত ছেড়ে গিয়ে কায়াহীন মূর্তি ধরে তার কাছে বসে আছে। তীব্র মৃত্যুচেতনায় যেন বিজয়ের সমস্ত সত্তা
কেঁপে উঠেছিল। সামনের স্তব্ধ আকাশের অগনন তারার দিকে তাকিয়ে তার মনে রবি ঠাকুরের কবিতার পংক্তি
বারবার যাওয়া-আসা করছিল-‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে/ আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে-’ আর তারপরেই
খুব ভয় পেয়ে সে ইলার হাতদুটি নিজের মুঠিতে ঢুকিয়ে নিয়ে তার এতক্ষণের ভয়াবহ অনুভূতির অসত্যতার
উপলব্ধিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খুব আদর করে ইলাকে জিজ্ঞেস করেছিল-‘কী ভাবছ ইলা?’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন