নস্টালজিয়া ২৬
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
'তুমি পারবে না ' এই কথাটা ছোটদের কখনই বলতে নেই। বিশেষ করে মা যদি শিশুকে বারবার বলতে থাকে 'তুমি পারবে না' শিশুর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মে যায় যে মা যখন বলছে তখন আমি পারব না। যত কঠিন কিছু হোক শিশুটিকে যদি বারবার উৎসাহিত করা হয় 'তুমি পারবে' তাহলে অনেক সাহস আর মনোবল খুঁজে পায় সে, জীবনের কঠিন বাধা অনায়াসে অতিক্রম করতে শেখে। এই 'আমি পারি'(I can) মন্ত্রে শৈশব ও কৈশোর থেকেই শিশু কিশোরদের দীক্ষিত করে তুলতে হয় এই অভিজ্ঞতা আমার ব্যক্তিগত জীবন সঞ্জাত।
খুব শান্ত আর ভিতু ছিলাম ছোটবেলা থেকেই। শান্ত শিষ্ট আমার স্বভাব, কিন্তু অহেতুক ভয়টা মা নিজের অজান্তেই আমার মনের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিল এটা আমি বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি । আমার আগে ও পরে যে দুটি সন্তান মায়ের জন্মেছিল তাদের শৈশবই মৃত্যু হয়েছিল। একটির জন্মের পরেই আর একজনের তিনমাসে পক্স হয়ে। আমিও প্রি ম্যাচিওর বেবিছিলাম, আট মাসের শুরুতেই জন্মেছিলাম। সময়ের আগেই এত শান্ত মেয়েটি কীভাবে যে ছটফট করে পৃথিবীর আলো দেখতে বেড়িয়ে এসেছিল জানি না। অনেক যত্নে সাধ্য সাধনা করে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল মা- বাবা। ছোটবেলায় টাইফয়েড হয়েছিল তিন বার। বারবার জ্বর হতো আর তখন ডাক্তার কিছুতেই ভাত খেতে দিত না বলে আমার খুব খারাপ লাগত। যাই হোক এইসব কারণে আমাকে মা পক্ষীমাতার মত ডানা দিয়ে আগলে বড় করে তুলেছিল। পরে অবশ্য এই আমাকেই জীবনের অজস্র ঝড় ঝামেলা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার অনেক বেশি আর আমার 'পারব না' এই গন্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে । আসলে ছোটবেলা থেকেই মায়ের মনে আমার জন্য সবসময় একটা ভয় ছিল ,যদি কিছু হয়ে যায়! খুব আলতো করে রাখতে চেষ্টা করত আমাকে সবরকম বিপদ আপদের হাত থেকে। পড়াশোনা ছাড়া কোনো কাজ আমাকে করতে দিত না মা। ফলে আমি অনেক বড় পর্যন্ত ভয়ে দেশলাই জ্বালাতেও পারতাম না। চা ছাড়া আর কোনো কিছু করতে পারতাম না বিয়ের সময়েও আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একথা জানে। যে কোনো কাজ করতে গেলেই মা বলত 'তুই পারবি না', এটা অতিমাত্রায় স্নেহের বশে বলা, কিন্তু সেটা আমার মনে গেঁথে বসেছিল। আমি সব কাজ থেকে গুটিয়ে রাখতাম নিজেকে 'পারব না' ভেবে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে কখনো "পারবে না" এই কথা মা বলত না। তবুও মায়ের অজস্র 'না' আমার জীবনে সব কাজের মধ্যেই কিছুটা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া করেছিল , আমার মনোবল নষ্ট করেছিল বড় হয়ে তা উপলব্ধি করেছি। পড়াশোনা ও জীবনের শিক্ষায় এই 'না'-এর গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছি। মাকেও বলতাম সে কথা, মাও পরে বুঝতে পেরেছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন