সবাই মিলে সিনেমা হলে ( ২১)
সিনেমা ও বিরতি
কান্তিরঞ্জন দে
নমস্কার । উৎসবকালীন বিরতির পর আবার ফিরে এলাম । আমরা যখন সবাই মিলে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাই, তখন ছবির মোটামুটি আধাআধি সময়ে পর্দায় ভেসে ওঠে-------" বিরতি "।এ আমাদের চেনা অভিজ্ঞতা।
এই সুযোগে দর্শকেরা
হাত-পা কোমরের খিল ছাড়িয়ে নেন । কেউ প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারেন । কেউ কেউ চা-কফি-ধূমপান করে নেন । অনেকেই পেট ভরানোর কাজটি করেন । আসলে বিরতি হলো সিনেমা দেখার অবিচ্ছেদ্য অংশ । টানা সিনেমা দেখা সত্যিই মুস্কিলের ব্যাপার । ষাটের দশকের বিখ্যাত হলিউডি ছবি " বেন হুর " কিংবা সত্তর দশকে রাজ কাপুর পরিচালিত " মেরা নাম জোকার " সহ আরও বেশ কিছু সিনেমায় দু তিনবার বিরতি দিতে হতো । কেন না, সেগুলো ছিল দু-ঘন্টার চেয়েও অনেক লম্বা সময় ধরে চলা সিনেমা ।
টিভি ধারাবাহিকের যুগে বিজ্ঞাপনের বিরতি একটি বহু চেনা শব্দ । এই সময়ে ঘরোয়া দর্শক বিশ্রাম নিতে পারেন, অথবা হাতের কাজ এগিয়ে রাখতে পারেন। এমনকি , টিভিতে বহুল জনপ্রিয় সিনেমা দেখানোর সময় , কখনও কখনও বিজ্ঞাপনের বিরতি এতই লম্বা হয় যে , হাতের কাজ সেরে ফেলাও সম্ভব হতে পারে । একটি ধারাবাহিকের ২৫ মিনিটের এপিসোডে বিজ্ঞাপন বিরতি আসে সাধারণত , পাঁচ মিনিট পরপর । খবরের ক্ষেত্রে সেটি ১০/১৫ মিনিট অন্তর । ক্রিকেট হলে এই বিরতি আসবে ওভার শেষের কিংবা উইকেট পতনের ঠিক পরেই । ফুটবলের ক্ষেত্রে বিরতি আবার গোল, ফাউল, অফ-সাইড যে কোনও মুহুর্তেই আসতে পারে । অর্থাৎ , সুযোগ পেলেই হলো । এই বিজ্ঞাপনের বিরতিতে দর্শক পাবেন বিশ্রাম অথবা বিরক্তি । আর প্রযোজক বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ পাবেন টাকা, অর্থাৎ , মুনাফা।
ইউ টিউব কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা দেখার সময় বিজ্ঞাপন-বিরতি আসতে পারে , যে কোনও মুহুর্তেই ।
অথচ, সিনেমায় বিরতি ব্যাপারটিকে একেবারেই হাল্কাভাবে দেখা চলে না । কেন না , শুধু সিনেমা দেখা বা দেখানোর ক্ষেত্রেই নয় , সিনেমা বানানোতেও বিরতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । বিরতি সিনেমার অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
আমরা যখন কথা বলি, তখন একদমে কখনোই বলি না । সেটা অসম্ভব ব্যাপার । লেখার সময়েও দাঁড়ি কমা ব্যবহার করি । সেও ওই বিরতি দেবার জন্যেই । বিদ্যাসাগর মশাইয়ের আগের আমল পর্যন্ত লিখিত বাংলায় কোনও বিরাম চিহ্ন বা বিরতি চিহ্ন ছিল না । লিখিত ইংরিজি ভাষার অনুসরণে বাংলা ভাষায় দাঁড়ি-কমা-কোলন-সেমি কোলন-জিজ্ঞাসা কিংবা বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যবহারের শুরু ।
সিনেমা যেহেতু আর পাঁচটা মনের ভাব প্রকাশের ভাষার মতোই শিল্প মাধ্যমের একটি ভাষা , সুতরাং তাতে যে বিরতির ব্যবহার থাকবে, এ আর আশ্চর্যের কথা কি । লিখিত ভাষায় যেমন দাঁড়ি কমা, সিনেমায় তেমনি কাট, ফেড ইন , ফেড আউট, ডিজলভ্ ইত্যাদি পদ্ধতির ব্যবহার । এগুলো সবই সিনেমার বিরতি চিহ্ন ।
আবার গল্প-উপন্যাসে যেমন পরিচ্ছেদ বা পর্ব বিভাগ আছে , সিনেমায় সেগুলোর ব্যবহার সিন ( Scene ) কিংবা সিকোয়েন্স ( Sequence ) হিসেবে ।
অভিনয়ের সময়ে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সংলাপ বলতে হয় , বিরতি দিয়ে দিয়ে । কণ্ঠস্বরের ওঠানামা কিংবা জোরে আস্তে সংলাপ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে চরিত্রের মনের ভাব ও বক্তব্য প্রকাশ করতে হয় । তেমনি কখনও কখনও নীরব অভিব্যক্তি দিয়েও অভিনয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটানো যায় । বস্তুত , সিনেমা যেহেতু দৃশ্যমাধ্যম , ফলে একটি সার্থক সিনেমা শব্দ, সংলাপ , সংগীতের তুলনায় নৈঃশব্দ্যের ভূমিকা নেহাত কম নয় । এই নৈঃশব্দ্য অনেকসময়ই সিনেমায় বিরাম চিহ্নের দায়িত্ব পালন করে ।
মঞ্চ হোক , অথবা পর্দা , একটি কথা খুব শোনা যায় ------পজ অ্যাক্টিং ( Pause acting ) । অর্থাৎ সংলাপের মধ্যে মধ্যে নীরবতার বুনন । তাতে অভিনয়ের অভিঘাত আরও তীক্ষ্ণ হয় । কমেডি অভিনয়ের ক্ষেত্রে এটি এক মোক্ষম হাতিয়ার । যে অভিনেতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিরতি অভিনয় যত ভালো , তাঁর কমেডি অ্যাক্টিং তত উচ্চপর্যায়ের । উত্তমকুমার কিংবা রবি ঘোষের অভিনয়শৈলী খুঁটিয়ে দেখলেই পাঠক আমার কথার সত্যতার প্রমাণ পাবেন ।
সিনেমায় দৃশ্যের নাটকীয়তা , বিশেষত , ভয়- সাসপেন্স- উদ্বেগের মুহূর্ত তৈরির ক্ষেত্রে একটি তুমুল শব্দময় দৃশ্যের পরে পরেই একটি নিঃশব্দ মুহূর্ত তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করে । সত্যজিৎ রায় সহ আমাদের দেশের অথবা বিদেশের যে কোনও মহৎ পরিচালকের সিনেমা দেখলেই , পাঠক আমার বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে পারবেন।
দুটি দৃশ্যের মধ্যে ডিজলভ্ , মিক্স কিংবা ফেড ইন, ফেড আউট ব্যবহার করে কাহিনীতে সময়ান্তর অথবা সময়ের ব্যবধান বোঝানো সম্ভব । এও বিরতি চিহ্নেরাই কারসাজি ।
সুতরাং সিনেমায় বিরতি মানেই শুধুই পপকর্ণ খাওয়া আর পেপসি কোলায় গলা ভেজানোর অবসর বোঝায় না । শক্তি সামন্ত থেকে সত্যজিৎ রায়----- যে কোনও সিনেমা নির্মাতাকেই তাই সিনেমা তৈরির সময় বিরতি নামক অস্ত্রের সাহায্য নিতেই হয় ।
তাই বলছিলাম , বিরতি সিনেমারই এক অবিভাজ্য অংশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন