একজন বুড়ো মানুষ
নিরুপমা বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ:বাসুদেব দাস
(১)
অনেকদিন ধরে জীবনে একটাই মাত্র নেশা করে এসেছে বিজয় ভরালী। বই পড়া,খবরের কাগজ
পড়া।তার বাইরে অন্যকোনো ধরনের নেশা তাঁর নেই।না কোনো কাজ-কর্মে,না কোনো ধরনের খাওয়া
দাওয়ায়।সেভাবে কোথাও বেড়াতেও যায় না,অন্য অনেক পেনসন ভোগী প্রৌঢ়দের মতো বাগানের
কাজেও তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। কোনো বন্ধু-বান্ধব ও নেই। অবশ্য তিনি এখন যেখানে আছেন
সেখানে তাঁর বয়সী মানুষ খুব কমই রয়েছে। থাকলেও তাঁর সঙ্গে তাঁদের কতটা বন্ধুত্ব জমে উঠত সেটা
বলা খুবই কঠিন। তিনি নিজে কথা খুব কম বলেন,অন্য কেউ কথা বললে তিনি কেবল হাঁ-হু করে শুনে
যান। কিন্তু সে শোনায় যে তিনি কোনোরকম আনন্দ পান বা বক্তার কথাগুলো যে তিনি আগ্রহের
সঙ্গে শুনছেন তাঁর মুখে সেরকম ভাব মোটেই ফুটে ওঠে না। তাই এরকম ধৈর্যশীল শ্রোতা পেয়েও
বক্তার শেষপর্যন্ত কথা বলার আগ্রহ ফুরিয়ে যায় আর তার ফলে তাঁর সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব জমে
ওঠে না।
খাবার দাবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।নেশা জাতীয় কোনো জিনিস স্পর্শ না করা
ছাড়াও সাধারণ খাবার দাবারেও তাঁর কোনো আগ্রহ বা বিরাগ কিছুই নেই বলে মনে হয়। আর এই একটা
ব্যাপারে বোধহয় বৌমা কমলা শ্বশুরের প্রশংসা করে। স্বামী সঞ্জয় যদি কখনও রান্না বান্নার
ত্রুটি খুঁজে বের করে,খাবারের জিনিস নিয়ে খুঁতখুঁত করে,কমলা বলে-বাবা দেখছি কোনো দিনই কোনো
খাবার জিনিস নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করে না,তুমি কেন খেতে পার না কমলার এই অভিযোগ কিন্তু
একদিন সঞ্জয় নির্মূল করে দিয়েছিল—‘বাবার আপত্তি নেই বল না কমলা.তার চেয়ে বরং বল খাবার
দাবারে বাবার বিশেষ কোনো রুচিই নেই। তাই ভালো-খারাপ যাই বাবাকে দেওয়া হোক না কেন ,বিনা
আপত্তিতে খেয়ে যায়,বাবার মতো সন্ন্যাসী মনোবৃত্তির মানুষ আমিও হলে তুমি কি খুশি হবে
কমলা?’,কথাটা বলে সঞ্জয় কমলার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল,কমলাও প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে
আর কিছু বলে নি।
ছেলে সন্ন্যাসী মনোবৃত্তির মানুষ বললেও কিন্তু সংসারের কর্তব্যটুকু ঠিকই করে
যাচ্ছেন।জীবন বীমা করা,ছেলেকে উপযুক্ত শিক্ষাদান করা,ছেলের বিয়ে দেওয়া-এর প্রতিটি কর্তব্যই
তিনি গৃহীর নিষ্ঠা নিয়ে পালন করেছেন। জীবনে কেবল একটা কাজই বাকি রয়ে গেল। একটা বাড়ি তৈরি
করা,যে কাজটা প্রতিটি সংসারী মানুষই করে থাকেন। তিনি যেন বাড়ি তৈরি করার কোনোরকম উৎসাহ
বোধ করলেন না-অন্তত পেন্সন পেয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরেও। অথচ গুয়াহাটি শহরে এক
সময়ে নিজেই দুকাঠা জমি কিনে রেখেছিলেন। সেই জমি বছরের পর বছর এমনিই পড়ে রইল। বন্য ঘাস
জঙ্গলে আবৃত হয়ে পড়ল।সেই জমির আশেপাশে প্রচুর বাডি-ঘর তৈরি হল। অঞ্চলটা শহরের মধ্যেই
ছিল। কিন্তু এখন শহরের বাইরে বহু দূরবর্তী এলাকায় এমন কিছু সুদৃশ্য অট্টালিকা গড়ে উঠল যেখানে
কিছুদিন আগেও মাঝে মধ্যে বাঘের দেখা পাওয়া যেত। গুয়াহাটি শহরের আশেপাশে প্রতিটি অঞ্চলেই
এখন ঘর-বাড়ি গড়ে ওঠেছে। কেবল বিজয় ভরালীর দুকাঠা মাটিই জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে রইল।
সেই দুকাঠা জমি কেনার জন্য বিজয় ভরালীর কাছে অনেক গ্রাহক এসেছিল । কিন্তু বিজয়
ভরালী সেখানে বাড়ি-ঘর তৈরি না করলেও জমি দুকাঠা কারোকে বিক্রি করতে রাজি হলেন না। অনেকে
তাকে তিনি কেনা দাম থেকে অনেক বেশি টাকা দিতে চেয়েছিলেন,তবু ও তিনি বিক্রি করতে রাজি হলেন
না। সে জমি তিনি কীভাবে বিক্রি করবেন-সেই জমি,সেই জমিতে ঘর তৈরির স্বপ্নের সঙ্গে তো সঞ্জয়
ও জড়িয়ে ছিল,সঞ্জয় যখন রয়েছে,সেই জমি তো তিনি অন্য কাউকে দিতে পারেন না।
সেদিনটা ছিল রবিবারের সকাল।চা খেয়ে ওঠার পরে বিজয় ভরালী চিরাচরিত অভ্যাসমত
সামনের বারান্দার বেতের চেয়ারে একটা বই নিয়ে বসেছিলেন। বারান্দাটা যথেষ্ট ছোট। একটা মাত্র
চেয়ার সেখানে রাখা যায়। কমলা হয়তো সেখানে কোনোকিছুই রাখতে দিত না,কিন্ত শ্বশুর ছোট ঘরের
ভেতর বসে থাকলে বৌমার চলাফেরায় অসুবিধে হয় বলে বেশিরভাগ সময় এইভাবে সামনের বারান্দায়
বসে থাকেন,বেতের চেয়ারটা ও তিনিই বের করে নিয়েছেন। ছোট্ট বারান্দাকে এভাবে চেয়ার পেতে তাকে
আরও সংকীর্ণ করা কমলার মনঃপূত না হলেও তার কিছু করার ছিল না।কারণ ঘরটা সত্যিই
ছোট।সঞ্জয় যদিও বিদেশি ডিগ্রিধারী গুয়াহাটি রিফাইনারির একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার-যে কোয়ার্টারটা
সে পেয়েছে,সেটা খুবই ছোট।অবশ্য ঘরটা দেখতে খুব সুন্দর,একেবারে আধুনিক ডিজাইনের
ঘর।মেঝেগুলি মোজাইক করা,চব্বিশ ঘণ্টা জল পাওয়া যায়,রান্নাঘরে বাসনপত্র মাজার ব্যবস্থা
রয়েছে।প্রতিটি ঘরের ভেতরে দেওয়াল আলমারি।স্নান করার বাথরুমে বেসিনের সঙ্গে আয়না সংলগ্ন
করা।এভাবেই আধুনিক যুগের সমস্ত সুবিধা নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়িটা তৈরি হলেও গৃহস্থ মানুষদের কাছে
ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট।মাত্র চারটে ঘর এবং প্রত্যেকটিই খুব ছোট ছোট।সেই চারটি ঘরের একটিকে
কমলা ড্রইং রুম করেছে,একটাতে খাওয়া দাওয়া,একটিতে ঘুমোনো এবং চার নম্বর ঘরটা শ্বশুর
মশাইয়ের জন্য রাখা হয়েছে।কোনো অতিথি এলে খুব অসুবিধে হয়।শ্বশুরের রুমে অন্য একটি খাট
ঢুকিয়ে অতিথির ব্যবস্থা করতে হয়।দুটো বিছানা পাতার পরে রুমটা এত সংকীর্ণ হয়ে পড়ে যে সেখানে
দুজন মানুষের পক্ষে চলাফেরা করাটা রীতিমতো অসুবিধে জনক হয়ে দাঁড়ায়।অবশ্য এটা একটা সুবিধের
কথা যে কমলাদের বাড়িতে অতিথি খুব কমই আসে | সঞ্জয় মা-বাবার একমাত্র ছেলে,তার ভাই বোন
কেউ নেই। জ্যাঠা বা কাকুদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ কোনো সন্বন্ধ নেই। এই ব্যাপারটা সে পিতার কাছ
থেকেই পেয়েছে। বাবার আসল বাড়ি মঙ্গলদৈ। তিনি বাড়ির সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে
করেছিলেন।প্রামের পুরোনো দিনের রক্ষণশীল পরিবার।সেই বাড়ির ছেলে হীনজাতির মেয়েকে বিয়ে
করার ঘটনাকে কেউ সহজে ক্ষমা করতে পারল না। অবশ্য বিজয় ভরালী সেভাবে ক্ষমা চান নি। তবু
নিজের বাড়ি ঘর। বিজয় ভরালী সেই বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে না পেরে কয়েকবার গেছেন,একা। স্ত্রী
ইলাকে বাপের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন।একা গিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন –তার সঙ্গে বাড়ির লোকেরা কে
কী রকম ব্যবহার করে। মা তাকে দেখে কেঁদেছিল। বাবা গম্ভীর হয়ে ছিলেন। ভাইয়েরা গালিগালাজ
করেছিল। গ্রামের অনেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিরস্কার করেছিল তবু মা কাঁদতে কাঁদতে অনেক আশা
করে ছেলের জন্য রান্না করা ভাত যখন অস্পৃশ্য মানুষকে দেবার মতো করে পৃথক একটা ঘরের
মেঝেতে দিলেন,বিজয়ভরালী সেদিন সেই ভাতের থালা সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন।
সেদিন হয়তো কোনোমতেই তার মুখে খাবার উঠত না,কিন্তু মা যখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে সামনে
দাঁড়িয়ে খাবার জন্য কাকৃতি মিনতি করতে লাগলেন তখন তিনি কেবলমাত্র মায়ের মুখের দিকে
তাকিয়েই দুয়েক গ্রাস খাবার মুখে তুললেন। তারপর তিনবছর তিনি আর বাড়িমুখো হননি । কিন্তু তিন
বছরপরে দুবার ছয়মাসের ব্যবধানে তাকে বাড়ি যেতে হল। ছয়মাসের ভেতরে মা-বাবা দুজনেরই মৃত্যু
হল। মৃত্যুর সময় দুজনের কাউকেই তিনি দেখতে পেলেন না। পুত্রবধূ এবং নাতি দুজনের কাউকেই
জীবনে একবারও না দেখে দুই বুড়ো-বুড়ির মৃত্যু হল।
সেদিন থেকে বিজয় ভরালী আর কোনোদিন বাড়িমুখো হন নি।
নিজের ভাই-বোন নেই। ঠাকুরদা বা জ্যাঠা কারও সঙ্গেই কোনো সম্বন্ধ নেই। তাই সঞ্জয়ের
দিক থেকে কোনো অতিথিই কোনোদিন তাঁদের সেই ছোট ঘরটাতে উপস্থিত হয়ে কমলাকে বিব্রত করে
তোলে নি। বাড়িটা ছোট বলেই সঞ্জয় তাঁর কোনো বন্ধুবান্ধবকে কোনোদিন তার বাড়িতে থাকার জন্য
নিমন্ত্রণ করে নি। তাই অতিথি বলতে কমলার দিক থেকেই বোঝায়। কমলারা তিনভাই,পাঁচবোন। বিজয়
ভরালী পরিপূর্ণ পরিবার দেখেই ছেলের বিয়ের বন্দোবস্থ করেছিল। আত্মীয়-পরিজনহীন নিঃসঙ্গ
জীবন কাটানো ছেলেকে আপনজনে পরিবেষ্টিত করার জন্য,তিনি বৌমা হিসেবে চেয়েছিলেন --ধন না
হলেও জনে পরিপূর্ণ ঘরের একটি মেয়ে।
অনেক সন্ধানের পরে তিনি কমলাকে পেলেন। কমলাকে তাঁর সবদিক থেকেই পছন্দ হয়েছিল।
দেখতে শুনতে ভালো,পড়া-শোনাতেও ভালো। এম.এ পাশ করেছে। ভালো ঘর। কারও মুখেই পরিবার বা
মেয়ে কারও কোনো বদনাম শুনতে পাওয়া যায় নি। কমলাকে দেখে আশীর্বাদ করে তাঁর মুখে একটা পরম
তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছিল । তিনি কমলার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন।
---মা তোমার নাম কমলা হলেও তুমি কিন্তু লক্ষ্ণী সরস্বতী দুটোই। কমলা সেদিন লজ্জার
মুখে তৃপ্তির হাসি হেসেছিল। কমলাকে ঘিরে থাকা আপনজনদের মুখেও সঞ্জয়ের পিতার এই মন্তব্যে
সন্তোষের হাসি ফুটে উঠেছিল । বিজয় ভরালীর ধারণা -সেই সন্তোষের হাসি কমলার আপনজনদের মুখে
আজ পর্যন্ত ম্লান হতে দেখা যায় নি। তিনি বা তাঁর পুত্র সঞ্জয় কেউ ম্লান হতে দেন নি। পিতা-পুত্র
দুজনের কেউ আজ পর্যন্ত তাঁদের মেয়েকে কোনো ধরনের দুঃখ দেন নি--অন্তত তাঁর জানা মতে । আর
তার অজান্তে ?
তার উত্তর কিন্তু বিজয় ভরালীর জানা নেই। কিন্তু তাঁর মনের খুব গোপন কোণে একটা ধারণা
বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে বৌমা কমলা তাঁর ওপরে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। বৌমার কাছে কোনো এক গোপন
অপরাধ তিনি করেছেন। কিন্তু কী যে তাঁর সেই অপরাধ তা আজ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন না।
জ্ঞানতঃ তিনি কোনোদিন কমলাকে কটু কথা বলেন নি বা কোনোরকম আঘাত দেন নি।জীবনের কাছে
আজকাল তাঁর আর প্রার্থনীয় কিছুই নেই। বেঁচে থাকার দৈনন্দিন প্রয়োজন গুলিও তাঁর অতি সামান্য।
চা-চুরুট তিনি খান না। কমলার চাকরকে তাঁর জন্য মাঝে মধ্যে দোকানে গিয়ে সিগারেট,দিয়াশলাই কিনে
আনতে হয় না,এক কাপ চা করে দিতে হয়না,কোনো ফাই-ফরমাশ খাটতে হয় না। নিজের পরনের পোষাক
পরিচ্ছদ বা নিজের গামছাটা নিজেই ধুয়ে দেন। অবশ্য কমলা প্রথমদিকে বলেছিল -নিজের স্নান করা
কাপড় চোপড় কেন তাকে ধুতে হবে। তিনি তখন কমলাকে এই বলে বুঝিয়েছিলেন যে বুড়ো বয়সে মানুষের
একেবারে বসে থাকা উচিত নয়,শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে।অল্প আধটু পরিশ্রম করে শরীরটাকে চলে
থাকার উপযুক্ত করে রাখতে হয়।তিনি একদিনের জন্যও স্নান করা নিয়ে কাউকে কোনো কষ্ট দেন
নি।অনেকে বুড়ো হলে গরম জল ব্যবহার করতে শুরু করে।তিনি সেরকম কোনো অভ্যাস করেন নি।ঠান্ডা
জলে স্নান করার উপকারিতা বিষয়ে তিনি কমলাকে একদিন বুঝিয়েছিলেন—সেদিন খুব ঠান্ডা পরার
জন্য কমলা তাকে স্নানের জন্য গরম জল দিতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল।খাওয়া দাওয়া নিয়ে
কমলার কোনো অসুবিধে ভোগ করতে হয় নি। কম পরিমাণে খান,ভাত-তরকারি ভালো হয়নি বলে
একদিনও রাঁধুনির কাছে অভিযোগ করতে শোনেননি।নূন বেশি হলে বা না হলেও মুখ ফুটে কিছু বলেন না।
তাছাড়া কিছু মানুষ বুড়ো হওয়ার পরে,পেন্সন পাওয়ার পরে নানান বিষয়ে খারাপ অভ্যাস গড়ে
উঠে।প্রায় জীবনজোড়া চাকরির অভ্যস্থতা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা যেন হঠাৎ খুব নিঃসঙ্গ আর
অসহায় পড়ে।তাদের সামনে তখন পড়ে থাকে কেবল সময় আর সময়,অফুরন্ত,অখন্ড ভয়াবহ সময়,যে
সময় তাদের সামনে আর কখনও ভবিষ্যতের কোনো আশার স্বপ্ন জাগাতে পারবে না,যে সময় কেবলই
অতীতমুখী।মহিলা হলে বার্ধক্যের এই ভয়াবহতা এতটা প্রকট হয়ে উঠতে পারে না,কারণ মেয়েদের
সঙ্গে মৃত্যুর প্রায় অগে পর্যন্ত সংসারটা কোনো না কোনো প্রকারে একরকম আন্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
থাকে। সংসারের চাকরি চিরদিনের।কিন্তু সরকারের চাকরির নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। এই বৃদ্ধ
পুরুষরা অনেক সময়েই যাকে সামনে পায় তার সঙ্গেই অনর্গল কথা বলে অখণ্ড সময়ের কিছুটা লাঘব
করতে চায়। অনেকে অন্য কাউকে না পেলে বাড়ির বৌমার সঙ্গেই গল্প করে সময় কাটায়। বৌমার
চোখের সামনে তাঁর সমগ্র অতীত জীবনের চিত্র তুলে ধরতে চায়। কিন্তু বিজয় ভরালীর এই স্বভাবটাও
ছিল না। বৌমার সঙ্গে দুয়েকটা সুখ দুঃখের কথা বলতে কখনও কখনও ইচ্ছা করে,কিন্তু পরমুহূর্তেই
ভাবেন,বেচারির এত কাজ,তাঁর সঙ্গে কথা বলতে থাকলে ওর কীভাবে চলবে?
এভাবেই প্রতিটি কথায় বৌমাকে কোনোরকম অসুবিধেয় না ফেলার চেষ্টা করে এসেছেন
তিনি,কিস্তু কেন জানি তাঁর মনেহয়-তাঁকে নিয়ে কমলার যতটা সুখী হওয়ার কথা ছিল,ততটা যেন সুখী
নয়। তিনি কিন্তু সুখী, অনেক আশা করে বেছে আনা বৌমাকে নিয়ে। সুখী,খুব সুখী--খুব সুখী-- নিজেকে
যেন বারবার তিনি এই বিষয়ে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেন।
তাঁর কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল,তাঁর সুখের জন্য তো আর তিনি বাড়িতে বৌমা আনেন নি।
কিন্তু সঞ্জয় কি কমলাকে নিয়েসুখী?এই প্রশ্ন মাঝেমধ্যেই বিজয় ভরালীর মনে জাগে। যদিও তিনি
বিয়ের পরে সঞ্জয়কে কোনোদিন অসুখী দেখেন নি। অন্য দুটিসুখী দম্পতির মতোই সঞ্জয় এবং কমলা
জীবন কাটাচ্ছে। দুজনেই হাসে,কথা বলে-স্ফুর্তি করে, বেড়াতে যায়,সিনেমায় যায়—সবকিছু করে। আর
বিজয় ভরালী এ খবর ও রাখেন যে আর তিনমাসের মধ্যেই তিনি নাতি বা নাতনির মুখ দেখতে চলেছেন।
তবু তাঁর মনে শঙ্কা জাগে;সঞ্জয় যদি তাঁর মতো নিজে পছন্দ করে বিয়ে করত তাহলে তাঁর এই
আশঙ্কা থাকত না,এতটা দায়িত্ব বোধও থাকত না। তিনি নিজে পছন্দ করে ইলাকে বিয়ে করেছিলেন,
সেই বিয়ের সুখ দুঃখ,বিষ অমৃতের ফল ভোগ করার দায়িত্ব ছিল তাঁর একার। কিন্ত আজযদি কমলার
কোনো কথায় সঞ্জয় দুঃখ বোধ করে তাহলে সেই দুঃখ কি তাকে বেশি স্পর্শ করবে না ? তাঁর কি মনে
হবে না তাঁর নির্বাচনে ভূলের জন্যই ছেলে কষ্ট পাচ্ছে? সঞ্জয় যদি নিজে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে
করত তাহলে বিজয় ভরালী অনেকটা স্বস্তি পেতেন। কিন্তু সঞ্জয় সে পথই মাড়ালো না।আজ পর্যস্ত
তিনি কোনোদিন সঞ্জয়ের সঙ্গে কোনো মেয়ের বন্ধুত্ব দেখতে পাননি।সেজন্যই ইঞ্জিনিয়ারিঙের
শিক্ষা সমাপ্ত করে সঞ্জয় যখন বিলাত থেকে ফিরে এসে রিফাইনারিতে চাকরিতে যোগ দিল,বাধ্য হয়ে
তিনি নিজেই তখন ছেলের জন্য মেয়ের খোঁজ করতে শুরু করলেন। অবশ্য ছেলের অনুমতি নিয়েই।
সঞ্জয় খুব সহজেই পিতার প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিল যে বাবার পছন্দই তাঁর
পছন্দ।
সঞ্জয়ের সেই পরম নির্ভরতাই তাকে বিপদে ফেলল। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ-এই তিনটি চক্রেই
মানব জীবন সম্পূর্ণভাবে আবর্তিত হয়ে চলেছে। সেই বিবাহে,জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পিতার
ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে পরম নিশ্চিন্তভাবে বসে রইল সঞ্জয়।তাই বিজয় ভরালীর দায়িত্ব হাজার
গুণ বেড়ে গেল। চাঁদ সদাগর হওয়ার উপায় নেই। তবুও অনেক খুঁজে খুঁজে তিনি কমলাকে পুত্রবধূ করে
এনেছিলেন। এখন তাই তাঁর মনে মাঝেমধ্যেই শঙ্কামিশ্রিত প্রশ্ন জাগে-তাঁর একমাত্র পুত্র সঞ্জয়
সুখী হয়েছে তো? তাঁর নির্বাচিত বধুকে নিয়ে?
কমালর কথাও ভাবেন তিনি। কেবল ছেলের কথাই নয়। সঞ্জয়কে নিয়ে কমলা সুখী তো? কিন্তু
কমলাকে নিয়ে বিজয় ভরালীর এই ভাবনা খুব বেশি গভীর নয়। উড়ন্ত মেঘের মতো ক্ষণিকের ছায়া
ফেলে মনের মধ্যে। পুত্র-স্নেহ হয়তো এই বিষয়ে তাঁকে কিছুটা অন্ধ করে তুলেছে। কমলাকে সঞ্জয়ের
সঙ্গে অসুখী বলে ভাবতে তাঁর গর্ব বাধা দেয়। সঞ্জয়ের মতো ছেলের সঙ্গে কোনো মেয়ে কি কখনও
অসুখী হতে পারে? সঞ্জয়ের মতো ছেলে অসমে কজন আছে? রূপে-গুণে,বিদ্যায়-চরিত্রে তার তুলনা
পাওয়া ভার।অন্য কিছু তো বাদই,আজ পর্যন্ত একটা সিগারেট মুখে দিয়ে দেখেনি।শান্ত,ধীর প্রকৃ্তির
ছেলে।উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তিনি ওর জন্য কোনো ধরনের দায়িত্ব রেখে যাননি।কত ছেলের মাথার ওপরে
কত ভারী সাংসারিক বোঝা থাকে।ভাই-বোনদের পড়াতে হয়,বিয়ে দিতে হয়-কত ধরনের চিন্তাই না
থাকে।বিয়ের পরে অন্য বাড়ির মেয়ে এসে অনেক সময় সেই সব কারণে অশান্তিতে ভোগে।কিন্তু
সঞ্জয়ের সেই সব কোনো ঝামেলা নেই। সে যা রোজগার করে তার পুরোটাই কমলার হাতে তুলে দেয়।
তিনি ছেলের জন্য কোনো কর্তব্যই রেখে যাননি। নিজের অর্জিত টাকায় ছেলেকে একটা গাড়ি পর্যন্ত
কিনে দিয়েছেন।এখন যে ছেলের সঙ্গে আছেন,তাতেও নিজের পেন্সনের টাকাতেই চলেন।কিন্তু সমস্ত
কিছু করলেও বিজয় ভরালী ছেলের জন্য একটা ঘর তৈরি করে যেতে পারলেন না।
রিফাইনারির এই ফ্ল্যাট বাড়িটা সত্যিই খুব ছোট । তাঁরা বাপ ছেলের কোনো আত্মীয় স্বজন না
এলেও কমলার আত্মীয় স্বজনতো আসতেই থাকে ।কমলার কত আত্মীয়। নিজের বাড়িতেই কত
লোকজন। দাদা-ভাই,বোন,বোনের জামাই,বৌদি,ভাইপো,ভাইঝি মা বাবা-কমলার সবাই রয়েছে। তাঁরা
মাঝে মধ্যে কমলার কাছে আসবে এটা তো খুবই স্বাভাবিক। আসেও। বড় অসুবিধার মধ্যেই তাদের
এখানে থাকতে হয়। বিজয় ভরালী থাকা ছোট্ট রুমটি আরও ছোট হয়ে যায়। কিন্তু ঘর থেকেও বিজয়
ভরালী নিজেই যেন বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে হতে থাকে তিনিই যেন সেই ছোট্ট রুমটিতে
অতিথি হয়ে এসেছেন,কমলার আত্মীয়রা যেনএখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিজয়
ভরালীর সামনের বারান্দার চেয়ারে বসে থাকার মেয়াদ আরও বেড়ে যায়। সঞ্জয়দের ঘরের সামনের
রাস্তা দিয়ে নিয়মিতভাবে আসা যাওয়া করা মানুষগুলি দেখতে পায় সঞ্জয়ের পিতা বিজয় ভরালী।
সকালবেলা সামনের বারান্দার বেতের চেয়ারটাতে বসে হয় কোনো বই,অথবা খবরের কাগজ পড়ছে।
দুপুরবেলাও দেখা যায় তিনি সেই একইভাবে একই ভঙ্গিতে চেয়ারটিতে বসে রয়েছেন। কিন্তু মানুষগুলি
সাধারণত দুপুরবেলা তাকে সেই অবস্থায় বেশিক্ষণ দেখতে পায় না।
দুপুর বেলা তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। কিন্তু বাড়িতে অতিথি থাকলে তাঁর বারান্দায় বসার
মেয়াদ বেড়ে যায়। পথ দিয়ে যাতায়ত করা মানুষ তখন দেখে --চোখের সামনে বইটা মেলে ধরে বুড়ো
মানুষটা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সেদিন রবিবারের সকালে চা-জলখাবার খেয়ে বিজয় ভরালী একটা বই নিয়ে বসার আধঘন্টা পরে
বৌমা কমলা এসে বারান্দা এবং ড্রইংরুমের দরজার সামনে দাঁড়াল।
‘বাবা।’
‘কে?’ও কমলা। প্রায় চমকে উঠল বিজয় ভরালী। বইয়ের মধ্যে একেবারে ডুবে গিয়েছিলেন।
বইয়ের মধ্যে একটা চিহ্ন দিয়ে বইটা বন্ধ করে কমলার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-‘কী
চাই মা?’
বাবা,আমরা দুজনেই একটা কথা ভাবছি। শহরে আপনার যে দুকাঠা জমি পড়ে আছে,এবার
সেখানে বাড়ি তৈরি করলে ভালো হবে। আজকার দিনে গুয়াহাটি শহরে কেউ এভাবে জমি কিনে ফেলে রাখে
না।ঘরের ভাড়া যে পরিমাণে বেড়েছে।আজকাল গুয়াহাটি শহরে ভালো একটা বাড়ি থাকলে তা ভাড়া দিয়েই
একটা পরিবার সুন্দরভাবে চলতে পারে। আপনার জমিটা মিছামিছি কতদিন ধরে পড়ে রয়েছে । আপনি
যদি বুদ্ধি করে প্রথমেই সেখানে একটা বাড়ি বানিয়ে নিতেন,তাহলে সেখান থেকে এতদিনে আমাদের
হাজার হাজার টাকা রোজগার হত। যাই হোক,আগে যা ভূল হওয়ার হয়েছে। এখন কিন্তু আর এভাবে
জমিটা ফেলে রাখা চলবে না। আপনার যদি আপত্তি না থাকে,ও কালকেই সিমেন্ট এবং অন্যান্য
প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য দরখাস্ত করবে।’
প্রথমে এক মুহূর্তের জন্য বিজয় ভরালী স্তব্ধ হয়ে রইলেন। বাড়ি? তাঁর দুকাঠা জমিতে
তাহলে সত্যিই এবার বাড়ি তৈরি করাহবে?
কিন্তু কেবল এক মুহূর্তের জন্য তিনি থমকে রইলেন-তারপরে খুব উৎসাহের সঙ্গে বৌমা
কমলাকে বলে উঠলেন-‘বাড়ি করতে চাইছ,খুবভালো কথা।সংসারী মানুষের একান্ত নিজের মতো করে
একটা বাড়ির খুবই প্রয়োজন।’তারপর কিছুটা অপরাধীর সুরেই নিজের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে
বললেন-‘আমারই খুব ভূল হয়ে গেল। এতবছর এমনিতে জমিটা পড়ে রইল,সেখানে আর বাড়ি তৈরি করা
হল না।'
কমলা ড্রইং রুম আর বারান্দা সংলগ্ন দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। কমলার সঙ্গে আসা সঞ্জয়
কিন্তু বাবার এত কাছে আসার সাহস পায় নি। ভেতরের একটা সোফায় বসে বাবা এবং স্ত্রীর মধ্যে
কথোপকথন গুলি শুনছিল।
সুন্দৰ অনুবাদ।
উত্তরমুছুনঅনুবাদ গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন