স্মৃতি কথা । নীলাঞ্জন কুমার
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
( গত মাসের পর)
।। ৪।।
পরিজন ও পারিপার্শিকতা যখন চিনতে শুরু করেছি, তখন দেখেছি আমার দাদাকে , যে আমার থেকে প্রায় বছর দশেকের বড় । বাবা মা যুক্তি টুক্তি করে দাদার নাম অশোকের সঙ্গে মিল করে আমার নাম দিয়েছিল অন্ঞ্জন । দু দিদির নাম মিলিয়ে বড়র নাম কৃষ্ণা ওছোট- র নাম কাবেরী রাখে স্কুলে পাঠানোর আগে । ছোড়দির সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল বেশ কম । ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গে সখ্যতা কিছুমাত্রায় বেশি ছিল , বাৎসল্যসুলভ মারপিট থেকে ভালোবাসার দিক পর্যন্ত । দুই দিদিকে দেখেছি একসঙ্গে স্কুলে যেতে । স্কুল ছিল কাছেই, অলিগন্ঞ্জ প্রাইমারি হাইস্কুল । প্রাইমারি বসতো সকালে আর দুপুরে বড়দের । দাদা দুপুরবেলায় ভাত খেয়ে যেত মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে । আমার বোধ আসার সময় দাদা ক্লাস এইটে । বয়সের বহু দুরত্ব ও মানসিক দিক দিয়ে ভিন্নতার কারণে তার সঙ্গে সখ্যতা তৈরি হয়নি কোনদিন । নিম্নবিত্তের এক দম্পতির প্রথম সন্তান হিসেবে তার ওপর তাদের প্রত্যাশা ও ভালোবাসার ভাগ বেশি নিয়ে দিদিদের ভেতর চাপা অসন্তোষও দেখেছি । অর্থনৈতিক দিক থেকে বাবা সে সময় রাজ্য সরকার জমিদারদের ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য যে দপ্তর খুলেছিল তার কনিষ্ঠ কেরানি । সাকুল্যে মাসে পেতেন দেড়শোর মতো । তাতে চার ছেলে মেয়ের ভরণপোষণ সহ ছয় জনের সংসার কায়ক্লেশে যেতে দেখিনি ।
যদিও আমাদের তখন ইলেকট্রিক ছিল না । রাতে দাদা দিদিদের পড়াশোনা চলতো লন্ঠনের ভরসায় , ছিল না রেডিও । গনেশ দাদুনের ঘর থেকে আমাদের ঘরে ভেসে আসতো রেডিওর সংবাদ কিংবা গান। তবে একটি জিনিস ছিল তা দম দেওয়া গ্রামোফোন আর প্রচুর গানের বড় গালার রেকর্ড , যার দুদিকে দুটো গান থাকতো , যাদের আমাদের থেকেও বেশি যত্ন করা হতো । বাবা বেতনের পর একটি দুটি করে রেকর্ড কিনতো মায়ের পছন্দমত। মাসে ষোল টাকার ভাড়া বাড়িতে বড় ঘরের এক কোণে গ্রামোফোনটি রাখা থাকতো । প্রতি রাতে আমাদের ঘুমের আগে গান বাজানো হত । আমার ছোড়দির যে গান দুটি না শুনলে ঘুম হত না, তা আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই অসাধারণ গান ' হাট্টিমা টিম টিম ' আর ' ময়নার মা ময়নামতী ' । এক ছোট্ট দুধের বাচ্চা হিসেবে গানের কথাগুলো ঠিকমতো গলাধঃকরণ না করতে পারলেও গানের সুরে ভাসতে ভাসতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম! বাবার থিয়েটারের জগৎ আর মায়ের গানের প্রতি ভালোবাসা মিলেমিশে আমার ভেতরে কি করে যেন প্রবাহিত হতে শুরু করলো যার ফলশ্রুতি হয়তো এই আমি ।
আমাদের ঘরের পাশে আরো একজন ভাড়াটিয়া ছিল, সে হল ময়রা মাসী । মা বলতো ময়রা দিদি । তার ছেলে খ্যাপা কাকুকে মাঝেমধ্যে খেপে যেতে দেখতাম । একখানা ঘরে কোনমতে দিন গুজরান করতো। সময় সময় মা ছেলের দারুণ ঝগড়া লাগতো যা দেখতে দেখতে শোনার অযোগ্য ভাষায় চলে যেত । গনেশ দাদুনের ছেলে বাদল কাকু স্বল্প পড়াশোনার পর লেগে পড়েছিল বাবার ব্যবসায় । তার দুবোন , যাদের বিয়ে হয়েছিল কলকাতাতে। দাদুনের বাবার প্রতি আস্থা ছিল অপরিসীম । অনেক সময় তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে আসতেন ।
দাদুনের ঘরে রেডিও থাকায় মা ওদের দাওয়ায় আমাকে কোলে নিয়ে বিকেলে গান শুনতো আর দিদিমার সঙ্গে আড্ডা দিতো । ওই দাওয়ায় এক নাপতেনিকে আসতে দেখেছি যে মা ও দিদিমাকে আলতা পরিয়ে দিয়ে যেত । এখনো মনে আছে সেই নাপতেনিকে দেখতে ছিল কালোর ওপর অসাধারণ সুন্দরী, সে স্পন্ঞ্জ টিপে টিপে আলতার রঙ বার করতো আর গল্প করতে করতে মায়ের পায়ে তার সুন্দর আঙুল দিয়ে আলতা পরাতো । আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ ও মন যে এতদিন ধরে সে সময় ছোট্টখাট্টো ঘটনাগুলোকে ধরে রাখবে তা কিন্তু তখন বোঝার শক্তি হয়নি । অথচ কি আশ্চর্য আজ এই কথা লিখতে লিখতে যেন চলচ্চিত্রের মতো মনের দোরগোড়ায় এসে তারা বলছে, ' নাও এসেছি লিখে ফেলো লিখে ফেলো ' । এই যেমন ওই বাড়ির ন্যাড়া ছাদ , যা দিয়ে বর্ষার ঘরে জল পড়তো, যা আটকাতে বছরে একবার পিচ ঢালা হত । গরমে ওই ছাদে রাতে ঘুমোতে গিয়ে মেঘের ভেলায় ভেসে চাঁদ চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া, শীতের দুপুরে ছাদে রোদ পোয়ানো আর মকর সংক্রান্তির আগে মেদিনীপুরে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম উঠলে কোন ঘুড়ি কাটা পড়লেই চিৎকার করে আমার গেয়ে ওঠা জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া অপূর্ব তখনকার জনপ্রিয় গান ' চলে গেল আমার/ কানে কানে বলে গেল/ কোকিল এলো মাস এলো ....' -র অবিকল সুরে ' কেটে গেল আমার ...'। ঘুড়ি কাটার পর সেটি দোল খেতে খেতে চলে যাওয়ার দৃশ্যের অনির্বচনীয় আনন্দের ফলশ্রুতি আমার ওই গানের সঙ্গে নাচ দেখে মা হেসে গড়িয়ে পড়তো ।
যতো পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। স্মৃতিকথা পড়ছি নাকি কোনো চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট পড়ছি বুঝতে পারছি না।
উত্তরমুছুন