রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২০

কবিতা কেন লিখি || রবীন বসু || গদ্য

কবিতা কেন লিখি

রবীন বসু





না, আমি প্রেমে পড়ে কবিতা লিখিনি। বা প্রত্যাখ্যাত হয়ে। স্কুলের শেষ ধাপে কিংবা কলেজে প্রথম দিকে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কার হিসেবে হাতে পেয়েছিলুম নগদ ২৫ টাকা আর কিছু বই। বইগুলোর মধ্যে ছিল বিশেষ দুটি বই। যা পরবর্তীতে আমার জীবন ও তার লক্ষ্যের অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছিল। প্রথমটি বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধের বই "কালের পুতুল" আর দ্বিতীয়টি হল কবি "আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা"। এর আগে যা কবিতা পড়া তা ওই পাঠ্য বইয়ে। যৌবনের সেই রোমাঞ্চিত সময়ে সারারাত ধরে ওই আশ্চর্য বইটির পাতা উলটে গেলাম। পাতায় পাতায় ছন্দময় জীবনের এক আলোকিত উদ্ভাস। দেশজ শব্দ, দেখা চিত্রকল্প, পুরাণ-মিথ, লোকজীবনের প্রেম, নারী, ফেলে আসা গ্রাম, আটপৌরে জীবন…সব অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের দোলায় ভাসতে ভাসতে আমার গহিন মনোলোকে স্থায়ী ছাপ ফেলে দিল "সোনালী কাবিন" । সেই আমার কবিতাকে প্রথম ভালোলাগা। আর সেই ভালোলাগার হাত ধরে পর পর এলেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ ও অন্যান্য আধুনিক কবিরা। আমার সমগ্র সত্তায় এইভাবে কবিতা জড়িয়ে গেল। ছড়িয়ে গেল তার শিকড় গভীরে। মাথার মধ্যে আজও ঘোরে---


"কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি

কবিতা চরের পাখী, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস

ম্লানমুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর

কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।"

( আল মাহমুদ ) 


হ্যাঁ, এই সরল আপাত নিরাভরণ শব্দসমষ্টির গভীরে যে জীবনছবি, যে দ্যোতনা তা আমাকে আকৃষ্ট করল। অজান্তে কেন জানিনা একটা সুর সব সময় আমার যাপন-ঘিরে প্রবাহিত হতে লাগলো। ট্রামে বাসে ট্রেনে, এমনকি ভিড়ের মধ্যে বা নির্জনতায় আমার মধ্যে ছবি জাগতে লাগলো। তারই হাত ধরে কিছু শব্দ, কিছু উচ্চারণ উঠে এলো আপনা-আপনি। আর নির্মাণ হতে শুরু করল কবিতা। এই নির্মাণপর্ব না দেখানো যায়, না বোঝানো যায়। বোধের গভীরের এক অবাক বিস্ময়। 

আর এই বিস্ময়কে রূপদান করতে গিয়ে আমাদের শব্দের আশ্রয় নিতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে সংহত করে নিজের জ্ঞান মেধা অনুভব ও অনুসন্ধানের সবটুকু দিয়ে একটা কবিতা নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু এবার প্রশ্ন হল কবিতা কেন লিখব? বা লিখি। মানুষ হিসেবে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, এমনকি নিজের কাছেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যার উত্তর আমরা পেতে চাই। কিংবা নিজস্ব কিছু ভাবনা অনুভব আর্তি অপরকে শোনাতে চাই, যার ফলশ্রুতিতে কবিতা লেখা। আমার নিজের অভিমত সমাজ মানুষ হিসেবে, রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক হিসেবে কবিরও একটা দায়িত্ব থাকে, যারা অনুচ্চার, সংশয়িত, বিশৃঙ্খল, প্রতিবাদহীন ক্ষয়িত নিরন্ন মানুষ তাদের কথা বৃহত্তর মঞ্চে তুলে ধরা। আমিও ব্যক্তিগত ভাবে সময়ের দুর্বিনীত আচরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকতে পারিনা। সমাজের প্রতিটা আলোড়নে গভীর আর্তি আর সংবেদন নিয়ে উপস্থিত হই আমার কবিতায়। আমি সমাজ-বাস্তবতায় বিশ্বাসী । 

আবার আমার যে আত্মগত বোধ তাকে খনন করি ক্রমাগত। খননের পর যে ধ্বংসাবশেষ ওঠে, সেখানে ম্যাগনিফাইং ফেলে তন্ন তন্ন খুঁজি নিজের অর্জন সমৃদ্ধি ব্যর্থতা বা বিকৃতি। আলো ফেলি সুদূর অতীত, ছেড়ে আসা গ্রাম, স্মৃতির নদী, আমার চারপাশের বহমান জীবন, ভালোবাসার মানুষজন, স্বজনবন্ধু, হারানো মুখ আর অনির্দেশ ভবিষ্যতের দিকে। আমি বিশ্বাস করি এতদিন ধরে যেসব কবিতা লিখেছি, তা এই মহাবিশ্বের ইথার তরঙ্গের কোথাও না কোথাও থেকে যাবে। আর অনেক সময় পরে কোন উন্নততর মানবপ্রজাতি এসে  তার পাঠোদ্ধার করবে। এই আশায় আমি কবিতা লিখি। 


1 টি মন্তব্য:

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...