সবাই মিলে সিনেমা হলে ( ১৭)
কান্তিরঞ্জন দে
অক্ষর ও দৃশ্য ।। সাহিত্য ও সিনেমা ।
প্রচলিত সব শিল্পমাধ্যমের ভেতরের আসল বস্তুগুলোকে হজম করে তবেই সিনেমা মাধ্যমটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে---- এ কথা আগেই বলেছি । সাহিত্য দিয়েই শুরু করা যাক।
সাহিত্যরসিক জাতি হিসেবে বাঙালি মহলে সিনেমার সঙ্গে সাহিত্যের আজও কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি রয়ে গেছে । অনেক অভিজ্ঞ সাহিত্যিকও অনেক সময় সাহিত্য-ভিত্তিক সিনেমার স্বাতন্ত্র্য মানতে চান না , অথবা আসল ব্যাপারটা তার জানা নেই বলে , বুঝতে ভুল করেন।
সাহিত্যের যতগুলো শাখা আছে ------- কবিতা , গল্প , উপন্যাস , নাটক, প্রবন্ধ --------- তার সবক'টি তৈরি হয় , অক্ষরের পর অক্ষর , অর্থাৎ শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে । আর সিনেমা তৈরি হয় , দৃশ্যের ( শট ) পর দৃশ্য সাজিয়ে । এইখানেই দুটো মাধ্যমের মধ্যে একেবারে মৌলিক তফাৎ হয়ে যায় ।
অক্ষর বা শব্দ ব্যাপারটা তো বুঝি , কিন্তু শট ( Shot ) কি জিনিস ? এ হচ্ছে দৃশ্যের একেবারে মৌলিক একক । ক্যামেরা একবার খুলে বন্ধ করার আগে একবারে যা রেকর্ড করে নিতে পারল , তাকেই আমরা বলতে পারি শট । সংক্ষেপে একে বলা যেতে পারে দৃশ্যাংশ । সাহিত্যে যেমন ---প্যারাগ্রাফ , সিনেমায় তেমনি সিন ( Scene )। সাহিত্যে যেমন ------ পরিচ্ছেদ বা পর্ব , সিনেমায় তেমনি সিকোয়েন্স ( Sequence ) । সিকোয়েন্সের পর সিকোয়েন্স সাজিয়ে সাজিয়েই গড়ে ওঠে একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমা ।
সাহিত্য ও সিনেমা দুটি মাধ্যমই মূলত গল্প বলার কাজ করে থাকে । তথ্য, তত্ত্ব , যুক্তি দিয়ে গদ্য সাহিত্যে যখন কিছু প্রকাশ করি ---- তখন তাকে বলি , প্রবন্ধ। আর সিনেমাতেও দৃশ্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে তথ্য, তত্ত্ব , যুক্তি হাজির করতে পারি । তখন তাকে বলব ----তথ্যচিত্র । কথাটা ইংরিজি ডক্যুমেন্টারী শব্দের বাংলা অনুবাদ । বাংলাদেশের চলচ্চিত্র রসিক বন্ধুরা আরও সুন্দর করে বলেন ----- প্রামান্য চিত্র বা দলিল চিত্র ।
সাহিত্য এবং সিনেমা দুই-ই গল্প করার কাজ করলেও মাধ্যম ভেদে তাদের উপস্থাপনার পদ্ধতি ,খুব স্বাভাবিক কারণেই আলাদা । গল্প বা উপন্যাসে চরিত্রের মনের মধ্যে কি ঘটছে , সেটা বোঝাবার জন্য লেখককে অনেক সময়ই পাতার পর পর বর্ণনা দিতে হয় । সিনেমায় যেহেতু সবটাই চাক্ষুষ করা যায় , সেক্ষেত্রে পর্দায় হয়তো একটা ছোট কোনও ঘটনা বা কাজ ( অ্যাকশন ) দিয়েই বিষয়টা চট্ করে বোঝানো যেতে পারে ।
এখানে একটা জিনিস পরিস্কার করে নিই । কাঁচা বাণিজ্যিক হিন্দি সিনেমার কুপ্রভাবে আজকাল অ্যাকশন বললেই ঢিসুম ঢিসুম মারপিট বোঝেন । কিন্তু ইংরিজি " অ্যাকশন " শব্দের আসল অর্থ তো ---- কাজ । ঢিসুম ঢিসুম মারপিট থেকে চোখের পলক ফেলার মতো সূক্ষ্ম জিনিস ---- সব কিছুই তাই সিনেমায় অ্যাকশন ।
এ কারণেই , অভিনয় ------- যা গল্প বলা সিনেমার অন্যতম হাতিয়ার , তাকে ইংরিজিতে বলা হয়----- অ্যাক্টিং। আমি যা নই , আমার চলন-বলন , আচরণ , কথাবার্তা , অর্থাৎ সামগ্রিক কাজের মধ্য দিয়ে সেটাকে ফুটিয়ে তোলাটাই হল , অভিনয় অথবা অ্যাক্টিং।
সিনেমায় অভিনয়ের অন্যতম উপাদান হল সংলাপ বা ডায়ালগ ------- যা গল্প-উপন্যাসেরও প্রধান উপাদান । সিনেমা যেহেতু দৃশ্যগত মাধ্যম, তাই সেখানে সংলাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সংযমী এবং সতর্ক থাকতে হয় । সিনেমায় যদি শ্রুতিনাটক , মঞ্চনাটক কিংবা যাত্রার মতো একগাদা " ডায়ালগ " থাকে , তবে তা অতিকথন দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য । যতই মারকাটারি হোক , কিংবা শুনতে যতই জমকালো হোক , সিনেমায় বাড়তি সংলাপ একেবারেই চলে না ।
সাহিত্যের শাখাগুলোর সঙ্গে সিনেমা মাধ্যমটির সম্পর্ক এবং তফাৎ নিয়ে আরও কিছু কথা আছে । কিন্তু , সে সব বলব , রয়ে সয়ে , ধাপে ধাপে । একবারে টানা বলে গেলে , আপনাদের ধৈর্যচ্যূতি ঘটতে পারে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন