সবাই মিলে সিনেমা হলে (১৯)
কান্তিরঞ্জন দে
উৎসব ও সিনেমা
------------------------------
সিনেমা নিজেই একটা উৎসবের সমান । সবাই মিলে সিনেমা দেখা কিংবা দেখতে যাওয়া একটা উৎসব । অনেকগুলো সৃষ্টিশীল মানুষ মিলে একটা সিনেমা তৈরি একটা সমবেত উদযাপন । বর্তমান যুগে একা একা সিনেমা যদিও বা দেখা যায় , একা একা সিনেমা বানানো একেবারেই অসম্ভব ।
সিনেমা কিসের উৎসব ? কিসের আবার ? দৃষ্টিসুখের । প্রায় দু ঘন্টা কিংবা কাছাকাছি সময় ধরে আমরা ( বড় অথবা ছোট ) পর্দায় যে গল্পটি উপভোগ করি ----তা তো আসলে এক ধরণের বিনোদনই । অনেকে ভাবেন , বিনোদন মানে শুধুই হাসি , শুধুই আনন্দ । কিন্তু গভীর আনন্দেও তো আমাদের চোখে কখনও কখনও জল আসে । আসে না কি ? ভারতীয় হোক , অথবা পাশ্চাত্যের-----নন্দনতত্ত্ব বলে , এ-ও এক ধরণের গভীথ বিনোদন । ইংরিজিতে এর একটা গুরুগম্ভীর নাম আছে----- ক্যাথারাসিস । আবার , নায়ক- নায়িকার দুঃখে কাঁদে না , এমন পাষণ্ড দর্শক কেউ আছে নাকি । ওই কান্নাও আমাদের চিত্তকে বিশুদ্ধ করে । এ-ও একধরণের ক্যাথারাসিস বা আত্মমোক্ষণ ।
যাই হোক, অতশত জটিল তাত্ত্বিক আলোচনায় আমরা যাব না । ভারতবর্ষ মহাকাব্যের দেশ । এ দেশের মানুষ গোষ্ঠীগতভাবে পাশ্চাত্যের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি আবেগ নির্ভর । অতএব, এ দেশে খুব বেশি যুক্তি বুদ্ধি নির্ভর শুকনো ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা বানালে দর্শক আনুকূল্য পাওয়া ভীষণ মুস্কিল । এ কথা বহুবছর ধরে বারেবারে প্রমাণিত ।
সত্যজিৎ রায়ের কথাই ধরুন না । তাঁর তৈরি পথের পাঁচালী দেখতে দেখতে কাঁদেন না , বা কাঁদেন নি , এমন দর্শক ভূ-ভারতে আছে নাকি ? ভিন রাজ্যের কিংবা , ভিন দেশের অ-বাংলাভাষী মানুষেরা , এমনকি সাহেব-মেমরা পর্যন্ত , আজও পথের পাঁচালী দেখে চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বেরোন । এ হচ্ছে এক উঁচু স্তরের বিনোদন । সিনেমার গল্পের বিষয়বস্তু যত গভীর রসের হবে , পরিচালক যত গভীর দক্ষতার সঙ্গে সিনেমার ভাষার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে তাকে পর্দায় হাজির করতে পারবেন ------ দর্শক তত বেশি গভীর রসের বিনোদন পাবেন । অবশ্য, দর্শককেও তার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে বৈ কি । এ দুনিয়ায় মুফতে , বিনা পরিশ্রমে কোনও দিন কিছু পাওয়া যায় ?
এই কথাতেই ফিরে আসি আমাদের বিগত কয়েকদিনের আলোচনায় । দর্শক সিনেমা দেখায় নিজেকে শিক্ষিত করতে চাইলে ,তাকে শিল্প সংস্কৃতির প্রতিটি শাখা বিষয়েই ন্যূনত ধারণাটুকু নিয়ে রাখতে হবে । আর চিত্র পরিচালক হতে চাইলে তো প্রতিটি শিল্প মাধ্যম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেই হবে।
আগের দুটো কিস্তিতে সিনেমার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম । আগামীতে এ বিষয়ে আরও কিছু কথা বলে নিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাব"খন ।
শেষে আবার বলি , শারদ উৎসব যেমন শুধুমাত্র ঠাকুর দেখার ব্যাপার নয় , গভীর অনুচিন্তনের ব্যাপারও বটে । সিনেমাও তেমনি শুধুই চোখের খিদে মেটানোর ব্যাপার নয় ।
যারা অতশত সাতপাঁচ ভাবতে রাজি নন, এমন কি, তেমন মানুষজনও উৎসবের পাঁচদিনের মধ্যে একদিন , ঘোরাঘুরি , ঠাকুর দেখা , রেস্টুরেন্টে ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া-র পাশাপাশি সপরিবারে সিনেমা দেখার জন্যও বরাদ্দ রাখেন।
সিনেমা এখানেই বাঙালির কাছে উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন