নস্টালজিয়া ২০
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
আর পাঁচটা শিশুর মতোই আমার শৈশব ও ছিল মায়ের আদর স্নেহ ভালবাসায় সিক্ত, কিন্তু যত বড় হয়েছি মা ততই শাসনের মাত্রা বাড়িয়েছে। আমাদের তিন ভাই বোনকে বড় করতে মায়ের এই শাসনের কড়াকড়ির অর্থ আজ বুঝতে পারি। মায়ের কথা বলতে গেলেই আমার সরল সাদাসিধে আটপৌরে মাকে মনে পড়ে যে সারাদিন কাজের মধ্যে থাকতে ভালবাসত। সংসারের সব কাজ দশভূজার মত সামলাতে অভ্যস্ত ছিল।সংসারের সব কাজ সামলেও মা আচার তৈরি করত, বড়ি দিত, নাড়ু, মুড়কি এসব ঘরেই বানাত। আম, লেবু, কুল,তেঁতুল, লঙ্কা, এঁচোর, সজনে ডাঁটা সব রকমের আচার করত মা।আমাদের বাড়িতে বার মাস মায়ের তৈরি আচার খাওয়া হত। বাড়িতে নারকেল গাছ থাকায় মা সবসময় নারকেল নাড়ু করে রাখতে ভালবাসত। ঠাকুর দেবতাকে প্রতিদিন মা ঘরের তৈরি নারকেলের চিনি অথবা গুড়ের নাড়ু দিত পুজোর সময়। মায়ের কোনো কাজেই অলসতা ছিল না। আমার শৈশবের মা ছিল হাসিখুশি, খুব অল্পে সন্তুষ্ট এক নারী যার জীবনের লক্ষ্য ছিল সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তোলা।আমাদের বাড়ির উঠোনে বিকেলে সব বন্ধু মিলে খেলাধূলা করতাম। আমার ছোটবেলায় মাও অনেক সময় আমাদের সঙ্গে খেলত।পুতুলের বিয়ে দিলে লুচি আলুভাজা করে দিত।কিন্তু পড়াশোনায় ঢিলেমি করলে বা সময় মত পড়তে না বসলে মা খুব বিরক্ত হতো। মা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল। একমাত্র মায়ের উৎসাহেই আমাদের পড়াশোনায় আগ্রহ জন্মেছিল।বাবা নিজের চাকরি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকত। বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকাটা মোটেই পছন্দ করতো না । নিজে খুব সকালে উঠে গঙ্গাস্নান করতে যেত । পূজার্চনা করতে ভালবাসত।মাসের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই সকালে উঠে শুনতাম সেদিন বিশেষ কোনো তিথি তাই মা ভাত খাবে না অথবা উপবাস থাকবে। মা যেদিন ভাত খেত না সেদিন দিনে লুচি হত আর আমাদের সেদিন খুব আনন্দ। আমরাও মায়ের সাথে মঙ্গলচন্ডী, বিপত্তারিণী এইসব পালন করতাম। আমার মামার বাড়িতেও পূজার্চনার খুব প্রচলন ছিল। এখনও আছে সাবেকি আমলের দুর্গাপুজো, নারায়নের নিত্যসেবা, রাধামাধব বিগ্রহ। এই রাধামাধবের বিগ্রহ মায়ের মামার বাড়ির। দুর্গাপুজোর সময় মা খুব বিমর্ষ হয়ে থাকত। নিজের বাড়ির পুজোর জন্য, ভাইবোনদের জন্য মায়ের মন খারাপ করত। বাবা শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া বিশেষ পছন্দ করত না বলে মায়েরও যাওয়া হত না। যে বার আমরা মোরগ্রামে মামার বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় যেতাম সেবার মা খুব খুশি হত। আমারও গ্রামের বাড়ির পুজোয় অন্য রকমের আনন্দের স্বাদ পেতাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন