সবাই মিলে সিনেমা হলে~ ১৬
কান্তিরঞ্জন দে
সিনেমা দেখার " হাজার মজা "
হাজার না হলেও , সিনেমা দেখার " মজা"টা বহু স্তর বিশিষ্ট । সিনেমা যেহেতু শিল্প মাধ্যমের সংসারে নবীনতম সদস্য , তাই সে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত চিত্রকলা , সংগীত , কবিতা , গল্প ,উপন্যাস,নাটক , স্থাপত্যবিদ্যা কিংবা ভাস্কর্যের মতো প্রচলিত শিল্প মাধ্যমগুলির অন্তর্নিহিত বিভিন্ন গুণাবলী আত্মস্থ করেই নিজে আধুনিকতম শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠেছে ।
সুতরাং , সিনেমা দেখার একান্ত নিজস্ব " মজা"টা ঠিকঠাক পেতে গেলে আপনাকে ওই সমস্ত শিল্প মাধ্যমগুলোর সবকটারই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে অন্তত প্রাথমিক ধারণাটুকু নিয়ে রাখতে হবে ।
বিখ্যাত চলচ্চিত্র- সমালোচক , পরিচালক এবং ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সর্বভারতীয় স্তরের অন্যতম সংগঠক শ্রী চিদানন্দ দাশগুপ্ত সিনেমার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ভারি চমৎকার করে বলেছেন যে , ------- " সিনেমা , এ যাবৎ প্রচলিত সব ক'টি শিল্পমাধ্যমের , বিজ্ঞান দ্বারা সংযুক্ত একটি সংমিশ্রণ ।"
সিনেমায় আপনি পেইন্টিয়ের রঙ, রূপ , রেখা এবং বস্তু সংস্থাপন বা কম্পোজিশনের মজা পাবেন । গল্প-উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনার আনন্দ পাবেন । কাব্যের রহস্যময়তা পাবেন । তাছাড়াও পাবেন সংগীতের তাল লয় ছন্দ ও গতিবৈচিত্র্যের মজা এবং স্থাপত্য ও ভাস্কর্যবিদ্যার গঠন ও নির্মাণশৈলীর কারুকাজ। অতএব , বুঝতেই পারছেন , ওইসব মাধ্যমগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে যদি আপনার মৌলিক ধারণা থাকে , তাহলে আপনার পছন্দের সিনেমাটি ( সেটি ক্ল্যাসিক হোক চাই , না হোক ) দেখতে দেখতে আপনি এক বহুমাত্রিক আনন্দের ভাগিদার হয়ে উঠতে পারবেন। সিনেমা তখন আপনার কাছে শুধুই মজা-র ব্যাপার কিংবা সস্তার বিনোদন হয়ে থাকবে না । গভীর অর্থবহ এক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে ।
এই যে এতগুলো শিল্পের বৈশিষ্ট্য , সিনেমায় সেটি সংমিশ্রণের কাজটি করে থাকে বিজ্ঞান । সহজ করে বলতে গেলে পদার্থবিদ্যা এবং ইলেকট্রনিকস্। লেখকের হাতের মূল উপকরণ যেমন কালি, কলম , কাগজ ( হাল আমলে সেটা অবশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে কালি-কম্পিউটার-কী বোর্ড ।) , সিনেমার ক্ষেত্রে তেমনি মূল উপকরণ হচ্ছে ক্যামেরা । আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে ---লেন্স । এই লেন্স বস্তুটি মানুষের চোখের দৃষ্টির চেয়েও বেশি শক্তিশালী । ফলে, ক্যামেরাম্যান ( সিনেম্যাটোগ্রাফার ) অথবা পরিচালক স্বয়ং , যিনিই ক্যামেরাটা চালান না কেন , তিনি লেন্সের ওই ফুটোর মধ্য দিয়েই বস্তুময় বিশ্বরূপকে ধারণ করেন । এই লেন্স ব্যাপারটি হচ্ছে পদার্থবিদ্যা-র মধ্যেকার অপটিকস্ নামক চর্চার অন্তর্ভুক্ত ।
সেই জন্যই পুণে বা কলকাতার সরকারি ফিল্ম ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ক্যামেরার শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হতে চাইলে আপনার ফিজিক্সে অনার্স থাকতেই হবে।
আপনি যদি নিছক সুরসিক সিনেমা দর্শকও হতে চান , তাহলেও আপনাকে বিভিন্ন দূরত্বের লেন্স এবং তাদের মধ্যেকার পার্থক্য বিষয়ে মোটামুটি ওয়াকিবহাল থাকতেই হবে।
লেন্স দিয়ে যে ছবি তোলা হল , ক্যামেরায় আজকাল সেটা ধারণ ( রেকর্ড ) করা হয় ,ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে । বছর দশেক আগেও এ ক্ষেত্রে রসায়নবিদ্যা-র ( কেমিস্ট্রির ) একটা ভূমিকা ছিল । তখন লেন্সের ফুটো দিয়ে আলো ঢুকিয়ে পাতলা রাসায়নিক আস্তরণ ওয়ালা পলিথিনের ফিল্মের ওপরে আলো-ছায়া দিয়ে ছবি ধারণ ( রেকর্ড ) করা হত । এ হল একধরণের আলোছায়ার আঁকিবুকি । পরে ল্যাবরেটারিতে বিশেষ রাসায়নিক তরল দিয়ে সেই ফিল্মটিকে নানা পর্বে ধুয়ে ধুয়ে ছবিটিকে পরিস্ফুট বা স্পষ্ট করা হত । স্টিল ছবির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ছিল একই । এখন অপটিক্যাল ফিল্ম বিলুপ্ত । ফলে , ল্যাবরেটরিগুলোও সব উঠে গেছে । সারা পৃথিবী থেকেই ।
ছবি ধারণ ও পরিস্ফুটনের ক্ষেত্রে রসায়নের জায়গা এখন নিয়েছে , ইলেকট্রনিকস্।
আপনি যখন , সিনেমাহলে , কিংবা টিভিতে , কিংবা কম্পিউটারে , কিংবা হাতের মুঠোফোনে একটি সিনেমা দেখছেন , তখন সেটি স্পষ্ট দেখছেন না ঝাপসা দেখছেন ----- তার ওপর আপনার সিনেমা দেখার আনন্দ পাওয়া না পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে বৈকি । যেমন টাইপিং কিংবা ছাপার গোলমালে আপনার প্রিয় উপন্যাসের রসগ্রহণ ভেস্তে যেতে পারে , তেমনি সিনেমার ক্ষেত্রেও পর্দায় আপনি সিনেমাটা কতটা নিখুঁত দেখতে পাচ্ছেন , তার ওপরে অনেককিছু নির্ভর করে ।
সিনেমাহল ছাড়া অন্যান্য সিনেমা দেখার পদ্ধতি গুলো দর্শক হিসেবে আপনি নিজে হাতে অনেকটা কন্ট্রোলও করতে পারেন।
সে যাই হোক , ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল এই যে ----- সিনেমার গভীর আনন্দ পেতে গেলে আপনাকে শুধু আগ্রহী হলেই হবে না । রসিক হিসেবে নিজেকে যোগ্য করে তুলতেও হবে । বুজতেই পারছেন ------ জটিলকে সহজ করে তোলার নামই আধুনিকতা । যন্ত্রযুগের শিল্পমাধ্যম সিনেমা তাই , আপনার কাজ থেকে আরেকটু উদ্যম আশা করে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন