নস্টালজিয়া ১৫
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
'ছোট প্রাণ ,ছোট কথা ,ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা'দিয়ে ঘেরা ছিল আমার শৈশব। মধ্যবিত্ত সংসারে সেখানে অভাব যেমন ছিল না, তেমনি প্রাচুর্যও ছিল না খুব একটা। ছোটবেলায় আমাদের কোনো আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হতো না। একটু বড় হলে বুঝতে শেখার বয়স হলে মাসের শেষে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখতাম আজও মনে আছে। বাবা সরকারি চাকরি করলেও তখন মাইনে পত্র খুব বেশি ছিল না।আমার মায়ের জীবনযাপন ছিল সাদাসিধে। শৌখিনতা কখনই দেখি নি আমার মায়ের মধ্যে। আমার মায়ের বাপের বাড়ির অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল। কিন্তু মা আমার বাবার সঙ্গে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত সংসারে আনন্দে মানিয়ে নিয়েছিল। আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোও ছিল চাহিদা মুক্ত। নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আমরা না চাইতেই পেতাম। এখনকার মত এত যান্ত্রিক ছিল না আমার শৈশব ও কৈশোর। জিনিসের প্রাচুর্যে নষ্ট করা হয় নি আমাদের শিশুমন।দোষ করলে বকাঝকা শুনতে হত, সেরকম অন্যায় করলে বেদম প্রহারও করা হতো ছেলেদের। এই মার খেয়ে ছেলেরা কিছু যদি করে এই ভাবনার কোনো প্রশ্নই ছিল না কারো মনে। মেয়েরাও মায়ের হাতাখুন্তির আওতা থেকে বাদ পড়ত না।একবার মিথ্যে কথা বলার জন্য আমাকে নারকেল গাছে বেশ কয়েক ঘন্টা মা বেঁধে
রেখেছিল। সেদিন আমার জন্য কষ্টে মাও সারাদিন কিছু খায় নি ।কখনও কোনো জিনিস আমাদের খুব পছন্দ হলে মা -বাবাকে বলতে হত না, তারা কী ভাবে যেন টের পেয়ে যেত। তখনই সেটা না পেলেও পরে ঠিক সান্টাক্লসের মত উপহার পেয়ে যেতাম বাবা মায়ের কাছ থেকে।সেটা যে খুব দামি কোনো উপহার তা কিন্তু নয়। সেই পাওয়ার আনন্দ প্রকাশের কোনো ভাষা জানি না, এখনও শুধুই অনুভব করতে পারি। আজ সংসারের চাকায় পিষ্ট হয়ে ভাবি সেটা জোগাড় করতে সেদিন কত ত্যাগ স্বীকার করেছিল তারা। ছোট ছোট অনুভূতিগুলো গড়ে উঠেছিল আমাদের এভাবেই।
একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। বিকেল বেলা আমরা উঠোনে কুমির ডাঙা খেলছি বেশ কয়েক জন , হঠাৎ নারকেল গাছ থেকে ঝুপ করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। প্রথমে ভয়ে বারান্দায় উঠে গেলেও একটু পরে কাছে গিয়ে দেখি কাঠবেড়ালির বাচ্চা। নারকেল গাছে তাদের বাসা থেকে একসাথে তিনটে জড়াজড়ি করে পড়েছে। গ আমার মাও ছুটে এসে বাচ্চাগুলো বেঁচে আছে কিনা আগে দেখল। তারপরে তাদের একটা বড় বেতের ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে রাখা হল, বেড়ালের হাত থেকে বাঁচাতে । তখন সন্ধে হয় হয়। এমন সময় দেখি সেই ঝুড়ির কাছে ঘোরাফেরা করছে তাদের মা।ঝুড়ির নিচে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে।আমি এগিয়ে গিয়ে ঝুড়িটা খুলে দিতেই মা কাঠবেড়ালি বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে লেজ উঁচিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। এই হলো অপত্য স্নেহ! এরপর আমরা যা দেখলাম আরও আশ্চর্যের ঘটনা। মা কাঠবেড়ালি তার আর একটি বাচ্চাকে মুখে করে গাছ থেকে নামিয়ে এনে ওদের কাছে পৌঁছে দিল। চারটে কাঠবেড়ালি আমাদের কাছে থেকে গেল। রাতটা ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে রাখা হত।ভোর হতেই মা কাঠবেড়ালি সেখানে হাজির হয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিত।ঝুড়ির ঢাকা খুলে দিতেই মা কাঠবেড়ালি খুব খুশি।কুটকুট করে গাজর কেটে খাওয়া শিখিয়ে দিত বাচ্চাদের।আমরা পাকা পেয়ারা , বাদাম দিতাম ওদের। দুই হাতে ধরে ওরা খেত সব।আমাদের খেলার নতুন সাথি জুটে গেল। বাচ্চাগুলো একটু বড় হতে থাকল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ঝুড়ির ঢাকা খোলা। বাচ্চাগুলো একটাও সেখানে নেই ।কিচমিচ শব্দে তাকিয়ে দেখি মা কাঠবেড়ালি তার বাচ্চাগুলো মুখে নিয়ে তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে নারকেল গাছের উপরে।বাচ্চাগুলো আনন্দে তাদের মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে ।আমার খেলার নতুন সঙ্গী চলে যাওয়ার জন্য খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল সেদিন।
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
'ছোট প্রাণ ,ছোট কথা ,ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা'দিয়ে ঘেরা ছিল আমার শৈশব। মধ্যবিত্ত সংসারে সেখানে অভাব যেমন ছিল না, তেমনি প্রাচুর্যও ছিল না খুব একটা। ছোটবেলায় আমাদের কোনো আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হতো না। একটু বড় হলে বুঝতে শেখার বয়স হলে মাসের শেষে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখতাম আজও মনে আছে। বাবা সরকারি চাকরি করলেও তখন মাইনে পত্র খুব বেশি ছিল না।আমার মায়ের জীবনযাপন ছিল সাদাসিধে। শৌখিনতা কখনই দেখি নি আমার মায়ের মধ্যে। আমার মায়ের বাপের বাড়ির অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল। কিন্তু মা আমার বাবার সঙ্গে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত সংসারে আনন্দে মানিয়ে নিয়েছিল। আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোও ছিল চাহিদা মুক্ত। নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আমরা না চাইতেই পেতাম। এখনকার মত এত যান্ত্রিক ছিল না আমার শৈশব ও কৈশোর। জিনিসের প্রাচুর্যে নষ্ট করা হয় নি আমাদের শিশুমন।দোষ করলে বকাঝকা শুনতে হত, সেরকম অন্যায় করলে বেদম প্রহারও করা হতো ছেলেদের। এই মার খেয়ে ছেলেরা কিছু যদি করে এই ভাবনার কোনো প্রশ্নই ছিল না কারো মনে। মেয়েরাও মায়ের হাতাখুন্তির আওতা থেকে বাদ পড়ত না।একবার মিথ্যে কথা বলার জন্য আমাকে নারকেল গাছে বেশ কয়েক ঘন্টা মা বেঁধে
রেখেছিল। সেদিন আমার জন্য কষ্টে মাও সারাদিন কিছু খায় নি ।কখনও কোনো জিনিস আমাদের খুব পছন্দ হলে মা -বাবাকে বলতে হত না, তারা কী ভাবে যেন টের পেয়ে যেত। তখনই সেটা না পেলেও পরে ঠিক সান্টাক্লসের মত উপহার পেয়ে যেতাম বাবা মায়ের কাছ থেকে।সেটা যে খুব দামি কোনো উপহার তা কিন্তু নয়। সেই পাওয়ার আনন্দ প্রকাশের কোনো ভাষা জানি না, এখনও শুধুই অনুভব করতে পারি। আজ সংসারের চাকায় পিষ্ট হয়ে ভাবি সেটা জোগাড় করতে সেদিন কত ত্যাগ স্বীকার করেছিল তারা। ছোট ছোট অনুভূতিগুলো গড়ে উঠেছিল আমাদের এভাবেই।
একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। বিকেল বেলা আমরা উঠোনে কুমির ডাঙা খেলছি বেশ কয়েক জন , হঠাৎ নারকেল গাছ থেকে ঝুপ করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। প্রথমে ভয়ে বারান্দায় উঠে গেলেও একটু পরে কাছে গিয়ে দেখি কাঠবেড়ালির বাচ্চা। নারকেল গাছে তাদের বাসা থেকে একসাথে তিনটে জড়াজড়ি করে পড়েছে। গ আমার মাও ছুটে এসে বাচ্চাগুলো বেঁচে আছে কিনা আগে দেখল। তারপরে তাদের একটা বড় বেতের ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে রাখা হল, বেড়ালের হাত থেকে বাঁচাতে । তখন সন্ধে হয় হয়। এমন সময় দেখি সেই ঝুড়ির কাছে ঘোরাফেরা করছে তাদের মা।ঝুড়ির নিচে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে।আমি এগিয়ে গিয়ে ঝুড়িটা খুলে দিতেই মা কাঠবেড়ালি বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে লেজ উঁচিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। এই হলো অপত্য স্নেহ! এরপর আমরা যা দেখলাম আরও আশ্চর্যের ঘটনা। মা কাঠবেড়ালি তার আর একটি বাচ্চাকে মুখে করে গাছ থেকে নামিয়ে এনে ওদের কাছে পৌঁছে দিল। চারটে কাঠবেড়ালি আমাদের কাছে থেকে গেল। রাতটা ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে রাখা হত।ভোর হতেই মা কাঠবেড়ালি সেখানে হাজির হয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিত।ঝুড়ির ঢাকা খুলে দিতেই মা কাঠবেড়ালি খুব খুশি।কুটকুট করে গাজর কেটে খাওয়া শিখিয়ে দিত বাচ্চাদের।আমরা পাকা পেয়ারা , বাদাম দিতাম ওদের। দুই হাতে ধরে ওরা খেত সব।আমাদের খেলার নতুন সাথি জুটে গেল। বাচ্চাগুলো একটু বড় হতে থাকল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ঝুড়ির ঢাকা খোলা। বাচ্চাগুলো একটাও সেখানে নেই ।কিচমিচ শব্দে তাকিয়ে দেখি মা কাঠবেড়ালি তার বাচ্চাগুলো মুখে নিয়ে তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে নারকেল গাছের উপরে।বাচ্চাগুলো আনন্দে তাদের মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে ।আমার খেলার নতুন সঙ্গী চলে যাওয়ার জন্য খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল সেদিন।
বাঃ খুব সুন্দর স্মৃতিচারণা। অভিজ্ঞতায় খানিক মিল পেলাম। আমি আর দুই বন্ধু তিনজনে মিলে ফাঁকা চাষের জমির অন্য পারে গিয়ে সিগারেট টেনেছিলাম। সেই সিগারেট এনেছিল এক বন্ধু। ওর বাবা ছাদে রেখেছিল সিগারেটের প্যাকেট। তা কয়েক মাস জলে ভিজে রোদে শুকিয়ে সিজনড সিগারেট হয়ে গেছিল। আশ্চর্য জনক ভাবে কাগজ খুলে যায় নি। যাই হোক সে তো তিনজনে টানলাম। ফেরার সময় আরেক বন্ধু আমাদের সিগারেট অভিযানের কথা বাড়িতে জানিয়ে দিল। সে বন্ধুটি তেরো চোদ্দো বছর বয়সে পাটের ফেসো জড়িয়ে কালীপুজোর সময় বহুরূপী সেজেছিল। তখন কেরোসিন কুপি জ্বলত। তার আগুনে পুড়ে বেচারা মারা যায়। যাই হোক বাড়ি ফেরার পর পাড়ার বাপীদা আমার মা দিদিমার শাসনে কাঁঠাল গাছে বেঁধে রেখেছিল বেশ কিছু সময়। এক স্মৃতি আরেক স্মৃতিকে উসকে দ্যায়। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন