ন্যানো টেক্সট || গোপন মিনার ৫
রুদ্র কিংশুক
খুব অল্প বয়সে আরামবাগের কাছাকাছি লোহাই নামের এক প্রতন্ত গ্রামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নাম প্রফুল্লকুমার মিত্র। জয়েন করার কয়েকদিন পরেই দেখলাম প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে তিনি কড়া বক্তব্য রাখছেন। কোন ছাত্র আম কাটার ছুরি এনেছে সঙ্গে এবং অন্য কোন ছাত্র মাস্টারমশায়ের কাছে সেটি রিপোর্ট করেছে। অনেককটা কৌতুক বশত:। মাস্টারমশাইয়ের বক্তব্য: তোমরা আজকাল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্কুলে আসছো। এটা অত্যন্ত অপরাধমূলক। অপরাধীদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হবে।
মানুষটির শরীর খুবই দুর্বল। ওজন ৪০/৪২। সস্তা ছিটের জামা ও ধুতি । বহু পুরাতন একটি সাইকেল ।সেটি কেবল তাঁরই কথা শোনে। ক্রমে ক্রমে দেখলাম ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং এলাকার মানুষ তাঁকে খানিকটা সমীহ করে। তিনি কাউকেই ভয় করেন না এবং জোড়-হস্ত হওয়া তাঁর অভিযানে কোথাও লেখা নেই। তিনি আস্তে কথা বলেন কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের দৃঢ় প্রত্যয়। ধীরে ধীরে জানা হলো তিনি বাংলা সংস্কৃত ইংরেজি --- তিন ভাষাতে সমান দক্ষ। শুধু তাই নয়। স্কুলে যে কোন মাস্টারমশাইয়ের অনুপস্থিতিতে ক্লাসে গিয়ে তিনি সেই বিষয়টি পড়িয়ে আসার যোগ্যতা রাখেন। বাংলা-ইংরেজি ইতিহাস দর্শন এবং গণিত--- সব বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ। আস্তে আস্তে তাঁর ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়লাম। প্রধান শিক্ষকের অফিস দোতালায়। স্টাফ রুম একতলায়। মাঝে মাঝে তাঁর ডাক আসতো। আলপনাদি অথবা মিনু এসে বলতেন: আপনাকে বড়বাবু ডাকছেন।
আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম: কিছু বলছেন স্যার?
উনি মৃদু মৃদু হেসে বললেন: আরে না না, কতক্ষণ তোমাকে দেখি নি। বেলুন একটু চা কর তো।
তারপর নানান গল্প।রাজনীতি-সমাজনীতি। তিনি মনের দিক থেকে খুব আপটুডেট মানুষ।
একবার জ্বর হলো। একটা ভাড়া বাড়িতে থাকি। স্কুলের কাছেই। সঙ্গে আরো দুজন নতুন সহকর্মী। জয়ন্ত আর গোপাল। সন্ধ্যেবেলায় ফল হাতে আমাকে দেখতে এলেন হেডমাস্টারমশাই। প্রথমে কপালে হাত রাখলেন। যেন আমার পিতা। মৃদু স্বরে বললেন: কেমন আছো গো?
আমি বললাম: আবার আপনি কষ্ট করে!
উনি বললেন: বাবা মাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে কত দূরে আছো! আমি আসবো না!
এখন তিনি আর আমার সহকর্মী নন। রোগ ক্লান্ত' শিশুটির পাশে তিনি হয়ে উঠেছেন তার অভয় দাতা পিতা। আস্তে আস্তে তিনি আমাকে ভালোবাসার জালে বেঁধে ফেললেন।
একবার একটি ছাত্রকে খুব কড়া শাসন করেছিলাম। তখন স্কুল-কলেজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেছে। মাস্টারমশাইয়ের দাপটে আমাদের স্কুলটা ছিল খানিকটা এসবের বাইরে। তো, আমার সেই অপরিণামদর্শিতার কারণে সেটা ঘটে গেল। অভিভাবক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা আমার বিচার করতে এলেন। আমি খুব লজ্জিত, হয়তো কিছুটা ভীত। হেডমাস্টারমশাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। আলপনাদি মজা করে বললেন:
বড়বাবু ডাকছেন। আপনার বিচার হবে।
আমি ছুটে গেলাম করে অফিসে। বেশ কিছু লোক। আমি খুব সংকুচিত। মাস্টারমশাই ধীর গলায় বললেন:
এই তরুণ শিক্ষক আমার স্কুলের সম্পদ। একজন শিক্ষকের জ্ঞান আন্তরিকতা যা যা গুণ থাকা আবশ্যক, সব এর মধ্যে আছে। স্কুলের দরকার একে। আপনাদের ছেলেকে বরং অন্য স্কুলে ভর্তি করান। আমি টিসি দিচ্ছি। স্কুলের অভাব নেই। আমি আমার ১০০০ ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করতে পারিনা। তারপর বহু তর্জন গর্জন করে তাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত করলেন এই শর্তে আর কোনদিন স্কুলে এসে স্কুলের ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করবেন না।
মনে মনে আমি ওনার পায়ে প্রণাম জানালাম। উনি আমার গায়ে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে বললেন: সমাজ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে বাপু।
ওই স্কুলে বেশি দিন ছিলাম না। কিন্তু ওই বিদ্যালয় আর ওই অতিশীর্ণকায় মাস্টারমশাইকে আজও ভুলতে পারিনি। সংকোচের বিহ্বলতায় যখনই ম্রিয়মাণ হতে চেয়েছি, স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে তাঁর স্মৃতি।
তিনি ছিলেন আমার সহকর্মী, তার চেয়েও অধিক আমার শিক্ষক। আজ শিক্ষক দিবসে তাঁকে প্রণাম জানাই । যতদূরেই থাকুন, ভালো থাকুন। এই ভেড়ুয়া মানুষে ভরা মেরুদণ্ডহীন সমাজে আজও আপনার প্রয়োজন আছে।
রুদ্র কিংশুক
সঙ্গে ওনার ছাত্র কবি অশোক কুমার মোহন্ত |
খুব অল্প বয়সে আরামবাগের কাছাকাছি লোহাই নামের এক প্রতন্ত গ্রামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নাম প্রফুল্লকুমার মিত্র। জয়েন করার কয়েকদিন পরেই দেখলাম প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে তিনি কড়া বক্তব্য রাখছেন। কোন ছাত্র আম কাটার ছুরি এনেছে সঙ্গে এবং অন্য কোন ছাত্র মাস্টারমশায়ের কাছে সেটি রিপোর্ট করেছে। অনেককটা কৌতুক বশত:। মাস্টারমশাইয়ের বক্তব্য: তোমরা আজকাল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্কুলে আসছো। এটা অত্যন্ত অপরাধমূলক। অপরাধীদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হবে।
মানুষটির শরীর খুবই দুর্বল। ওজন ৪০/৪২। সস্তা ছিটের জামা ও ধুতি । বহু পুরাতন একটি সাইকেল ।সেটি কেবল তাঁরই কথা শোনে। ক্রমে ক্রমে দেখলাম ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং এলাকার মানুষ তাঁকে খানিকটা সমীহ করে। তিনি কাউকেই ভয় করেন না এবং জোড়-হস্ত হওয়া তাঁর অভিযানে কোথাও লেখা নেই। তিনি আস্তে কথা বলেন কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের দৃঢ় প্রত্যয়। ধীরে ধীরে জানা হলো তিনি বাংলা সংস্কৃত ইংরেজি --- তিন ভাষাতে সমান দক্ষ। শুধু তাই নয়। স্কুলে যে কোন মাস্টারমশাইয়ের অনুপস্থিতিতে ক্লাসে গিয়ে তিনি সেই বিষয়টি পড়িয়ে আসার যোগ্যতা রাখেন। বাংলা-ইংরেজি ইতিহাস দর্শন এবং গণিত--- সব বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ। আস্তে আস্তে তাঁর ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়লাম। প্রধান শিক্ষকের অফিস দোতালায়। স্টাফ রুম একতলায়। মাঝে মাঝে তাঁর ডাক আসতো। আলপনাদি অথবা মিনু এসে বলতেন: আপনাকে বড়বাবু ডাকছেন।
আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম: কিছু বলছেন স্যার?
উনি মৃদু মৃদু হেসে বললেন: আরে না না, কতক্ষণ তোমাকে দেখি নি। বেলুন একটু চা কর তো।
তারপর নানান গল্প।রাজনীতি-সমাজনীতি। তিনি মনের দিক থেকে খুব আপটুডেট মানুষ।
একবার জ্বর হলো। একটা ভাড়া বাড়িতে থাকি। স্কুলের কাছেই। সঙ্গে আরো দুজন নতুন সহকর্মী। জয়ন্ত আর গোপাল। সন্ধ্যেবেলায় ফল হাতে আমাকে দেখতে এলেন হেডমাস্টারমশাই। প্রথমে কপালে হাত রাখলেন। যেন আমার পিতা। মৃদু স্বরে বললেন: কেমন আছো গো?
আমি বললাম: আবার আপনি কষ্ট করে!
উনি বললেন: বাবা মাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে কত দূরে আছো! আমি আসবো না!
এখন তিনি আর আমার সহকর্মী নন। রোগ ক্লান্ত' শিশুটির পাশে তিনি হয়ে উঠেছেন তার অভয় দাতা পিতা। আস্তে আস্তে তিনি আমাকে ভালোবাসার জালে বেঁধে ফেললেন।
একবার একটি ছাত্রকে খুব কড়া শাসন করেছিলাম। তখন স্কুল-কলেজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেছে। মাস্টারমশাইয়ের দাপটে আমাদের স্কুলটা ছিল খানিকটা এসবের বাইরে। তো, আমার সেই অপরিণামদর্শিতার কারণে সেটা ঘটে গেল। অভিভাবক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা আমার বিচার করতে এলেন। আমি খুব লজ্জিত, হয়তো কিছুটা ভীত। হেডমাস্টারমশাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। আলপনাদি মজা করে বললেন:
বড়বাবু ডাকছেন। আপনার বিচার হবে।
আমি ছুটে গেলাম করে অফিসে। বেশ কিছু লোক। আমি খুব সংকুচিত। মাস্টারমশাই ধীর গলায় বললেন:
এই তরুণ শিক্ষক আমার স্কুলের সম্পদ। একজন শিক্ষকের জ্ঞান আন্তরিকতা যা যা গুণ থাকা আবশ্যক, সব এর মধ্যে আছে। স্কুলের দরকার একে। আপনাদের ছেলেকে বরং অন্য স্কুলে ভর্তি করান। আমি টিসি দিচ্ছি। স্কুলের অভাব নেই। আমি আমার ১০০০ ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করতে পারিনা। তারপর বহু তর্জন গর্জন করে তাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত করলেন এই শর্তে আর কোনদিন স্কুলে এসে স্কুলের ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করবেন না।
মনে মনে আমি ওনার পায়ে প্রণাম জানালাম। উনি আমার গায়ে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে বললেন: সমাজ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে বাপু।
ওই স্কুলে বেশি দিন ছিলাম না। কিন্তু ওই বিদ্যালয় আর ওই অতিশীর্ণকায় মাস্টারমশাইকে আজও ভুলতে পারিনি। সংকোচের বিহ্বলতায় যখনই ম্রিয়মাণ হতে চেয়েছি, স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে তাঁর স্মৃতি।
তিনি ছিলেন আমার সহকর্মী, তার চেয়েও অধিক আমার শিক্ষক। আজ শিক্ষক দিবসে তাঁকে প্রণাম জানাই । যতদূরেই থাকুন, ভালো থাকুন। এই ভেড়ুয়া মানুষে ভরা মেরুদণ্ডহীন সমাজে আজও আপনার প্রয়োজন আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন