সৌমিত্র রায়-র জন্য গদ্য
প্রভাত চৌধুরী
১৪৮.
এতগুলি পর্ব লেখা হয়ে গেল , এখনো দীপংকর-দার কথা লেখা হল না। তবে আমি মূলত নয়ের দশকের কবিদেরই আমার আলোচ্য-সৃচিতে রেখেছি। তবু বিভিন্ন প্রসঙ্গে রাজকল্যাণ চেল অমিতাভ মৈত্র নিখিলকুমার সরকার প্রশান্ত গুহমজুমদার সন্দীপ বিশ্বাস প্রমুখ সাত কিংবা আটের দশকের কবিদের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু দীপংকর ঘোষ-র কথা লেখাই হয়নি। কিন্তু এটাকে অস্বীকার করা যাবে না , যে কাটোয়ার মতি এবং জপমালা-র মতোই কবিতাপাক্ষিকের প্রতি ভালোবাসা ওদের থেকে কম ছিল না। এর জন্য দীপংকরদার ভাগ্যকে দোষারোপ করে আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি বরং দীপংকরদার কবিতাপাক্ষিক সম্পর্কিত কিছু লেখা এখানে তুলে দিলাম।
' হ্যাঁ নদী হাঁটে । কবিতাপাক্ষিকের দশম বর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান হল কাটোয়ায়। তখনও কবিতাপাক্ষিকের সঙ্গে নদী হেঁটেছিল ।হেঁটেছিল ভাগীরথী, অজয়। সারা কাটোয়া শহর তখন কবিতাপাক্ষিক হয়ে গিয়েছিল। নাসের , মুরারি, ঠাকুরদাস,শান্তনু, শুভাশিস , কওসর, সুবীর সবাই যেন কাটোয়ার ঘরের ছেলে। মঞ্চ ছেড়ে আলোক সরকার, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরীরা তো আমাদের শশাঙ্কদার সঙ্গে নীচে বসেছিলেন। এই না হলে কবিতাপাক্ষিক পরিবার। '
আমি এই লেখাটিতে যখন ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কাটোয়া-পর্ব লিখেছিলাম , কই তখন তো এত বিশদে লেখা হয়নি। দীপংকরদার লেখার এই উদ্ধৃতি প্রমাণ করে দেবে উৎসবের ঐতিহ্য। নেহাৎ ছেলেদের -ছোকরাদের খেলা ছিল না। এতজন অগ্রজ কবি কাটোয়ায় চলে এসেছিলেন কেবলমাত্র পারিবারিক সূত্রে।
কবিতাপাক্ষিকের সঙ্গে নাসের-এর যে আত্মীয়তা , দীপংকারদার সঙ্গেও সেই একই আত্মীয়তা।
একটা খবর আমার কানে এসেছিল। আমার তথা আমাদের বই সে ফেরিওয়ালার ঝুলি থেকে কিনেছিল। অর্থাৎ দীপংকরদার মৃত্যুর পর যেভাবেই হোক তাঁর সঞ্চিত বইপত্র কেজি দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
এই খবরটি পেয়েছিলাম তরুণতম কবি-সম্পাদক শুভদীপ সেনশর্মা সূত্রে। সংবাদটি আমাকে ব্যথিত করেছিল। আমি মতি বা মুহম্মদ মতিউল্লাহ-কে ফোন করে সত্যতা যাচাই করেছিলাম।
এই ঘটনার জন্য নিজেকে দোষী ভাবছি । কাটোয়া-র ' অজয় ' সাহিত্য পর্ষদের দায়িত্ব যদি শতকরা ১০ ভাগ হয় , বাকি ৯০ ভাগের দায় কবিতাপাক্ষিকের। এবং তা আমার একার।
আমি পারিনি দীপংকর ঘোষ-এর মতো একজন কবি এবং লেখক-কে ঠিক মতো প্রজেক্ট করতে। বাংলাভাষার পাঠকের কাছে দীপংকরদার লেখাকে পৌঁছে দিতে। কেন পারিনি তার ব্যাখ্যা একটা আছে আমার কাছে , সেটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি।
কবি দীপংকর ঘোষের লেখার সূচনা কলকাতায়। তখন আনন্দমোহন এবং বিদ্যাসাগর কলেজ সূত্রে। বিদ্যালয় শিক্ষা ময়মনসিংহ -এ।
কফি হাউসে রমানাথ রায় সুব্রত সেনগুপ্ত আশিস ঘোষ -দের বা শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের সঙ্গে বসতেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায় এবং আমার সঙ্গেও আড্ডা হয়েছিল। আর কবিতাপাক্ষিক পর্বে দীপংকরদা আমার মতোই পরিবারের অভিভাবক।
দীপংকর ঘোষ তাঁর কবিতা এবং গল্প-কে বলতেন প্রস্তাব। যেমন বলতেন : প্রস্তাব -আলেখ্য গল্প।
এই কনসেপ্ট বাংলাসাহিত্যে একেবারেই নতুন। কবিতাকেও বলতেন প্রস্তাব - আলেখ্য।
সে-সময় আমরা কবিতাপাক্ষিক নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলাম , দীপংকারদার প্রস্তাব-কে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তখন আমার কাটোয়া-কলকাতার মান্থলি টিকিটটি হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাটোয়া না গিয়েও দীপংকর ঘোষের প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
আজ শুরু করছি। পড়া যাক কয়েকটি প্রস্তাব -এর অংশ।
১॥ নদী বলে মেয়েটি কোনোকালে নদী ছিল না। নদী নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত।নিজের দিকে তাকাবার তার সময় কই ?
২॥ নদীর সঙ্গে বিয়ে হয় আকাশমণির।পাগলা মাতাল জলঙ্গি শান্ত হয়। এয়োতিরা সিঁদুর খেলে আকাশমণির ঘাটে।
৩॥ একজন কবি যে , এমন করে নিঃশব্দে চলে যায় তা আমার জানা ছিল না। লোকটা দোকানপাট খোলা শহরের ভিড়ভাট্টার মধ্য দিয়ে চলে গেল। কেউ কিছু জানল না।
দীপংকর ঘোষ লিখেছিলেন। আমরা পড়েছিলাম। পড়েও কোনো শিক্ষাগ্রহণ করিনি । আমি অনুতপ্ত। এই শুরু করলাম দীপংকরদার ' প্রস্তাব ' নিয়ে কথা বলা। আজকের তরুণদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তাঁর প্রস্তাবগুলিকে।
কথা দিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন