বেঁচে থাকা
প্রশান্ত দে
প্রতিবছর দুর্গাপূজা পেরোলে কারু বাগ্দীর বয়স একবছর করে বাড়ে।দেখতে দেখতে তাঁর বয়স হয়ে গেল তিনকুড়ি ষোল।এক বয়সে ছুতোরের কাজে তাঁর বেশ নামডাক ছিল।এখন আর তাকে বাছলা আগর কিংবা বাটালি চালাতে হয় না।বাছলা চালানো কোমরের ঝোঁকটা একটু বেশিই বেড়েছে বয়েসের ফলে।দুইছেলে চেন্নাইয়ে এক প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করে। টাকা যৎসামান্য যা পাঠায় তাতেই বুড়াবুড়ির চলে যায়।
ছেলেরা বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে সেখানেই থাকে।পূজা র্পার্বনে মেড়সমেত আসে আর কয়েকদিন থেকে চলে যায়।ছেলেদের রোজগারপাতি ভালৈই হওয়াতে তাদের সাবেক টালির চালার সামনে একখানা চার কামরার ঘরও উঠে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু চালাটা দালান ঘরের সমস্ত সৌন্দর্য ম্লান করে দিচ্ছে ।এই নিয়ে ছেলেরা যতবার আসে ততবারই বাবাকে অভিযোগ করেএবং বলে "বাবা!,ঐ পুরাতন টালির চালাটা ভেঙে দাও"
কিন্তু বৃদ্ধ প্রতিবারই নিষেধ করে বলে ,"থাকনা ,এটা তোদের কি খাচ্ছে?"
ছেলেরা কোনভাবেই বুঝতে পারেনা ব্যপারটা কি।আর তেমন ভাবে বুঝার চেষ্টাও করেনা এই ভেবে যে আর কটা দিনই বা থাকি!এখানে অতিথির মতো আসি আর রিটার্ন টিকিট কাটাই থাকে ...চলে যাই।
বাবা অসুস্থ শুনে দু- ছেলেই ছেলে মেয়ে বৌ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।বাবার ফোনে আব্দার মতোএইবার এই অসময়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা ।আজ যাব কাল যাব করতে করতে একমাস হয়ে গেল।বৃদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠেছে।এইদিকে দুর্গাপূজা এগিয়ে আসছে দেখে মায়ের কথামতো পূজার পরই সবাই যাবার সিদ্ধান্ত নিল।
পূজা আর দিন পনের বাকি।দুই ভাই সুজন ও বিজন ঠিক করল যে অনেক দিন হয়ে গেল ঘরটার রং করা হয় নাই তাই এইবার যখন আগের থেকেই আছি তখন ঘরটায় একটু রং করিয়ে দিই। নিজেদের প্রস্তাব বাবার কাছে রাখল।বাবা খুশি হল।এবং বলল ,"পুরানো ঘরটাও একটু খড়ি বুলিয়ে দিতে পারবি? পিছনদিকটা চাকলা ছাড়ছে...নিচগুলা ঝিটে খেয়ে ফেলেছে"
পুরানো ঘরটার কথা শুনে সুজন বলল,"তুমি যে কি বল বাবা....,ঐ ঘরটার আর প্রয়োজনটা কি?আমরা চাইছি ঘরটা ভেঙে ফেলি।ঘরের সামনেটা একটু পাওয়া যাবে"।আর তাতে সায় দিল বিজন।
বৃদ্ধ ছেলেদের উত্তেজনা দেখে আর বলার সাহস না পেয়ে শরীর ঝুঁকিয়ে সরে পড়ে যেতে যেতে বলল,"আমি বেঁচে থাকতে ঐ ঘর ভাঙতে দুব নাই।তোরা তোদের ঘর রং করাবি করা ,পারিস যদি একলিটার আলকাতরা এনে দিবি।"
আলকাতরার কথা শুনে বিজন একটু জোরে বলল,"আগের দু-লিটার আলকাতরা শেষ হয়ে গেল?
বৃদ্ধ পিতা ছেলের এহেন প্রশ্নে থমকে দাঁড়াল এবং ছেলেদের সন্দেহ দূর করতে ঘুরে কাছে এসে বলল,"না অল্প আছে"
বিজন --কোথায় এত লেপ-ছ?
বৃদ্ধ ,"দেখতে চাস ?" বলে দু ছেলেকে চালাটাতে ডেকে নিয়ে গেল।ঘরের বর্গা গুলো দেখিয়ে বলল,"কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
ছেলেরা দেখতে পেল ঘরের সমস্ত বর্গা একরকম ঘুনে খেয়ে ফেলেছে একটার একহাত পরিমান ছাড়া।
সুজন দেখেই বলল,"এত আলকাতরা এই একটা জায়গায় লেপেছ!
--কেন জানিস?
--না ।না বললে জানবো কি করে?
--তোর দাদু এই জায়গাটায় আমাকে বাছলা চালাতে শিখিয়েছিল।দেখছিস নাই ...একটু বেশিই কেটে ফেলেছি।আর সেই শিক্ষা দিয়েই কতঘরের ছাদন দিয়েছি ।তোদের আমি বড় করেছি।তোরা আজ চেন্নাই গেছিস"
বৃদ্ধ কথাগুলো বলার পর একটু আনমনা হয়ে গেল।মনে হল সেই মুহুর্ত টা ফুটে উঠেছে।তারপর ধীরে ধীরে ভাঙা কন্ঠস্বরে বলল,"আমি ....যতদিন বেঁচে আছি .....আমার মধ্যে .....তোদের দাদুও বেঁচে আছে রে"
সুজন ও বিজন মাথা নিচু করে চালাটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।
প্রশান্ত দে
প্রতিবছর দুর্গাপূজা পেরোলে কারু বাগ্দীর বয়স একবছর করে বাড়ে।দেখতে দেখতে তাঁর বয়স হয়ে গেল তিনকুড়ি ষোল।এক বয়সে ছুতোরের কাজে তাঁর বেশ নামডাক ছিল।এখন আর তাকে বাছলা আগর কিংবা বাটালি চালাতে হয় না।বাছলা চালানো কোমরের ঝোঁকটা একটু বেশিই বেড়েছে বয়েসের ফলে।দুইছেলে চেন্নাইয়ে এক প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করে। টাকা যৎসামান্য যা পাঠায় তাতেই বুড়াবুড়ির চলে যায়।
ছেলেরা বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে সেখানেই থাকে।পূজা র্পার্বনে মেড়সমেত আসে আর কয়েকদিন থেকে চলে যায়।ছেলেদের রোজগারপাতি ভালৈই হওয়াতে তাদের সাবেক টালির চালার সামনে একখানা চার কামরার ঘরও উঠে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু চালাটা দালান ঘরের সমস্ত সৌন্দর্য ম্লান করে দিচ্ছে ।এই নিয়ে ছেলেরা যতবার আসে ততবারই বাবাকে অভিযোগ করেএবং বলে "বাবা!,ঐ পুরাতন টালির চালাটা ভেঙে দাও"
কিন্তু বৃদ্ধ প্রতিবারই নিষেধ করে বলে ,"থাকনা ,এটা তোদের কি খাচ্ছে?"
ছেলেরা কোনভাবেই বুঝতে পারেনা ব্যপারটা কি।আর তেমন ভাবে বুঝার চেষ্টাও করেনা এই ভেবে যে আর কটা দিনই বা থাকি!এখানে অতিথির মতো আসি আর রিটার্ন টিকিট কাটাই থাকে ...চলে যাই।
বাবা অসুস্থ শুনে দু- ছেলেই ছেলে মেয়ে বৌ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।বাবার ফোনে আব্দার মতোএইবার এই অসময়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা ।আজ যাব কাল যাব করতে করতে একমাস হয়ে গেল।বৃদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠেছে।এইদিকে দুর্গাপূজা এগিয়ে আসছে দেখে মায়ের কথামতো পূজার পরই সবাই যাবার সিদ্ধান্ত নিল।
পূজা আর দিন পনের বাকি।দুই ভাই সুজন ও বিজন ঠিক করল যে অনেক দিন হয়ে গেল ঘরটার রং করা হয় নাই তাই এইবার যখন আগের থেকেই আছি তখন ঘরটায় একটু রং করিয়ে দিই। নিজেদের প্রস্তাব বাবার কাছে রাখল।বাবা খুশি হল।এবং বলল ,"পুরানো ঘরটাও একটু খড়ি বুলিয়ে দিতে পারবি? পিছনদিকটা চাকলা ছাড়ছে...নিচগুলা ঝিটে খেয়ে ফেলেছে"
পুরানো ঘরটার কথা শুনে সুজন বলল,"তুমি যে কি বল বাবা....,ঐ ঘরটার আর প্রয়োজনটা কি?আমরা চাইছি ঘরটা ভেঙে ফেলি।ঘরের সামনেটা একটু পাওয়া যাবে"।আর তাতে সায় দিল বিজন।
বৃদ্ধ ছেলেদের উত্তেজনা দেখে আর বলার সাহস না পেয়ে শরীর ঝুঁকিয়ে সরে পড়ে যেতে যেতে বলল,"আমি বেঁচে থাকতে ঐ ঘর ভাঙতে দুব নাই।তোরা তোদের ঘর রং করাবি করা ,পারিস যদি একলিটার আলকাতরা এনে দিবি।"
আলকাতরার কথা শুনে বিজন একটু জোরে বলল,"আগের দু-লিটার আলকাতরা শেষ হয়ে গেল?
বৃদ্ধ পিতা ছেলের এহেন প্রশ্নে থমকে দাঁড়াল এবং ছেলেদের সন্দেহ দূর করতে ঘুরে কাছে এসে বলল,"না অল্প আছে"
বিজন --কোথায় এত লেপ-ছ?
বৃদ্ধ ,"দেখতে চাস ?" বলে দু ছেলেকে চালাটাতে ডেকে নিয়ে গেল।ঘরের বর্গা গুলো দেখিয়ে বলল,"কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
ছেলেরা দেখতে পেল ঘরের সমস্ত বর্গা একরকম ঘুনে খেয়ে ফেলেছে একটার একহাত পরিমান ছাড়া।
সুজন দেখেই বলল,"এত আলকাতরা এই একটা জায়গায় লেপেছ!
--কেন জানিস?
--না ।না বললে জানবো কি করে?
--তোর দাদু এই জায়গাটায় আমাকে বাছলা চালাতে শিখিয়েছিল।দেখছিস নাই ...একটু বেশিই কেটে ফেলেছি।আর সেই শিক্ষা দিয়েই কতঘরের ছাদন দিয়েছি ।তোদের আমি বড় করেছি।তোরা আজ চেন্নাই গেছিস"
বৃদ্ধ কথাগুলো বলার পর একটু আনমনা হয়ে গেল।মনে হল সেই মুহুর্ত টা ফুটে উঠেছে।তারপর ধীরে ধীরে ভাঙা কন্ঠস্বরে বলল,"আমি ....যতদিন বেঁচে আছি .....আমার মধ্যে .....তোদের দাদুও বেঁচে আছে রে"
সুজন ও বিজন মাথা নিচু করে চালাটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন