সবাই মিলে সিনেমা হলে~ ১১
কান্তিরঞ্জন দে
হাল বাংলার সিনেমা
বাংলা সিনেমার হাল
মাত্র কয়েকদিন আগে পথের পাঁচালী সিনেমা মুক্তির ৬৫ বছর পূর্ণ হল । খাঁটি সিনেমার ভাষায় তৈরি প্রথম সার্থক বাংলা সিনেমা , তথা ভারতীয় সিনেমা । ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট সত্যজিৎ রায় প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে , ভারতীয়রাও শিল্পগুণসম্পন্ন সিনেমা বানাতে পারে ।
অনেকের আজও ধারণা ----- পথের পাঁচালী বোধহয় বাংলা বাজারে ভালো চলে নি । ওসব সত্যজিৎ রায়- টায়দের ছবি বিদেশে প্রাইজ - টাইজ পায় ঠিকই । কিন্তু হুঁ হুঁ বাবা !! বাংলা বাজার বড় কঠিন ঠাঁই । এখানে সিনেমা নিয়ে অত সিরিয়াস হলে ব্যবসা করা মুস্কিল । অনেক প্রযোজক পরিচালকের এটাই মনের কথা ।
কিন্তু , ভাবনাটা একেবারে ভুল । বসুশ্রী ,বীণা , শ্রী সহ অন্যান্য হলে প্রথম রিলিজ করে পথের পাঁচালী ভালোই ব্যবসা দিয়েছিল । আজও দিয়ে চলেছে । বসুশ্রীতে এ ছবি টানা ১৪ সপ্তাহ চলেছিল ।
২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির মধ্যে ৩ /৪ টি বাদ দিলে , সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ ছবি প্রথম রিলিজেই বাণিজ্য সফল । যেগুলো প্রথম দফায় ফ্লপ , সেগুলো সহ সত্যজিতবাবুর সব ছবিই আজও ধারাবাহিক প্রফিট দিয়ে আসছে । ব্যবসার ভাষায় একে বলে , রিপিট বা রি-সেল ভ্যালু ।
শুধু রায়সাহেব কেন , ঋত্বিক ঘটক , মৃণাল সেন , বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত , উৎপলেন্দু চক্রবর্তী , অপর্ণা সেন , গৌতম ঘোষ----- প্রত্যেকের ছবির রিপিট ভ্যালু অত্যন্ত ভালো ।
অন্যদিকে মশলাদার বাণিজ্যিক ছবি , আজ হিট হয়েছে , কিন্তু পরের বছর সে ছবি দেখবার দর্শক নেই , এমন আকছার ঘটে ।
সিনেমাকে সব সময় মনে রাখতে হয় , সে একইসঙ্গে শিল্প এবং বাণিজ্য দুই-ই । এখনকার বাংলা সিনেমার সবগুলো সম্পর্কে সে কথা বলা চলে কি ? হাল আমলের বাংলা সিনেমার হাল কি ? এ প্রশ্নের এককথায় উত্তর হল---- হাঁড়ির হাল । আমি করোণা সংকটের আগের সময়ের কথাই বলছি ।
পথের পাঁচালী-র সময় থেকে গত ৬৫ বছরে বাংলা সিনেমা কতটা এগিয়েছে , সে খতিয়ান নেবার প্রয়োজন আছে বৈ কি । সারা পৃথিবীতেই সিনেমা একইসঙ্গে বাণিজ্য এবং শিল্প । যাকে বলে , কমার্শিয়াল বা পপুলার আর্ট ।
উত্তমকুমার মারা যাবার পরে , গত ৪০ বছরে বাংলা সিনেমার ব্যবসার জগতে এমন কিছু ফাটকা কারবারী ঢুকে বসে আছেন , যারা শিল্প বোঝার তো প্রশ্নই উঠছে না। সিনেমা বাণিজ্যটাও ভালো করে বোঝেন না । যারা বোঝেন , তারা আবার মৌরসি পাট্টায় বিশ্বাসী । নতুন প্রযোজক-পরিবেশকদের চট্ করে বাজারে ঢুকতে দিতে চান না ।
ফাটকা কারবারীরা সৎ ও অসৎ নানা উপায়ে বেশ কিছু পয়সা কামিয়ে মোহ এবং লালসার বশে সিনেমায় টাকা ঢালতে চলে আসেন । সিনেমা মাধ্যমটির বৈশিষ্ট্য , গুণাগুণ কিছু সম্পর্কেই এদের কোনও ভালোবাসা বা আগ্রহ নেই ।এরা চান সিনেমার ঘাড়ে চেপে যেন তেন প্রকারেন টাকা কামাতে । সিনেমা এদের কাছে স্রেফ মুনাফা ধরার কল।
১৯৫০-৬০ - ৭০ দশকের পরিচ্ছন্ন পারিবারিক ছবিগুলো কিন্তু বাণিজ্যিক ছবিই ছিল। সেগুলো হিটও হত । কারণ প্রযোজকেরা জানতেন , সিনেমার গুণাগুণ নির্ভর করে তার গল্পে ও পরিচালনায় । শুধু নায়ক নায়িকার সুন্দর মুখ দেখিয়ে কখনও ব্যবসা নিশ্চিত করা যায় না । সেই সময়ের সিনেমাগুলোর রিপিট ভ্যালু আজও দুর্দান্ত । উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি হলে তো কথাই নেই ।
হাল হামলের বাংলা সিনেমার ব্যবসা ততটা নিশ্চিত কি ?? হ্যাঁ মানছি ---১৯৮০-র দশক থেকে টেলিভিশন এবং ইদানীংকালে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এসে সিনেমা ব্যবসাকে অনেক জটিল করে দিয়েছে ।
কিন্তু ভালো গল্প , দক্ষ পরিচালনা এবং ভালো উপাদান দিলে দর্শক চিরকাল সে সিনেমাকে মাথায় করে রাখে । কিন্তু আমোদ বিতরণের নামে যুক্তিহীন নাচাগানা , মারপিট , ঝলমলে পোশাক-আশাক , চোখ ধাঁধানো লোকেশন দেখিয়ে দর্শককে বেশিদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না । এর সঙ্গে বস্তাপচা আবেগকে যারা সিনেমা হিট করানোর একমাত্র শর্টকাট ভাবতেন ---- আজ তাদের মাথায় হাত ।
অন্যদিকে , ঝকঝকে মাল্টিপ্লেক্সের কথা ভেবে যারা স্মার্ট প্রেমকাহিনী কিংবা বড়লোকী ড্রয়িংরুম ড্রামাকেই একমাত্র ফর্মূলা ভেবে বসেছিলেন , তাদের জারিজুরিও আজ শেষ হতে বসেছে ।
আসলে ভেজাল সিনেমা ব্যবসায়ী এবং অতিচালাক সিনেমা নির্মাতারা ভুলে যান যে ----- গ্রাম হোক কিংবা শহর ------ সব জায়গার দর্শক সবসময় চান ভালো গল্প , ভালো অভিনয় , ভালো গান , এবং পরিচ্ছন্ন বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনার কাজ । দর্শককে অশিক্ষিত এবং বোকা ভাবা-র রোগ হাল আমলের বাংলা সিনেমার ঘাড়ে একেবারে চেপে বসেছে ।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে , বাইরের চাকচিক্য অনেক বেড়েছে , প্রযুক্তিগত সুযোগসুবিধে অনেক সহজলভ্য হয়েছে ঠিকই ।
কিন্তু বাইরে থেকে যতই ঝকঝকে দেখাক, পথের পাঁচালীর আমল থেকে হাল আমলের বাংলা সিনেমার হাল কতটা ফিরেছে-----সে সন্দেহ থেকেই গেছে ।
করোণা সংকট বাংলা সিনেমা ব্যবসার হাল কোনদিকে নিয়ে যাবে ?
সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করবার ইচ্ছে রইল ।
কান্তিরঞ্জন দে
হাল বাংলার সিনেমা
বাংলা সিনেমার হাল
মাত্র কয়েকদিন আগে পথের পাঁচালী সিনেমা মুক্তির ৬৫ বছর পূর্ণ হল । খাঁটি সিনেমার ভাষায় তৈরি প্রথম সার্থক বাংলা সিনেমা , তথা ভারতীয় সিনেমা । ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট সত্যজিৎ রায় প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে , ভারতীয়রাও শিল্পগুণসম্পন্ন সিনেমা বানাতে পারে ।
অনেকের আজও ধারণা ----- পথের পাঁচালী বোধহয় বাংলা বাজারে ভালো চলে নি । ওসব সত্যজিৎ রায়- টায়দের ছবি বিদেশে প্রাইজ - টাইজ পায় ঠিকই । কিন্তু হুঁ হুঁ বাবা !! বাংলা বাজার বড় কঠিন ঠাঁই । এখানে সিনেমা নিয়ে অত সিরিয়াস হলে ব্যবসা করা মুস্কিল । অনেক প্রযোজক পরিচালকের এটাই মনের কথা ।
কিন্তু , ভাবনাটা একেবারে ভুল । বসুশ্রী ,বীণা , শ্রী সহ অন্যান্য হলে প্রথম রিলিজ করে পথের পাঁচালী ভালোই ব্যবসা দিয়েছিল । আজও দিয়ে চলেছে । বসুশ্রীতে এ ছবি টানা ১৪ সপ্তাহ চলেছিল ।
২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির মধ্যে ৩ /৪ টি বাদ দিলে , সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ ছবি প্রথম রিলিজেই বাণিজ্য সফল । যেগুলো প্রথম দফায় ফ্লপ , সেগুলো সহ সত্যজিতবাবুর সব ছবিই আজও ধারাবাহিক প্রফিট দিয়ে আসছে । ব্যবসার ভাষায় একে বলে , রিপিট বা রি-সেল ভ্যালু ।
শুধু রায়সাহেব কেন , ঋত্বিক ঘটক , মৃণাল সেন , বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত , উৎপলেন্দু চক্রবর্তী , অপর্ণা সেন , গৌতম ঘোষ----- প্রত্যেকের ছবির রিপিট ভ্যালু অত্যন্ত ভালো ।
অন্যদিকে মশলাদার বাণিজ্যিক ছবি , আজ হিট হয়েছে , কিন্তু পরের বছর সে ছবি দেখবার দর্শক নেই , এমন আকছার ঘটে ।
সিনেমাকে সব সময় মনে রাখতে হয় , সে একইসঙ্গে শিল্প এবং বাণিজ্য দুই-ই । এখনকার বাংলা সিনেমার সবগুলো সম্পর্কে সে কথা বলা চলে কি ? হাল আমলের বাংলা সিনেমার হাল কি ? এ প্রশ্নের এককথায় উত্তর হল---- হাঁড়ির হাল । আমি করোণা সংকটের আগের সময়ের কথাই বলছি ।
পথের পাঁচালী-র সময় থেকে গত ৬৫ বছরে বাংলা সিনেমা কতটা এগিয়েছে , সে খতিয়ান নেবার প্রয়োজন আছে বৈ কি । সারা পৃথিবীতেই সিনেমা একইসঙ্গে বাণিজ্য এবং শিল্প । যাকে বলে , কমার্শিয়াল বা পপুলার আর্ট ।
উত্তমকুমার মারা যাবার পরে , গত ৪০ বছরে বাংলা সিনেমার ব্যবসার জগতে এমন কিছু ফাটকা কারবারী ঢুকে বসে আছেন , যারা শিল্প বোঝার তো প্রশ্নই উঠছে না। সিনেমা বাণিজ্যটাও ভালো করে বোঝেন না । যারা বোঝেন , তারা আবার মৌরসি পাট্টায় বিশ্বাসী । নতুন প্রযোজক-পরিবেশকদের চট্ করে বাজারে ঢুকতে দিতে চান না ।
ফাটকা কারবারীরা সৎ ও অসৎ নানা উপায়ে বেশ কিছু পয়সা কামিয়ে মোহ এবং লালসার বশে সিনেমায় টাকা ঢালতে চলে আসেন । সিনেমা মাধ্যমটির বৈশিষ্ট্য , গুণাগুণ কিছু সম্পর্কেই এদের কোনও ভালোবাসা বা আগ্রহ নেই ।এরা চান সিনেমার ঘাড়ে চেপে যেন তেন প্রকারেন টাকা কামাতে । সিনেমা এদের কাছে স্রেফ মুনাফা ধরার কল।
১৯৫০-৬০ - ৭০ দশকের পরিচ্ছন্ন পারিবারিক ছবিগুলো কিন্তু বাণিজ্যিক ছবিই ছিল। সেগুলো হিটও হত । কারণ প্রযোজকেরা জানতেন , সিনেমার গুণাগুণ নির্ভর করে তার গল্পে ও পরিচালনায় । শুধু নায়ক নায়িকার সুন্দর মুখ দেখিয়ে কখনও ব্যবসা নিশ্চিত করা যায় না । সেই সময়ের সিনেমাগুলোর রিপিট ভ্যালু আজও দুর্দান্ত । উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি হলে তো কথাই নেই ।
হাল হামলের বাংলা সিনেমার ব্যবসা ততটা নিশ্চিত কি ?? হ্যাঁ মানছি ---১৯৮০-র দশক থেকে টেলিভিশন এবং ইদানীংকালে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এসে সিনেমা ব্যবসাকে অনেক জটিল করে দিয়েছে ।
কিন্তু ভালো গল্প , দক্ষ পরিচালনা এবং ভালো উপাদান দিলে দর্শক চিরকাল সে সিনেমাকে মাথায় করে রাখে । কিন্তু আমোদ বিতরণের নামে যুক্তিহীন নাচাগানা , মারপিট , ঝলমলে পোশাক-আশাক , চোখ ধাঁধানো লোকেশন দেখিয়ে দর্শককে বেশিদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না । এর সঙ্গে বস্তাপচা আবেগকে যারা সিনেমা হিট করানোর একমাত্র শর্টকাট ভাবতেন ---- আজ তাদের মাথায় হাত ।
অন্যদিকে , ঝকঝকে মাল্টিপ্লেক্সের কথা ভেবে যারা স্মার্ট প্রেমকাহিনী কিংবা বড়লোকী ড্রয়িংরুম ড্রামাকেই একমাত্র ফর্মূলা ভেবে বসেছিলেন , তাদের জারিজুরিও আজ শেষ হতে বসেছে ।
আসলে ভেজাল সিনেমা ব্যবসায়ী এবং অতিচালাক সিনেমা নির্মাতারা ভুলে যান যে ----- গ্রাম হোক কিংবা শহর ------ সব জায়গার দর্শক সবসময় চান ভালো গল্প , ভালো অভিনয় , ভালো গান , এবং পরিচ্ছন্ন বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনার কাজ । দর্শককে অশিক্ষিত এবং বোকা ভাবা-র রোগ হাল আমলের বাংলা সিনেমার ঘাড়ে একেবারে চেপে বসেছে ।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে , বাইরের চাকচিক্য অনেক বেড়েছে , প্রযুক্তিগত সুযোগসুবিধে অনেক সহজলভ্য হয়েছে ঠিকই ।
কিন্তু বাইরে থেকে যতই ঝকঝকে দেখাক, পথের পাঁচালীর আমল থেকে হাল আমলের বাংলা সিনেমার হাল কতটা ফিরেছে-----সে সন্দেহ থেকেই গেছে ।
করোণা সংকট বাংলা সিনেমা ব্যবসার হাল কোনদিকে নিয়ে যাবে ?
সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করবার ইচ্ছে রইল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন